নীলম সামন্ত
স্রোতশূন্য রক্তকরবী ফিরে যাচ্ছে মহাপ্রস্থানের দিকে। পথে ছড়ানো আদিম তত্ত্বচক্র।
ও মেয়ে তোমার যে বেলা ফুরিয়ে গেল। মনে পড়ছে নতুনজন্মের দিন, কাঠের বারান্দায় ঠায় শুয়েছিলে, গরম দুধে চুমুক দেবার পর সন্ধে নেমে আসত আর কত টিয়াপাখি, টকটকে লাল ঠোঁট। তোমার বিবর্ণ কাপড়ের দিকে কারও নজর ছিল না৷ মজলিস বসত মুখের সামনে। তুমি ঠায় তাকিয়ে থাকতে। টিয়াপাখি ছোঁয়া তোমার বারণ। ঘোড়ার পিঠে উঠতে না, গরুর পাশে দাঁড়াতে না, বিড়ালের দিকে তাকাতে না৷ তুমি তখন ঘোরলাগা বর্ষাবাদল। ও মেয়ে তোমার কি বেলা ফুরিয়ে গেল?
বেলা কি ফুরোয়? এক নিঃশ্বাসে যতবার জন্মায় কন্যা ততোধিক আত্মগোপন লিখে চলে তালপাতায়। গৃহিনীরা জানতে কিসের লিপি। কন্যা হাসে। নারী হাসে৷ হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে মোক্ষলাভ। আজ তবে কি লিখলে? ফুরনোর কথা নাকি নবরূপে ডালা সাজানোর গল্প? জানো তোমার রক্তপ্রবালে খানিকটা রক্ত এখনও লেগে৷ তুমি কি বিষন্ন? মুখের ওপর লাল সরে যাচ্ছে। গাঢ় সূর্যাস্তের তাপে যেন হঠাৎই পুড়ে গেল সমর্পণের অনুপাত। বিষন্নতায় ফুল ফোটাও। গমের ক্ষেতে দেখ এখনও শুয়ে আছে আধিভৌতিক পাইথন।
তুমি সমতল চেন, খুব ভালো করে জানো ষাঁড়াষাঁড়ি বাণ ডাকলে নিজেকে কতখানি আলগা করতে হয়। কত ঢেউ হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ে। তারপরেও নিজে স্থির থাক। ঝিনুক কুড়োবার অছিলায় ভিজে বালিতে হাত রেখে কুড়িয়ে তোলো বালিকা অধ্যায়৷ আজন্মের স্বমৈথুন।
তুমি কিন্তু হরিতকী নও। সুক্ষতার ভেতর জেগে থাকা ঈশ্বরকণা। অনেকদিন ছবি আঁকোনি। একবার দেখবে চেষ্টা করে। খুব সাধারণ একটা চোখ, নীল আই বল থেকে ঝরে পড়ছে বসন্তের নীলমণি। তলায় তোমারই ছায়া লাল বেনারসি খুলে জড়িয়ে নিচ্ছে ম্যাজেন্টা সিফন। আঁচল যেখানে ফুরিয়েছে সেখান থেকে উঠে গেছে আভিজাত্যের সিঁড়ি। ক্রমশ আবছা, ক্রমশ ধুসর, ক্রমশ মিশে যাওয়া। যেন পা বাড়ালেই নতুন সুর্যোদয়। প্রথম ধাপ ফুরোলেই নতুন জন্ম।
আচ্ছা কী ভাবছ বলতো? আমি কি তোমায় বুড়িয়ে যাবার পথে ঠেলে দিচ্ছি? না গো। তুমি যে শহরের আস্ত ট্রামলাইন। কত মানুষ বাড়ি ফেরে, কত ঘামের গন্ধ ঝেড়ে তুমি ঝকঝক করো। মেয়ে তুমি আবার কিসের বৃদ্ধা? আমি তো তোমায় একজন্মে বহুজন্মের গল্প শোনাচ্ছিলাম। এই তো আর একটু পরেই সকাল হবে। তুমিও জেগে উঠবে আবার। কত ভিড়ের মধ্যে জমা করবে নতুন বেড়ে ওঠার গল্প। কয়েক বছর পর এসো। আজ আমি বললাম সেদিন তুমি বলো।
.
.