দোঁহা

পা আর জিভের গল্প

 


রক্তিম ভট্টাচার্য

এই যে উপস্থিত ভদ্রমহোদয়গণ, অথবা, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান, আমি একজন চাটুকার। মানুষজনের বা স্পেসিফিক্যালি, ক্ষমতাসীন মানুষের পা, বিশেষ ক্ষেত্রে অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চেটে বেড়ানো আমার পেশা। নেশাও বলতে পারেন। ভাবছেন কেন? তা এতে আর ভাবার কী আছে মশায়? নাকি, পান-চেবানো, খয়ের-চ্যাটকানো ভাষায় ‘মোহায়’ বলব? মোদ্দা কথাটা হল, পা চেটে বেড়ালে জীবনে আনন্দ পাওয়া যায়। আরো রদ্দিভাবে বললে, বেঁচে থাকার এই একমাত্র জীবনে চরম সুখ পাওয়া যায়। কোনও ঝগড়া নেই, অশান্তি নেই, ঝুট নেই, ঝামেলা নেই। পরম শান্তি! কে চায় না বলুন? যে জিনিসটা বড়বাজারে বা কোলে মার্কেটে লাখ টাকার আতশ কাচ দিয়ে খুঁজেও পাওয়া যাবে না কোনওদিন, সেই শান্তি যদি শুধুমাত্র পা চেটে পাওয়া যায়, ভালো লাগবে না কেন বলুন?

তাই আমি পা চাটি। এতে মনে শান্তি তো বটেই, পকেটও বেশ ভারী হয়। সস্তায় দু’পয়সা, বা লাখদুয়েকও হাঁকিয়ে নিতে পারি যখন তখন। কে বলে, বাজারে চাকরি নেই? কর্মসংস্থান নেই? আরে ভাই, মাথা উঁচু করে থাকতে চাও আর নীচু করে, জিভকে একটু কাজে লাগাও না ভাই। পেট কি তোমার কথা শোনে? তাহলে জিভ দিয়ে যদি একটু নিজের সুব্যবস্থা হয়, বঞ্চিত করা কেন নিজেকে? আমি এরকমই ভাবি। এটাই আমার আদর্শ। তাই আমি দল-মত-নির্বিশেষে পা চাটি। ভদ্র ভাষায় বললে, স্তাবকতা করি। মোসাহেবি করি। রাজনৈতিক দল? “দল-মত-নির্বিশেষ” মানে বোঝেন না? একটু আগেই তো বললাম। আমার একটাই দল, আর সে আমি নিজে আর আমার পকেট। পকেট খুশ তো দিল খুশ। দিল খুশ তো শরীর ভি খুশ। গার্ডেন গার্ডেন! আর কী চাই?

লোকে আমাকে বুঝতে পারে না। ভাবে, মেরুদণ্ড নেই। কেঁচোর মতো গুটিয়ে থাকি, ভয়ে খোলসে চুপসে যাই, তাই নাকি আমার এইসব ফন্দিফিকির। ধান্দাখোঁজা ঢোঁড়াসাপ। আরে শালা, খানিক ভয় পেয়ে, একটু নরমসরম হয়ে থেকে, যদি ভালো কলাটা মূলোটা বাগানো যায়, সেটা বুদ্ধিমত্তা নয়? প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধি তো তোদের ওই আর্টিস্টিক্যালি আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্সের থেকে শতগুণে ভালো। না হলে ব্যবসায়িক বুদ্ধি দাঁড়ায়? এই যে আমার এখন জিভভাড়া দেওয়ার ব্যবসা, আর তাতে যা টাকা ঢোকে ব্যাঙ্কে, তোদের কটার দম আছে তার ধারকাছ মাড়ানোর? উল্টে দরকারে আমার থেকেই নিস না? কাজের বেলায় আপনি-আজ্ঞে, আর কাজের শেষে ভিখ মাগে! ছোঃ!

এই, সরি সরি, ভুলেই গেছি, সামনে আপনারা আছেন। কথার তোড়ে কখন যে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ হয়ে ‘তুই’তে নেমে গেছি, হুঁশই নেই। এইজন্যই বলি, আমাকে এইসব সফিস্টিকেটেড জায়গায় ঘাড় ধরে মঞ্চে তুলে দেবেন না। আরে দাদা, আমি ওই ফেসবুকে লাইক-লাভ-কেয়ার, কমেন্টে ‘আহা-উহু’ করা, আর মঞ্চে উঠলে আমি সামান্য আমার মাইবাপ দাদা-দিদির প্রশংসা-করা পাবলিক। আমার কি আর এইসব বক্তিমে দেওয়া মানায়?

যাক গে, যা বলছিলাম! আমার এখন জিভ ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা। যেখানে পারি, মানে যেখানে সুযোগ আসে, মালিকের রেস্ত বেশি, সেখানে গিয়ে পায়ের ধুলো চেটে আসি। কেউ কেউ আবার দামী জুতো পরেন তো কেউ পাম্প শু। কেউ ফকিরের মতো খালি পা তো কেউ আবার হাওয়াই চটি। আমার চাটতে কোনও দ্বিধা নেই। টাকার হিসেব শুনি, কর ধরে গুনি, আর জিভ নিয়ে সোজা চ্যাকাচ্যাক! আমার দরুণ কত মানুষের সুবিধা হয়েছে, জানেন? একদম প্রকৃত সমাজসেবা, আর পকেটের আড়ে-বহরে কৃপা।

বটুকপুরের এম এল এ খগেন খাস্তগীর আমার জিভের আশীর্বাদের বহর জানেন। নির্বাচনী প্রচার শুরু হবে হবে, আর আমার বাড়িতে গাছপাকা আম, রসগোল্লা, আদ্দির পাঞ্জাবির প্যাকেট নিয়ে হাজির। কী? না, তাঁর হয়ে একটু জয়গান গাইতে হবে। ভোট-ভিক্ষা আর কী! তা করে দিলুম। দিব্যি ঠাটেবাটে থেকে কেমন করে খগেনের পো বিরোধীপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে গোটা গ্রামের পেটের ভাত জুগিয়েছে, হুকিং করে পরেশ পাইনের বাড়ির লাইন ঝেড়ে সারা এলাকার বিদ্যুৎ এনেছে, সরকারি জমিগুলো ছেলে লাগিয়ে বেদখল করিয়ে কৃষকের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছে-সব আওড়ে গেলাম। যে স্ক্রিপ্টটা আমায় দিয়েছিল, ঠিকঠাক প্রুফটা দেখেনি বলে দু’একটা বেমক্কা কথা বলে ফেলেছি বটে, তবে জনগণ মোটের ওপর গলে গেছে। এই দেখে, পরের টার্মে খগেনের বিরোধী বসুধা মিত্তির ফেমিনিজম না কী সব ইস্যু তুলে আমাকে এক রাত নারীহৃদয়ে দোদুল্যমান হয়ে শরীরমাত্রে বহুগামী হবার সুযোগ করে দিলেন। ব্যাস! খগেনের গুষ্ঠির পিণ্ডি চটকানো আমার বাঁয়ে হাত কা খেল! পার সন্ধ্যেয় বাড়িতে মদের আসর বসানো লোকসেবিকা বসুধা মিত্তির আমার জিভের ক্ষুরে তখন পিওর সাত্ত্বিক, আর খোলামকুচির মতো উড়তে থাকা নোট তখন দানছত্রের শরিক। মিটে গেল।

এরকমই একবার প্রখ্যাত সাহিত্যিক গজানন শিকদারের পা চেটে চেটে চামড়া খুইয়ে দিয়ে বিরোধী শিবিরের প্রমথেশ বাঁডুজ্জ্যের হাঁড়ির হাল করেছি, পরের বছর বইমেলার আগে সেই প্রমথেশের চেক ভাঙিয়ে ওর কাব্যগ্রন্থ পাক্কা চারটে সংস্করণ করিয়ে গজাননের গজদাঁত উপড়ে ফেলেছি। হারানো গরু হোক, আর সস্তার রুমাল, ফর্সা-চকচকে গার্লফ্রেন্ড হোক বা নকশা-কাটা পর্দার প্রকারভেদ- আমার জিভ আর ক্ষীরের পায়েস- ডেডলি কম্বিনেশন আর আয়েশ।

শুধু কেলোটা হল, নিজের বেলায়। আমার এমন পায়ের-ওপর-পা-তোলা চাকরি, অথচ সুবিধে করতে পারলাম না নিজের একেবারেই। জানেন মশায়, মাধ্যমিকে ইতিহাস বাদে সবেতে লেটার, আর হায়ার-সেকেন্ডারিতে সায়েন্স নিয়ে স্কুলে ফার্স্ট আমি। ইংলিশে অনার্স, ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে এম এ। পানু দেখার বয়সে আমার হাতে থাকত সত্যজিৎ-মৃণাল, বিড়ি-সিগারেটের বয়সে কাফকা-দেরিদা, আর হুইস্কির বয়সে কামু আর দস্তয়ভস্কি। কিন্তু লাভ কী? সেই তো একের পর এক ফর্ম ফিলআপ, আর কেরানির চাকরির জন্য জুতোর শুকতলা তুলে ফেলে দরখাস্ত। না, নিজের জন্য কাউকে তদ্বির করতে পারিনি। কেউ পাত্তাও দেয়নি। টাকার বিনিময়ে পেয়েছিলাম একটা স্কুলের দারোয়ানের চাকরি, শেষমেশ ওই বিবেক না কে একটা এসে নাকচ করে দিয়েছিল তখন।

ফাইনালি, কোভিডে মা-বাবা অস্তগামী হওয়ায় এই ব্যবসা। ভালো ব্যবস্থা না? তখন নিজের জন্যই চাটতে পারিনি, আর এখন পরের জন্য পরের পা-ই চাটি। আয়েশে থাকি, টাকা করি। শান্তির জাস্টিফিকেশনে আদর্শও বাঁচল, আর এই জিভের জোড়েই আজ এই কেরিয়ার কাউন্সেলিং-এর মঞ্চে ইন্সপিরেশনাল স্পিচ ঝেড়ে মোটা টাকা বাগিয়ে গেলাম। অগত্যা, কী দাঁড়াল? মাথার সম্মান বাঁচাতে চান, তো লড়ে যান। আর পেট বাঁচিয়ে টিকে থাকতে চান, তো চাটুন। চেটেই যান। নমস্কার।








একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন