অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সূত্রপাত
ডাকঘর (১৯১২)
মুক্তধারা (১৯২১)
রক্তকরবী (১৯২৬)
পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলী অনুসারে তিনটি নাটকের রচনাকাল। সেই হিসেবে দেখলে ডাকঘর ও মুক্তধারা নাটকের শতবর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে। রক্তকরবী শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। কেবল, ‘শতবর্ষে রক্তকরবী’ একথা উল্লেখের সময় এখনও আসেনি। অথচ, অন্য একাধিক সূত্র বলছে ১৩৩০ বঙ্গাব্দে শিলং পাহাড়ে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবীর প্রথম খসড়াটি লেখেন। সেসময়ে তিনি সে নাটকের নাম দেন ‘যক্ষপুরী’। কালক্রমে পরিমার্জিত হয়ে সেই ‘যক্ষপুরী’ থেকেই ‘রক্তকরবী’র জন্ম। সেই হিসেবে ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-সমীপে দাঁড়িয়ে একথা বলাই যায়, আমাদের নন্দিনী-রঞ্জনের উপাখ্যান আজ একশো বছর পেরুল। এখনও সে নাটক সমান প্রাসঙ্গিক।
প্রাসঙ্গিক হলেও কিছু অপ্রিয়ভাষণেই বরং আলোচনার সূত্রপাত ঘটুক। ২০১২ সালে বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশ কারনাডের একটি বক্তব্য ঘিরে বাঙালী ‘বুদ্ধিজীবী’ মহলে আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। আধুনিক নাট্যকার গিরিশ স্পষ্ট উচ্চারণে জানিয়েছিলেন, “কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয়, কিন্তু নাট্যকার হিসেবে তিনি একেবারেই মধ্যমেধার সমতুল একজন প্রতিনিধি, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাট্যরচয়িতা।” গিরিশ আরও বলেছিলেন, “তিনি (রবীন্দ্রনাথ) নিজেই স্বরচিত নাটকগুলির প্রযোজনা করেছিলেন, সমসাময়িক কলকাতার নাট্যগোষ্ঠীগুলি কখনই রবীন্দ্র-নাটক প্রযোজনায় উৎসাহ বোধ করেনি।” এতখানি স্পষ্টতা রবীন্দ্রনাথের প্রাপ্য কিনা জানিনা, তবে বাঙালী অস্মিতায় এই বক্তব্যের কারণে যারপরনাই আঘাত পড়েছিল। এখন সেই আঘাতপ্রাপ্তদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাইব, স্বাধীনতার অনেক পরবর্তীতে বিশিষ্ট নাট্যগোষ্ঠীগুলির মধ্যে শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় ‘বহুরূপী’ প্রথম ‘ডাকঘর’, ‘রক্তকরবী’ ও অন্যান্য রবীন্দ্র-নাটক প্রযোজনার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সময়েও কিন্তু ‘রাজনৈতিক ভাবাদর্শে উজ্জীবিত’ বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ, ‘আবার বুর্জোয়া রবীন্দ্রনাথ কেন!’ এমন প্রতিক্রিয়াতেই নিজেদের প্রকাশ করেছিলেন। স্বদেশী নাটক বলতে মূলত পুরাণ-আশ্রিত সংস্কৃত নাটক, গ্রীক নাটক, অথবা সরাসরি রাজনৈতিক নাটক ও বিশেষত বিদেশ থেকে আমদানি করা আধুনিক নাট্যের প্রযোজনাতেই কলকাতার নাট্য-নির্দেশক অথবা নাট্য-রচয়িতারা বহুকাল যাবৎ নিজেদের ব্যস্ত রেখেছিলেন। এখনও যদি কলকাতা শহরে নিয়মিত অভিনয় হতে থাকা বিভিন্ন সমকালীন প্রযোজনাগুলির বিষয়ে দেখা যায়, তাহলেও বোধ করি তিলোত্তমার নাট্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অথবা দেশজ-লৌকিক নাটকের প্রতি বিরাট প্রেম পরিলক্ষিত হবে না।
এই প্রসঙ্গে কি তাহলে কলকাতার ‘বুদ্ধিজীবী, নাট্যকর্মী’দেরই আসামীর কাঠগড়ায় তোলা উচিত? নাকি সত্যি করেই নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের মান-অবদান-সৃজনক্ষমতারও গুণগত ও গাণিতিক বিচার করা উচিত? গাণিতিক, অথবা সেই ক্ষেত্রে সহজ ভাষায় লিখলে রবীন্দ্র-নাটকের ‘টেকনিক্যাল’ অথবা ‘অবজেক্টিভ’ বিচার লেখকের পক্ষে অসাধ্য। কারণ তুলনামূলক নাট্যশাস্ত্র লেখকের অধীত বিষয় নয়। সেক্ষেত্রে যদি গুণগত বা ‘সাবজেক্টিভ’ (ভিন্ন শব্দচয়নে ‘কোয়ালিটেটিভ’) বিচারের দিকে যাওয়া যায়, তবুও একথা স্বীকার করা উচিত আধুনিক ‘প্রোসেনিয়াম’ থিয়েটারের দিক থেকে দেখলে রবীন্দ্র-নাটক অনেক বেশি ভাবে রূপকাশ্রয়ী এবং ‘রবীন্দ্র’-নাটক বলেই তার প্রাথমিক জনপ্রিয়তা।
রবীন্দ্র-কবিতার ক্ষেত্রেও স্বয়ং কবি বুদ্ধদেব বসুর মত অনুসারে, বাংলা ভাষাকে গড়ে তুলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে অপরিসীম পরিশ্রম করেছিলেন, সেই অমূল্য সময় নষ্ট না করে তিনি যদি শুধুই কাব্যচর্চা করতেন তাহলে হয়তো আরও পরিণত, আরও কিছু বিশিষ্ট, সুন্দর, কালজয়ী কবিতা ও ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’কে আমরা পেতে পারতাম। কিন্তু সামগ্রিক বাংলা ভাষা সেই কারণে এক অমূল্য বিবর্তনের পথ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকত। (সূত্রঃ ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘সব পেয়েছির দেশে’, বুদ্ধদেব বসু)
আলোচনার শুরুতেই নাট্যকার রবীন্দ্রনাথকে যে এমন খানিক সমালোচনার ভঙ্গিতেই কিঞ্চিত নস্যাৎ করতে চাইলাম, মজার বিষয় হল পাঠকজনের মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে সেই বিশেষ পদ্ধতিটিকেও আমাদের শিখিয়েছেন গুরুদেব স্বয়ং। প্রমাণ হিসেবে,
...আমাদের মণিভূষণ চশমার ঝলক লাগিয়ে প্রশ্ন করলে, “সাহিত্য থেকে লয়ালটি উঠিয়ে দিতে চান?”_
_“একেবারেই। এখন থেকে কবি-প্রেসিডেণ্টের দ্রুতনিঃশেষিত যুগ। রবি ঠাকুর সম্বন্ধে আমার দ্বিতীয় বক্তব্য এই যে, তাঁর রচনারেখা তাঁরই হাতের অক্ষরের মতো–গোল বা তরঙ্গরেখা, গোলাপ বা নারীর মুখ বা চাঁদের ধরনে। ওটা প্রিমিটিভ; প্রকৃতির হাতের অক্ষরের মক্শো-করা। নতুন প্রেসিডেণ্টের কাছে চাই কড়া লাইনের, খাড়া লাইনের রচনা– তীরের মতো, বর্শার ফলার মতো, কাঁটার মতো; ফুলের মতো নয়, বিদ্যুতের রেখার মতো। ন্যুর্যালজিয়ার ব্যথার মতো। খোঁচাওয়ালা, কোণওয়ালা, গথিক গির্জের ছাঁদে; মন্দিরের মণ্ডপের ছাঁদে নয়। এমন-কি, যদি চটকল, পাটকল, অথবা সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিঙের আদলেও হয়, ক্ষতি নেই। ...এখন থেকে ফেলে দাও মনভোলাবার যত ছলাকলা, ছন্দোবন্ধ উপকরণ, মন কেড়ে নিতে হবে, যেমন করে রাবণ সীতাকে কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। মন যদি কাঁদতে কাঁদতে, আপত্তি করতে করতে যায়, তবুও তাকে যেতেই হবে–অতিবৃদ্ধ জটায়ুটা বারণ করতে আসবে, তাই করতে গিয়েই তার হবে মরণ। তার পরে কিছুদিন যেতেই কিষ্কিন্ধ্যা জেগে উঠবে, কোন্ হনুমান হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে লঙ্কায় আগুন লাগিয়ে মনটাকে পূর্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসবার ব্যবস্থা করবে। তখন আবার হবে টেনিসনের সঙ্গে পুনর্মিলন, বায়রনের গলা জড়িয়ে করব অশ্রুবর্ষণ; ডিকেন্স্বকে বলব, মাপ করো, মোহ থেকে আরোগ্যলাভের জন্যে তোমাকে গাল দিয়েছি। ...মোগল বাদশাদের কাল থেকে আজ পর্যন্ত দেশের যত মুগ্ধ মিস্ত্রি মিলে যদি যেখানে-সেখানে ভারত জুড়ে কেবলই গম্বুজওয়ালা পাথরের বুদ্বুদ্ বানিয়ে চলত তা হলে ভদ্রলোক মাত্রই যেদিন বিশ বছর বয়স পেরোত সেইদিনই বানপ্রস্থ নিতে দেরি করত না। তাজমহলকে ভালো-লাগাবার জন্যেই তাজমহলের নেশা ছুটিয়ে দেওয়া দরকার।”_
[সূত্রঃ শেষের কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
তাজমহলকে ভালো-লাগাবার জন্যই তাজমহলের নেশা ছুটিয়ে দেওয়া দরকার। আধুনিক ‘প্রোসেনিয়াম’ থিয়েটারের বিচারে রবীন্দ্র-নাটক, নাটকের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য কিনা সে বিচারের অন্য পরিসর রয়েছে। কিন্তু রূপকাশ্রয়ী নাটক হিসেবে গড়ে উঠলেও, রবীন্দ্রনাথের একেকটি নাটক যে বহুবর্ণী আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়, রক্তকরবী তারই সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।
।। নাটক রক্তকরবী ।।
এই আলোচনার শুরুতে ক্রমানুসারে তিনটি নাটকের নাম করে এসেছি। ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্র-নাটকগুলির ক্ষেত্রে সেই তিনটিই গুণগত দিক দিয়ে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি, তদুপরি রক্তকরবী-বিষয়ক আলোচনায় বিশেষ এই ক্রমানুসারের উল্লেখ প্রয়োজন ছিল। ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ লেখেন ডাকঘর, ১৯১৭তে যার প্রথম অভিনয় হয়। ১৯২১এ মুক্তধারা, ১৯২৪-২৬এর মধ্যবর্তী সময়ে একাধিক খসড়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় রক্তকরবী। ডাকঘর নাটকের বিষয়বস্তু জরা-মৃত্যু-দুঃখকে অতিক্রম করে এক শিশুর সারল্যে জীবনোৎযাপন। সমস্ত ধরণের অন্ধকারকে উপেক্ষা করে পৃথিবীর সৌন্দর্য তথা প্রকৃতিকে উদযাপন। মুক্তধারায় উঠে আসে বিশেষ ভাবে যান্ত্রিক সভ্যতার বিরুদ্ধে কবির মানবিক প্রতিবাদ। মুক্তধারার স্রোতকে রুদ্ধ করার বিপরীতে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ-আন্দোলন। ডাকঘরের ক্ষেত্রে রূপকের মূর্ততা অনেক বেশি প্রকট। মুক্তধারায় সাধারণ মানুষ, জনপদবাসের বৃত্তান্ত উল্লেখ করা হলেও, সেখানে রূপক-প্রভাব রয়েছে। তবে ডাকঘরের তুলনায় সেই রূপক-ভাব অনেকাংশে স্তিমিত। এর পরবর্তীতে রক্তকরবীর সৃষ্টি। সেখানে যান্ত্রিক সভ্যতা, বর্ণনায় অনেকখানি বিস্তৃত হয়ে রূপ নিয়েছে অমানবিক বস্তুতান্ত্রিক পৃথিবীর। তার বিপরীতে মানুষের মনুষ্যত্বকে সজীব করে তুলতে মূর্ত হয়ে উঠেছে বিশুপাগলের চরিত্র অথবা নন্দিনী-রঞ্জনের প্রেমাখ্যান। এই প্রেম কেবল মানব-মানবীর প্রেমের সঙ্গে সমতুল বলে ভাবলে ভুল করা হবে। যেমনটা ভুল করা হয় ডাকঘরে, অন্তিমদৃশ্যে অমলের মৃত্যুকেই প্রাথমিক সত্য বলে যদি মনে করা হয়। অমলের মৃত্যুর চেয়েও তার চিরন্তন সত্ত্বার জন্ম অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি অমলের মৃত্যু রবীন্দ্রনাথ যত না তুলে ধরতে চেয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি করে তুলে ধরতে চেয়েছেন সত্ত্বা অমলের চিরকালীন অমরত্বকে। একইভাবে নন্দিনী-রঞ্জনের প্রেম, আদতে প্রকৃতি-পুরুষ তথা প্রকৃতি ও মানবতার যে সম্পর্ক, বস্তুতান্ত্রিক পৃথিবীর বিপরীতে সেই সজীবতাকেই সে রূপকের আশ্রয়ে তুলে ধরতে চায়। বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতা সেই সজীবতাকে কলুষিত করে। তাকে পিষে মারতে চায়। তাই রঞ্জনের মৃত্যু। কিন্তু রঞ্জন সেই সজীবতার ধারক মাত্র। নন্দিনীর মাধ্যমেই সেই সজীবতার উৎসারণ। কাজেই ধারকের মৃত্যু হলেও বীজ রয়ে যায়। বীজ থেকে যায়। আর বস্তুতান্ত্রিক পৃথিবীর বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক স্তরে আটকে পড়া মানুষ, তাদেরই প্রতিনিধিস্বরূপ রাজা, অধ্যাপক, সর্দার অথবা বিশুপাগলের মতো চরিত্রেরা একেকজন সেই বীজের আঘ্রাণ খোঁজে। সেই বীজের সজীবতাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। প্রজন্মোত্তরে বহন করতে চায়।
এ তো গেল রূপক-ভাবাশ্রয়ের কথা। বদলে যদি আরেকটু বস্তুতান্ত্রিক বিশ্লেষণে নেমে আসতে চাই? ১৯১৬তে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘ঘরে-বাইরে’র প্রকাশ। ১৯২১এ মুক্তধারা’র রচনা। দুই রচনার ক্ষেত্রেই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে কিঞ্চিৎ স্মরণ করা জরুরী। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন, স্বদেশী নবজাগরণ (১৯০৫-১৯১১) ও তার পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলন (১৯২১), প্রতিটি ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছিলেন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতা। ঘরে-বাইরে’র সংলাপে রবীন্দ্রনাথের যে উচ্চারণ, “নেশার দ্বারা কোনও মহৎ কাজ হয় না,” পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনের সময়েও চরকার নেশায় উন্মত্তপ্রায় দেশপ্রেমের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের কলমে শোনা গিয়েছিল সমালোচনার স্পষ্টতা। সরাসরি গান্ধীজীর উদ্দেশ্যে বার্তা-প্রেরণের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ্যে গান্ধীর এই চরকা-নীতির বিরোধিতা করেছিলেন। কবির সহজ বক্তব্য ছিল অনুৎপাদক শ্রমদানের মাধ্যমে সময় নষ্ট করে, নেশাগ্রস্ততার মাধ্যমে মনকে কার্যত বলপূর্বক এক আচ্ছন্নতার মধ্যে দিয়ে আন্দোলনের পথে চালিত করে দীর্ঘমেয়াদী ও গঠনমূলক উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। সমকালীন সংবাদপত্রগুলিও তখন কবির এই অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, গান্ধীর পক্ষ নিয়ে কবিকে নীচ ব্যক্তি-আক্রমণে বিধ্বস্ত করে। যদিও গান্ধী নিজে কবির এই সমালোচনাকে শিরোধার্য করেন, এবং ভিন্নমত পোষণ করলেও কবির সঙ্গে মহাত্মার সেই সময়ের যে কথোপকথন, তা সবসময়েই আদর্শের বৈপরীত্য ও তদবিষয়ক আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে। কোনও ব্যক্তিগত অসূয়ার সেখানে উল্লেখ মেলে না। (সূত্রঃ ‘The Mahatma and the Poet’, Compiled and Edited by Sabyasachi Bhattacharya, National Book Trust)
অর্থাৎ, গুরুদেব কিন্তু গান্ধী-মহারাজের মতো যান্ত্রিক সভ্যতার ব্যবহারিক গুরুত্বকে কখনই অস্বীকার করতে পারেননি। বরং অহেতুক ভাবালুতা ও নেশাগ্রস্ততা তাঁর আপত্তির কারণ ছিল। পরবর্তীতে ‘রাশিয়ার চিঠি’র মতো একাধিক রচনায়, সর্বোপরি বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতনের শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থকরী শিক্ষার গুরুত্ব স্থাপন করতে গিয়ে একাধিক বিশেষ পাঠ্যক্রম সৃষ্টি, এই সবকিছুর মাধ্যমে ‘যান্ত্রিক সভ্যতা অমানবিক’ – গান্ধীর এহেন বক্তব্যের বিপরীতে গিয়ে ব্যবহারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ও তদুপরি তার অর্থনৈতিক গুরুত্বকে সম্পূর্ণ স্বীকার করে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান ও যন্ত্রের প্রতিই তাঁর সমর্থন জানান। তাহলে, সেই একই সময়ে দাঁড়িয়ে অসহযোগ আন্দোলনের বছরেই, কেনই বা তিনি মুক্তধারা লিখলেন, অথবা রক্তকরবীর মাধ্যমে কেনই বা যান্ত্রিক সভ্যতার বিরুদ্ধে বার্তা দিতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ?
এখানেই রবীন্দ্রনাথের রূপকের গভীরতা। মুক্তধারায় ‘যান্ত্রিক’ বিষয়টি অনেক বেশীমাত্রায় প্রকট, রক্তকরবীতে গিয়ে বরং রবীন্দ্রনাথের যন্ত্র ও মানবতার সম্পর্ক-বিষয়ক দর্শনটি সম্পূর্ণতা লাভ করে। যন্ত্রের চেয়েও রবীন্দ্রনাথ বস্তুতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন করতে চেয়েছিলেন। বিজ্ঞানের গর্বে অন্ধত্ববরণ করে প্রকৃতির স্বাভাবিকত্বকে রুদ্ধ করতে চাওয়ার বিরুদ্ধে তিনি মুক্তধারায় বার্তা দিয়েছিলেন। রক্তকরবীতে গিয়ে আরও বিস্তৃত ভঙ্গিমায় তিনি ভারসাম্য বজায় রাখার কথা বলেছিলেন। ধনের লালসায় অন্ধ হয়ে গিয়ে সেই ধনেরই সন্ধানে নিজেদের মনুষ্যত্ব, তথা মননশীলতাকেই বিকিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন করতে চেষ্টা করেছিলেন। রক্তকরবীতে নন্দিনী-রঞ্জন-বিশুপাগলের লড়াই ধনের বিরুদ্ধে, ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে। সেই ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি কেবল রাজা একলা নয়। সেই ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি সেই ধনের আকর্ষণে, সোনার আকর্ষণে আটকে পড়া সবাই। রক্তকরবীতে সোনার তাল গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ সেই সোনার তাল খোদাই করতে থাকার যে নেশাগ্রস্ততা, সেই আচ্ছন্ন অবস্থা – যে অবস্থায় সাধারণ, সুবিধা পেতে চাওয়া মানুষ, দুর্বার আকর্ষণে খেটে চলতে চায়। এই গভীরতাই রবীন্দ্রনাথের রূপক-নাট্যকে চিরকালীন করে তোলে। আজকের সময়ে এনে দাঁড় করায়। যে সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা পাঁচদিন-নয়ঘণ্টার হিসেবে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলি। সপ্তাহান্তে কাঞ্চন-অর্থের বিনিময়ে সময়ের বহমানতাকেই আরও কোনও নেশার উদযাপনের মাধ্যমে ভোগ করতে চাই। সেই নেশা হয়তো খাদ্য-পানীয়, ভ্রমণ অথবা আরও সৃজনশীল কোনও কিছুরও উদযাপন হতে পারে। কিন্তু তবুও সেই উদযাপন নেশাগ্রস্ততারই সমতুল। সপ্তাহান্ত ফুরলে আমরা আবারও সারা সপ্তাহের পেশাগত-নেশাগ্রস্ততায় ঢুকে পড়তে চাই, পরবর্তী সপ্তাহান্তের নেশার খরচ তোলবার প্রয়োজনেই। এক অদ্ভুৎ বৃত্তীয় চলন। অনেক রাত্তিরে তখন, হঠাৎই হয়তো আমরা একেকজন, রক্তকরবীর সেই রাজ-সংলাপের মতোই উচ্চারণ করতে চাই,
_“বুঝতে পারবে না। আমি প্রকাণ্ড মরুভূমি – তোমার মতো একটি ছোট্ট ঘাসের দিকে হাত বাড়িয়ে বলছি, আমি তপ্ত, আমি রিক্ত, আমি ক্লান্ত। তৃষ্ণার দাহে এই মরুটা কত উর্বরা ভূমিকে লেহন করে নিয়েছে, তাতে মরুর পরিসরই বাড়ছে, ঐ একটুখানি দুর্বল ঘাসের মধ্যে যে প্রাণ আছে তাকে আপন করতে পারছে না।”_
অথচ আমাদের জীবনে নন্দিনীর হদিস মেলে না। নাকি আমরাই বোধহয় নারীরূপে, পার্থিব প্রেম রূপে নন্দিনীর সন্ধান করতে যাই বলেই নাগাল মেলে না তার?
দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ। চিরকালীন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর রূপকাশ্রয়ী নাটকই সমকাল ও ভাবীকালকে পথ দেখায়।
…সমকাল জুড়েও বা কতখানি ব্যাপ্তি ছিল তাঁর? তথ্য বলছে, নাৎসি বাহিনীর আক্রমণে যে রাত্তিরে প্যারিসের পতন হয়, রেডিও প্যারিসের তরফে জাতীয় সাহিত্যিক অঁদ্রে জিদকে প্যারিসে বসবাসকারী জনতার মনোবল অটুট রাখতে কোনও একটি উপযুক্ত সাহিত্যকীর্তি পাঠ করে শোনাতে অনুরোধ করা হয়। পশ্চিমের সাহিত্যিক অঁদ্রে জিদ সেদিন বেছে নিয়েছিলেন নাটক ডাকঘর। রচয়িতা প্রাচ্যের রবীন্দ্রনাথ। এখানেই শেষ নয়। তথ্য বলছে, একাধিক সূত্র থেকে পাওয়া ইতিহাস অনুসারে, নাৎসি-জমানার কনসেন্ট্রেশন বন্দিশিবিরগুলিতে বন্দি ইহুদীদের উদ্যোগে একশোবারেরও বেশী যে নাটকটি অভিনীত হয়েছিল তারও নাম ডাকঘর। রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর রক্তকরবীর ইতিহাস? এই উপলব্ধি খানিক ব্যক্তিগত অনুভব। তবুও আজ সেটি ভাগ করে নিতে চাইব।
মনে মনে কল্পনা করুন, নাৎসি বন্দীশিবির। শিবিরের একপ্রান্তে আকাশ-ছুঁতে-চাওয়া এক চিমনিযুক্ত ঘর। তারও আগে লম্বাটে ব্যারাক। নগ্ন, রুগ্ন, বীভৎস কিছু মানব-অবয়ব আচ্ছন্ন ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে। তাদেরও এককালে মানুষ পরিচয় ছিল। এখন নেই। তাদের চোখ কোটরে ঢুকে যাওয়া, দেহে একখণ্ড বস্ত্র নেই, সমস্ত শরীরে ময়লা, নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে, গ্যাস চেম্বার ও সবশেষে গণচুল্লির আগুনে ঝলসিয়ে যাবার অবশেষ-মুহূর্তের দিকে, তাদের একেকটি পদক্ষেপ। সামান্য পদস্থলন হলেই পেয়াদাদের বেটন। দাঁত বের করে তেড়ে আসা এ্যালসেশিয়ন। ‘শিণ্ডলার্স লিস্ট’ অথবা ‘বয় ইন দ্য স্ট্রাইপড পাজামাস’এর মতো যে কোনও বিশ্বযুদ্ধ-বিষয়ক সিনেমার সাধারণ কিছু দৃশ্যের একেকটি মূর্ত ফ্রেম। কাট টু – রক্তকরবী, রবীন্দ্রনাথঃ
-নন্দিনী। চেয়ে দেখো, ও কী ভয়ানক দৃশ্য! প্রেতপুরীর দরজা খুলে গেছে নাকি! ঐ কারা চলেছে প্রহরীদের সঙ্গে? ঐ-যে বেরিয়ে আসছে রাজার মহলের খিড়কি-দরজা দিয়ে?_
-সর্দার। ওদের আমরা বলি ‘রাজার এঁটো’।_
-নন্দিনী। মানে কী?_
-সর্দার। মানে একদিন তুমিও বুঝবে, আজ থাক্।_
-নন্দিনী। কিন্তু এ-সব কী চেহারা! ওরা কি মানুষ! ওদের মধ্যে মাংসমজ্জা মনপ্রাণ কিছু কি আছে!_
-সর্দার। হয়তো নেই।_
-নন্দিনী। কোনোদিন ছিল?_
-সর্দার। হয়তো ছিল।_
-নন্দিনী। এখন গেল কোথায়?_
-সর্দার। বস্তুবাগীশ, পার তো বুঝিয়ে দাও, আমি চললুম।_
-নন্দিনী। ও কী, ঐ-সব ছায়াদের মধ্যে যে চেনা মুখ দেখছি। ঐ তো নিশ্চয় আমাদের অনুপ আর উপমন্যু। অধ্যাপক, ওরা আমাদের পাশের গাঁয়ের লোক। দুই ভাই মাথায় যেমন লম্বা গায়ে তেমনি শক্ত, ওদের সবাই বলে তাল-তমাল। আষাঢ়-চতুর্দশীতে আমাদের নদীতে বাচ খেলতে আসত। মরে যাই! ওদের এমন দশা কে করলে? ঐ-যে দেখি শক্লু, তলোয়ারখেলায় সব্বার আগে পেত মালা। অনূ—প, শক্লু—, এই দিকে চেয়ে দেখো, এই আমি, তোমাদের নন্দিন, ঈশানীপাড়ার নন্দিন। মাথা তুলে দেখলে না, চিরদিনের মতো মাথা হেঁট হয়ে গেছে। ওকি, কঙ্কু যে! আহা, আহা, ওর মতো ছেলেকেও যেন আখের মতো চিবিয়ে ফেলে দিয়েছে। বড়ো লাজুক ছিল; যে-ঘাটে জল আনতে যেতুম, তারই কাছে ঢালু পাড়ির ’পরে বসে থাকত, ভান করত যেন তীর বানাবার জন্য শর ভাঙতে এসেছে। দুষ্টুমি করে ওকে কত দুঃখ দিয়েছি। ও কঙ্কু, ফিরে চা আমার দিকে। হায় রে, আমার ইশারাতে যার রক্ত নেচে উঠত, সে আমার ডাকে সাড়াই দিলে না। গেল গো, আমাদের গাঁয়ের সব আলো নিবে গেল! অধ্যাপক, লোহাটা ক্ষয়ে গেছে, কালো মরচেটাই বাকি! এমন কেন হল!_
-অধ্যাপক। নন্দিনী, যে দিকটাতে ছাই, তোমার দৃষ্টি আজ সেই দিকটাতেই পড়েছে। একবার শিখার দিকে তাকাও, দেখবে তার জিহ্বা লকলক করছে।
ক্ষমতার মদমত্ততা, ধনতন্ত্রের নেশাগ্রস্ততা আমাদের এমনই একেকটি সামাজিক, শ্বাসরোধকারী, চিরকালীন গ্যাসচেম্বারের দরজার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়। রক্তকরবী সেই চিরকালীন ভবিষ্যতেরই অকাট্য লিখিতরূপ। একশো বছর পেরিয়েও যা সমানভাবে অতীত, সমকাল ও অনাগত আগামীকেও দর্পণে প্রত্যক্ষ করাতে চায়।