দোঁহা

সত্য বই মিথ্যা বলিব না

 


মিলি ঘোষ


জন্ম যদি সত্য হয়, মৃত্যুও অমোঘ। এই চরম সত্যটি জেনেও আমরা বেঁচে থাকি। নিজেদের মতো করে ভালো থাকার চেষ্টা করি। তাহলে মেনোপজে অসুবিধা কোথায়? এও তো জীবনের অঙ্গ। চুলে রুপোলি রেখা দেখা দিলে কী মানুষ হায় হায় করে? কেউ বা পাকা চুল ঢাকার চেষ্টা করেন বিভিন্ন পন্থায়। অনেকে তাও করেন না। সে জন্য কপাল কেউ চাপড়েছেন বলে আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। কারণ, এটাই স্বাভাবিক। বাল্য থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য প্রতিটি ধাপ মানুষকে পেরোতে হয়। এই লম্বা জার্নিতে গোলাপের পাঁপড়ি বিছানো থাকে না। কারোরই থাকে না। কম বেশি হতে পারে। কিন্তু কাঁটা ছাড়া জীবন হয় না। সব মানুষকেই কাঁটা বেছে বেছে পথ চলতে হয়। সে জন্য কি পথ চলা বন্ধ থাকে? 


ঋতুস্রাব হলো মেয়েদের জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন মেয়েদের নানারকম শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, যা কখনও যন্ত্রণাদায়ক, কখনও অস্বস্তিকর। তাই এই সময়কালকে কোনও মেয়েই খুব সুখের সময় মনে করে না। যদিও এটা কোনও অসুখ নয়। বরং এটি একটি মেয়ের সুস্থতার লক্ষন। এটি না হলে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। তা ছাড়া এই সময়কালে শরীরে যদি কিছু অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রেও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আসলে ঋতুস্রাব কোনও রোগ নয়। যেহেতু এর সঙ্গে সন্তান ধারণের একটা সম্পর্ক আছে, তাই একে সাদরে গ্রহণ করাই শ্রেয়। ঘুম পাওয়া, খিদে পাওয়া যেমন জীব-জগতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটিও তাই। একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে ঘুমোনোর পর আমাদের আর ঘুমের অনুভূতি থাকে না। খাবার খাওয়ার পর আমাদের কি আর খিদের অনুভূতি থাকে? থাকে না। কারণ, প্রতিটি প্রক্রিয়ার যেমন একটা শুরু থাকে, তেমন শেষও থাকে। ঋতুস্রাবও তেমন একটি প্রক্রিয়া, যা নারী শরীরে ঘটে থাকে। জীব-জগতের রোজকার প্রক্রিয়ার সঙ্গে এর পার্থক্য হলো এটি মাসে একবার হয় এবং চলে তিন চারদিন ধরে। কাজেই এটি যে মেয়েদের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সে ব্যাপারে কোনও দ্বিমত থাকার কথা নয়। তবে এ ক্ষেত্রে আর একটি বিষয় অবশ্যই উপস্থাপন করা প্রয়োজন। তা হলো, কোনও ঋতুমতি নারী কখনওই অস্পৃশ্য নয়। তার ছোঁয়া খেতে অন্যদের অসুবিধা কোথায়? কেন সে মন্দিরে বা ঠাকুরঘরে প্রবেশ করতে পারবে না? প্রশ্ন আসা উচিত এখানে। হতাশা আসা উচিত এখানেই যে, এখনও আমরা এত কেন পিছিয়ে? কেন আমরা সত্যকে মানতে পারি না! মা, ঠাকুমারা যা বুঝিয়ে আসছেন, কেন আমরা যুক্তি ছাড়া সে'সব বিশ্বাস করি? কেন বলতে পারি না, তোমরা ভুল? এই বলায় ঔদ্ধত্য নেই। তাঁদের বোঝাতে হবে তাঁদের মতো করে, যথাযোগ্য সম্মান দিয়েই। তারও আগে দরকার নিজেদের বোঝা। পুরোনো কু-প্রথাকে আঁকড়ে ধরে থাকার সঙ্গে মা মাসিদের সম্মান করার কোনও সম্পর্ক নেই। এই জায়গায় যদি আমরা ব্যর্থ হই, হতাশা আসবে তখনই। মেনোপজে কীসের হতাশা! বিজ্ঞানকে বুঝতে হবে। মেনোপজ যে বয়সে হয়, সে বয়সে মহিলাদের সন্তান ধারণ করার ক্ষমতা থাকে না বললেই চলে। তা'ই মেনোপজ। এতে তো হতাশার কিছু থাকতে পারে না। এই বিষয়টাকে অনেকে নারীত্বের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। নারী শরীরের একটা প্রক্রিয়া মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট বয়সে শুরু হয় এবং শেষও হয় পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে। কিছু ব্যতিক্রম সব কিছুর মতো এতেও আছে। জীবনের এই সময়সীমার সঙ্গে নারীত্বের কী সম্পর্ক! নারীত্বের পরিধি অনেক বিস্তৃত। ব্যক্তি বিশেষে তার সীমারেখা কম বেশি হয়। কিন্তু মেনোপজ একটি নির্দিষ্ট সময়কাল এবং তা বিজ্ঞাননির্ভর। তার সঙ্গে মনন বা জীবনবোধের কোনও সম্পর্ক নেই। একটি নারীর নারীত্ব গড়ে ওঠে তার পারিবারিক কাঠামো, তার শিক্ষা, আদর্শ, জীবনদর্শন, লক্ষ্য ইত্যাদি বহু বিষয়ের ওপর নির্ভর ক'রে। একজন মহিলা মা না হয়েও নারী। মাতৃত্বের সঙ্গে ঋতুস্রাব প্রক্রিয়ার সম্পর্ক আছে। কিন্তু নারীত্বের সঙ্গে নেই। দুটোকে এক করে দেখার প্রশ্নই আসে না। তবু আমাদের সমাজে মেনোপজকে ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করা হয়। 'নারীত্বের শেষ' নামক তকমা সেঁটে দেওয়া হয়। 


সমাপ্তির সংকেত? কথাটাই হাস্যকর বা অতি দুঃখজনক। মেনোপজ যখন হয়, সে বয়সে অন্যান্য কাজের চাপ মহিলাদের একটু কমের দিকেই থাকে। সন্তানের শিক্ষা বা চাকুরিজীবন নিয়ে কিছুটা চাপ তখনও থাকে অনেকের। আবার বহুজন সে চাপ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় ছেলেমেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষা বা কর্মজীবনের জন্য ভিনরাজ্যে অথবা বিদেশে থাকতে হচ্ছে। স্বামী অফিসে বেরিয়ে গেছেন। স্ত্রী বাড়িতে একা। তখন 'হায় আমার একী হলো' না করে বহু মহিলা নিজেদেরকে পছন্দমতো কাজে লিপ্ত করছেন। হয়তো মনের কোণে লুকিয়ে থাকা কোনও সুপ্ত ইচ্ছা, যা তিনি সংসারের চাপে করে উঠতে পারেননি। নতুন করে করতে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন। আবার যে মহিলাদের অফিসে বা অন্য কোনও কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়, তাঁরাও বাড়ি ফিরে সন্তানের শূন্য ঘরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, নয়তো একটা ভিডিও কলের আশায় থাকেন। ক্লান্তি ও সময় বাঁচিয়ে কিছু কাজে তাঁরাও যুক্ত করছেন নিজেদেরকে নির্মল আনন্দ পাওয়ার আশায়। এ তো গেল শহুরে পরিবারের কথা। গ্রামে চিত্র আলাদা। তাঁদের জীবন যাত্রা এমন ছকে বাঁধা, মেনোপজ নিয়ে হা-হুতাশ করার অবকাশ তাঁদের থাকে না। তবে তাঁদের চিন্তার জগৎ খুব ধীরে হলেও পাল্টাচ্ছে। কাজেই মেনোপজ কখনওই সমাপ্তির সঙ্কেত নয়। বরং বলা যায় সূচনার প্রারম্ভ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন