মালবিকা মিত্র
প্রহ্লাদ পাত্র, পরেশ নিয়োগী, লালজি প্রসাদ সাউ এমন নজন মজুরের কথা মনে আছে? যারা ১৯৯২ সালের ২০ শে জুলাই, ব্রেথওয়েট কারখানার ব্লাস্ট ফার্নেস বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছিলেন। চাসনালায় কয়লা খনির গর্ভে আটকে পড়া শ্রমিকের প্রকৃত সংখ্যার তো কোন হিসেবই নেই। সেই ঘটনা আজ ইতিহাস। আর হাল আমলে উত্তরকাশিতে আটকে পড়া ৪১ জন মজুরের সপরিবার উৎকণ্ঠা তো জলজ্যান্ত স্মৃতি। প্রতি নিয়তই নির্মাণ শিল্পে ছাদ ভেঙে পড়া, ক্রেন ভেঙে পড়া, বিমের তলায় চাপা পড়া, আকছার ঘটনা। কথাগুলো বলছি বিগত ২০/৩০ বছরের ঘটনা। এসব ঘটনায় যতই বেদনাবোধ করে থাকি না কেন, একবারও মনে হয়নি যে এগুলো তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার অনিবার্য প্রোডাক্ট, বাই প্রোডাক্ট নয়। তবে কি শিল্প হবে না? এই প্রশ্ন তুলে এই সমস্ত ঘটনাকে "কো লেটারাল ড্যামেজ" হিসেবেই ভাবতে চেয়েছি।
শতবর্ষ পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠিক এমনটাই দেখেছিলেন। "ওই তো, নিশ্চয়ই আমাদের অনুপ আর উপমণ্যু। ওরা আমাদের পাশের গাঁয়ের লোক, দুই ভাই, মাথায় যেমন লম্বা গায়ে তেমনি শক্তি। ওদের সবাই বলে তাল তমাল। আষাঢ় চতুর্দশীতে আমাদের নদীতে বাইচ খেলতে আসতো। মরে যাই, এদের এমন দশা কে করল! ওই যে দেখি শকলু, তলোয়ার খেলায় সবার আগে পেত মালা। অ-নুপ, শ-কলু, এই দিকে চেয়ে দেখো, এই আমি, তোমাদের নন্দিন, ঈশানি পাড়ার নন্দিন। -মাথা তুলে দেখলে না। চিরদিনের মত মাথা হেঁট হয়ে গেছে। ও কী, কঙ্কু যে। আহা, ওর মতো ছেলেকেও যেন আখের মত চিবিয়ে ফেলে দিয়েছে । বড় লাজুক ছিল, হায়রে আমার ডাকে সাড়াই দিলে না। গেল গো, আমাদের গাঁয়ের সব আলো নিভে গেল।" এতো যেনো আজকের কথা।
আসলে আমরা ভারতীয়রা, বলা ভালো উপনিবেশিক দেশগুলি, দীর্ঘকাল উপনিবেশ থাকার ফলে সামাজিক বিবর্তনের ছক মডেল হিসেবে পশ্চিমের "লিনিয়ার মেথডলজি" কে অন্ধের মতো অনুসরণ করতে অভ্যস্ত। প্রভুর মানদণ্ডে যা কিছু পরিমাপ করি। ফলে শিল্পকে বাদ দিয়ে কোন উন্নতি, উন্নয়ন বা সভ্যতার কথা ভাবতেই পারি না। ফলতঃ পুঁজিবাদ ও ধনতন্ত্র একটি উন্নততর সংগঠন হিসেবে বৈধতা পেয়ে গেছে। আমরা ভুলে গেছি যে উপনিবেশগুলির পুঁজিবাদ ও শিল্প সভ্যতা এসেছে এমন সময়ে যখন পশ্চিমে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ জরাগ্রস্ত রূপ, সাম্রাজ্যবাদের যুগ। অর্থাৎ এক বিকৃত শিল্প সভ্যতা, যেটা উন্নয়ন হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। ইউরোপের সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণ পর্বে, কার্ল মার্কসের চোখে যা ছিল উন্নয়ন ও প্রগতি, সেটাই সাম্রাজ্যবাদী অবক্ষয়ের যুগেও আমরা যান্ত্রিকভাবে বিশ্বাস করেছি। সব সত্যই একটি যুগ সত্য, সেটা ভুলে গেছি। তাছাড়া ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের যে ভয়ংকর নির্মম রূপটি কাল মার্কস দেখেছিলেন, ভারতীয় পটভূমিতে সেটি অনুপস্থিত।
একথা ঠিক, পুঁজিবাদ উৎপাদন ব্যবস্থাকে এক সামাজিক ও কসমোপলিটন চরিত্র দান করেছে। তাই কার্ল মার্কস এটাকে সামাজিক প্রগতি হিসেবে দেখেছেন।"
it replaces the isolation of the labourers by their revolutionary combination". কিন্তু মার্কস এর পরেও লক্ষ্য করেছেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে শ্রম বিভাজন, বিশেষীকরণ ইত্যাদির কারনে স্রষ্টা সমগ্র সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে উৎপাদনের সঙ্গে তার একটা এলিয়েনেশন বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। আধুনিক সভ্যতার শিল্পীরা হলেন মজুর। সমগ্র সৃষ্টি কর্মের একটি ক্ষুদ্রাংশ সে পুনরাবৃত্তি করে চলে। মডার্ন টাইমস এ কারখানার কথা ভাবুন, যে মজুর নাট আঁটছে, সারা জীবন সে নাটই আঁটছে। সমগ্র সৃষ্টি থেকে সে বিচ্ছিন্ন। সে জানে না কে এটার ভোক্তা। ভোক্তাও জানেনা কে স্রষ্টা। স্রষ্টারা কতগুলি সংখ্যা ও চিহ্ন, ১০/২৫/খ হিসেবে পরিচিত। ভোক্তা জানে কোম্পানির নাম। মজুর এখন আর গান গাইতে গাইতে সৃষ্টির সুখে মেতে ওঠেনা। সৃষ্টির আনন্দযজ্ঞ নেই, গান নেই, আছে দীর্ঘশ্বাস। একরাশ বিষাদ, বিচ্ছিন্নতা আছে। ক্ষমতাধর শুধু এদের শ্রমকে নিঙড়ে নেয় না, এদের শক্তি সামর্থ্য প্রাত্যহিক যাপন ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা সবের উপর আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। মুক্ত বিহঙ্গের জল জমি জঙ্গল মুক্ত আকাশ সব নিয়ে যায়। পালোয়ানের মতোই ফাগুলাল, চন্দ্রা, গোকুল, বিশু পাগল কত না মুখ। ওই সব ছায়া দের মধ্যে চেনা মুখের সারি। নন্দিনীর অধ্যাপক বলেন, "সব জিনিসকে টুকরো করে আনা ও জানাই এদের পদ্ধতি।"
এই মজুররা খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনের রাইচরণ, এরা নিজেদের সৃষ্টি থেকে স্রষ্টা হয়েও বিযুক্ত। শিল্পীর সুখ্যাতি এদের জীবনে নেই। গ্রামে মদন তাঁতির যে সুনাম, তাও এখন নেই। এখান সকলেই মজুরি শ্রমিক হিসেবে পরিচিত। অসম্ভব অবাস্তব সম্পর্কে প্রবাদে আছে "সূর্য যেদিন পশ্চিমে উঠবে"। আর মদন তাঁতির গ্রামে প্রবাদ ছিল "মদন যেদিন গামছা বুনবে"। শিল্পীর এই কদর, সমাদর সম্পূর্ণ হারিয়ে যাওয়ার ফলে, গান গাইতে গাইতে মনের আনন্দে আর কাজ হয় না। কাজের মধ্যে থাকে ঘাম, হতাশা, আর দীর্ঘশ্বাস। রক্তকরবীর নন্দিনী এই নিরানন্দ ও হৃদয়হীন কর্মকে প্রত্যক্ষ করেছিল।
নন্দিনী যক্ষপুরীকে বুঝতে পারে না। "পৃথিবী আপনার প্রাণের জিনিস আপনি খুশি হয়ে দেয়। কিন্তু যখন তার বুক চিরে মড়া হাড়গুলোকে ঐশ্বর্য বলে ছিনিয়ে নিয়ে আসো তখন অন্ধকার থেকে একটা কানা রাক্ষসের অভিসম্পাত নিয়ে আসো। দেখছো না? এখানে সবাই যেন কেমন রেগে আছে, কিংবা সন্দেহ করছে, কিংবা ভয় পাচ্ছে।" নন্দিনী অবাক হয়ে দেখে, সমস্ত শহর মাটির তলাটার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে অন্ধকার হাতড়ে বেড়াচ্ছে। "পাতালে সুড়ঙ্গ খুদে তোমরা যক্ষের ধন বের করে করে আনছো। সে যে অনেক যুগের মরা ধন, পৃথিবী তাকে কবর দিয়ে রেখেছিল।" পন্ডিত বিজ্ঞানী অধ্যাপক বলবেন, আমরা সেই মরা ধনের শব সাধনা করি। তার প্রেতকে বশ করতে চাই। সোনার তালের তাল বেতালকে বাঁধতে পারলে পৃথিবী কে পাবো মুঠোর মধ্যে। মাতা বসুমতী যে ঝরণা ধারা, বৃষ্টি ধারা দেয় তা সকলের তরে। তারমধ্যে আনন্দ থাকতে পারে, বাহাদুরি নেই, অহমিকা নেই, আমিত্বের জাহির নেই। পাহাড়ের গায়ে মনোরম ফুলের শোভায় বিস্ময় আছে, কিন্তু পাহাড়ে সুড়ঙ্গ, মাটির নিচে থেকে জল তেল কয়লা লোহা আহরণ করায় শক্তি ও দম্ভের প্রকাশ আছে। এই সম্পদ সকলের তরে সমীচীন সমতায় বিতরণ হয়না। একে আয়ত্ত করার মধ্যেই ক্ষমতার মূল সূত্র। এই শক্তি ও ক্ষমতার নাম সভ্যতা। আধুনিকতা।
অন্যান্য জীবকুল প্রকৃতিকে বেঁচে থাকার প্রয়োজন মতো ভোগ করে। অপ্রয়োজনে নয়। মানুষ নিজের শক্তি ক্ষমতা দম্ভ প্রকাশের জন্য ভূগর্ভ, সমুদ্র গর্ভ, মহাকাশ সর্বত্র বিচরণ করে। এভাবে শিল্প সভ্যতা প্রকৃতি পরিবেশকে বিনষ্ট করে জীবকুলের বাসের অযোগ্য করে তোলে। জল জমি জঙ্গল মানবিক ও অমানবিক প্রাণ সকলের সামনে বিপদ এই মুনাফা শিকারী সভ্যতা, যক্ষের সভ্যতা। এই সভ্যতা কে মহিমান্বিত করার জন্যই ধোঁয়াশা সৃষ্টি, জালের আড়াল তৈরি হয়। "তোমাদের রাজা কে এই একটা অদ্ভুত জালের দেয়ালের আড়ালে, ঢাকা দিয়ে রেখেছো। সে যে মানুষ, পাছে সে কথা ধরা পড়ে। তোমাদের এই সুড়ঙ্গের অন্ধকার ডালাটা খুলে ফেলে, তার মধ্যে আলো ঢেলে দিতে ইচ্ছে করে। তেমনি ইচ্ছে করে ওই বিশ্রী জালটাকে ছিঁড়ে ফেলে মানুষটাকে উদ্ধার করি।" শাসক প্রভুর সম্পর্কে এই মোহজাল, কল্পকথা গল্পকথা সৃষ্টি করে, একটা সমীহ ভাব তৈরি করা হয়। স্বেচ্ছায় শাসিত হওয়া, একটা আনুগত্য আদায়ের প্রয়াস। মোড়ল, গোঁসাই, অধ্যাপক, শিক্ষা, প্রশাসন, ধর্ম, আইন, অবসর গ্রহণের পর রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য, সরকারি কমিশন কমিটির চেয়ারম্যান, রাজ্যপাল, রাষ্ট্রদূত, কতকিছু। এভাবেও পোষ না মানাতে পারলে, এসব কাজে না এলে, আছে সরাসরি দমন পীড়ন। আছে সর্দার, তার অনুচর ও শক্তি নিঙড়ে নেওয়া পেষণ কল অথবা ইডি, সিবিআই, আইটি।
এই সমগ্রটা একটা কনসার্ট, মার্কস লেনিন যেটাকে রাষ্ট্র শক্তি বলেছেন। রক্তকরবী মাত্র একটি সংলাপে সেটি ব্যক্ত করেছে। "দন্তন্য পাড়া যদিও এখনো নড়বড় করছে, মূর্ধন্যণরা ইদানিং অনেকটা মধুর রসে মজেছে। মন্ত্র শোনার মত কান তৈরি হলো বলে। তবু আরো কটা মাস পাড়ায় ফৌজ রাখা ভালো। কেননা "নাহংকারাৎ পরো রিপুঃ"। ফৌজের চাপে অহংকারটার দমন হয়। তারপরে আমাদের পালা।" এটা গোঁসাইজির উক্তি। শাসক কিভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস কে নিজের স্বার্থে কাজে লাগায় তার স্পষ্ট ছবি। ফাগুলাল বলছে সেই একই কথা, "দেখনি ওদের মদের ভাঁড়ার, অস্ত্রশালা, আর মন্দির, একেবারে গায়ে গায়ে লেগে আছে?"
অসংখ্য পৃষ্ঠা জুড়ে শ্রমিক শোষণ, তার উদ্বৃত্ত শ্রম ও উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বকথা, অত্যন্ত সহজ কয়েকটি শব্দ বন্ধে ও বাক্যে প্রকাশ পেয়েছে। তত্ত্ব কথায় বলা হয়েছে মালিক প্রভু মজুরের জন্য সেইটুকু মজুরি বরাদ্দ করে, যেটুকু না হলে পরের দিন সে মালিকের জন্য উৎপাদনে অংশ নিতে পারবে না। বলা যায় প্রান্তিক মজুরি। রক্তকরবীতে বলা হচ্ছে "সবদিক ভেবে যে পরিমাণ বাঁচা দরকার, আমাদের সর্দার নিশ্চয়ই ওকে ততটুকু বাঁচিয়ে রাখবে।" শুধু তো শ্রমের ওপর আধিপত্য করা নয় মজুরের সামাজিক পারিবারিক জীবন ও সত্যের ওপর মালিক আধিপত্য বিস্তার করে তার খাদ্যাভ্যাস বাস বাসস্থান শিক্ষা বিনোদন সবকিছুই মালিক প্রভুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মৃতপ্রায় গজ্জু পালোয়ানকে দেখে নন্দিনী প্রশ্ন করে "তবে কি এই লোকটা ওর সীমাবদ্ধ প্রাণ নিয়ে এইরকম আধমরা হয়েই পড়ে থাকবে?" সর্দার বলে "পড়ে থাকতে দেবো কেন, এখন থেকে নিজের জোরে চলবার ওর দরকারই হবে না। আমাদেরই জোরে চালিয়ে নিয়ে বেড়াবো। মানুষ চালানোই আমাদের ব্যবসা। আমরা জানি মানুষ যেখানটাতে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে, জোরে ঠেলা দিলে, অঅসে আরো খানিকটা যেতে পারে। আমরা চালিয়ে নিই।" মানুষের শেষ শ্রমশক্তি টুকু, ইচ্ছাশক্তি টুকু, শুষে নেয় এই তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা।
কমিউনিস্ট ইশতেহার বলে, আধুনিক শিল্প অবিরাম যন্ত্রের উন্নতি ঘটিয়ে ও কৃৎকৌশলের পরিবর্তন ঘটিয়ে চলে। এছাড়া সে বাঁচতে পারে না। কারণ দেরি করলেই, অন্য কোন শিল্পপতি মালিক উৎপাদনের অগ্রগতি ঘটিয়ে বাজার দখল করবে অর্থাৎ পুঁজিবাদের মধ্যে সর্বক্ষণই একমাত্র শক্তি একক ক্ষমতা একচেটিয়া হওয়ার প্রবণতা বর্তমান।" কেবলই আসন থেকে নবতর বৃহত্তর আসনে" উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা। বাঘের পিঠের সওয়ারি। Power-greed and more power, that only ceaseth in death. টিঁকে থাকার অনুশীলন আছে। "এই ব্যাঙ একদিন একটা পাথরের কোটরের মধ্যে ঢুকেছিল। তারই আড়ালে তিন হাজার বছর টিঁকে ছিল। এইভাবে কি করে টিঁকে থাকতে হয় তারই রহস্য ওর কাছ থেকে শিখছিলুম।" বেঁচে থাকা নয়, শুধুমাত্র টিঁকে থাকা। আর এই টিঁকে থাকার তাগিদেই নিজের চারপাশে মিথ্যা মোহজাল, মায়াজাল নির্মাণ।
প্রাচ্যবাদী পন্ডিতেরা যখন এদেশের প্রাচীন গৌরবজনক অধ্যায়, সভ্যতা ও সংস্কৃতির গুনগানে সোচ্চার, সেই সময় পাশ্চাত্য বাদীদের যুক্তি ছিল প্রজার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে এত বেশি আদিখ্যেতা দেখালে, সেই প্রজার মধ্যে একটা আত্মগর্ব স্পর্ধা তৈরি হবে। তখন সেই প্রজাকে শাসন করা বা বাগে আনা সম্ভব হবে না। তাই পাশ্চাত্যবাদীরা নিরন্তর এদেশের সভ্যতাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, হেয় প্রতিপন্ন করতে ব্যস্ত হলো। একটা বানিয়ে তোলা ভয়ে ভক্তি যেটাকে বিদ্রুপ করে নন্দিনী কত না সহজ ভাবে বলে "তোমার এ কি ভাব! লোকে তোমাকে ভয় করে, এইটাই দেখতে তুমি ভালোবাসো। আমাদের গাঁয়ের শ্রীকন্ঠ, যাত্রায় রাক্ষস সাজে। সে যখন আসরে নামে, তখন ছেলেরা ভয়ে আঁৎকে উঠলে, সে ভারি খুশি হয় । তোমারও যে সেই দশা। আমার কি মনে হয় সত্যি বলবো, রাগ করবে না? ভয় দেখাবার ব্যবসা এখানকার মানুষের। তাই তোমাকে তারা জাল দিয়ে ঢেকে, অদ্ভুত সাজিয়ে, ভয় দেখায়। এই জুজুর পুতুল সেজে থাকতে তোমার লজ্জা করে না।"
আসলে একটি ক্ষমতাবান শাসকগোষ্ঠী একজন একনায়ক শাসককে সামনে সাজিয়ে রাখে। তার সম্পর্কে ভয় ভীতি, সমীহ ভাব, আনুগত্য, ইত্যাদি নানা মিথ্যার জাল রচনা করে ও প্রচার করে। এরাই এক নায়কের চোখ ও কান। এরাই শাসককে "লার্জার দ্যান লাইভ" হিসেবে দেখায়। হ্যাঁ, "লার্জার দ্যান লাইভ", লোহার শক্তিটায় ক্ষয়রোগ ধরেছে। লোহার চেয়ে মরচে সর্বদাই আকারে বড়ো হয়। শাসক নিজেও এই স্তুতি ও প্রশস্তি উপভোগ করে। একসময় শাসক স্পষ্ট বুঝতে পারে যে তার নিজের লোকেরাই তাকে ঠকিয়েছে। এতদিন যা কিছু শুনেছে, শুনিয়েছে সে সবই মিথ্যা ভাষণ। রাজা উপলব্ধি করে "আমি পর্বতের চূড়ার মতো, শূন্য তাই আমার শোভা।" রাজা বলেন, "ঠকিয়েছে, আমাকে ঠকিয়েছে এরা। সর্বনাশ আমার নিজের যন্ত্র আমাকে মানছে না। ডাক তোরা সর্দারকে ডেকে আন, বেঁধে নিয়ে আয় তাকে।" সকল দেশের ইতিহাসে শাসকের কাছে তার নিজের শাসন যন্ত্রটাই অচল হয়ে পরে। আসন্ন হয় পরিবর্তনের মাহেন্দ্রক্ষণ।
রক্তকরবীর এতো উল্লেখ করার কারণ, কথাগুলো যেন আজকের কথা। অথচ এই নাটককে একসময় বুর্জোয়া উদারনৈতিক ভাবালুতার প্রকাশ বলে দেগে দিয়েছিলাম। সত্তরের দশকে, তখন ছাত্রাবস্থায় বাতিল করার প্রধান যুক্তি ছিল :
১) নাটকের ছত্রে ছত্রে বিজ্ঞান, কারিগরি বিকাশ, প্রগতি, উন্নততর জীবন যাপনের বিরোধিতা করা হয়েছে। প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল অন্যান্য জীবের অনুরূপ মানবগোষ্ঠী কে কল্পনা করা হয়েছে।
২) রক্তকরবীর রাজাকে নিয়ে বিস্তর মতভেদ ছিল সেযুগে। কারণ নন্দিনীর চোখে রাজা আসলে একটি ক্ষমতা গোষ্ঠীর হাতের পুতুল। সে নিজে জানে না তার রাজতন্ত্রকে। শুধু জনমানসে রাজাকে আবছা অস্পষ্ট করা নয়, রাজা নিজেও মিথ্যার জালে আটকে আছে। রাজা নন্দিনীর প্রতি মুগ্ধ দৃষ্টিতে আসক্তি প্রকাশ করে, সে নিজেও রঞ্জনের প্রতি অনুরক্ত। তাকে তার অনুচরেরাই ঠকিয়েছে। "নৃপ কর্ণেন পশ্যতি" অতএব মন্ত্রী পাত্র মিত্রদের মিথ্যা তথ্য পরিবেশন রাজাকে বিভ্রান্ত করেছে। রক্তকরবীর রাজা নিজেই নিজের যক্ষশালা ভাঙতে চায়। এক অবাস্তব অলীক কল্পনা। কারণ আমরা বিশ্বাস করতাম, শাসক শ্রেণী স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করেনা। বরং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে চেষ্টা করে জনগণের ইচ্ছার বিপরীতে চলতে। অতএব রক্তকরবীর রাজা, আমার সেই জানা ছকের বাইরে। তাই এটা বর্জনীয় ছিল।
৩) চন্দ্রা, ফাগুলাল, গোকুলরা যেভাবে হাতুড়ি শাবল নিয়ে যক্ষপুরীকে ভাঙতে চললো, সেটা স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভের প্রকাশ। কোন সুচিন্তিত সুসংগঠিত সিস্টেম ভাঙ্গার দিকনির্দেশ নয়। এটা ফস্ করে জ্বলে উঠে দপ্ করে নিভে যাওয়ার মতো একটা প্রতিবাদ। কিন্তু সমস্যার সমাধান নয়।
অন্ধ বিশ্বাস ও ভক্তির বিপরীতেই থাকে অন্ধবিদ্বেষ। ফলে একদা যেমন গোটা রক্তকরবীকে বর্জন করেছিলাম, সামাজিক প্রগতি বিরোধী বলে চিহ্নিত করে ছিলাম, ঠিক সেই ভাবেই সরকারি বামপন্থা এসে ভুল সংশোধন করল ও গোটা রক্তকরবীকেই গোগ্রাসে গিললো।ফলে হজম হলো না। গোগ্রাসে গেলার পর এবার বরং আজ দলীয় বেড়া ও নির্দেশের বাইরে কিছু জাবর কাটা যাক। আলোচনা শুরু করা যাক।
(১)
পুঁজিবাদের অন্তিম লগ্নে, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের যুগে, এদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ শুরু থেকেই বিকারগ্রস্ত, বিকৃত পুঁজিবাদকে ও যন্ত্র সভ্যতাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলা যায় ব্রিটেনে শ্রমিক অসন্তোষের ফলে এক চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছিল। পুঁজিবাদী সভ্যতায় সে যুগে ফিনান্স পুঁজির অন্যতম অগ্রণী মালিক সিসিল রোডস তার বন্ধু টেডকে এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে বলেন, গতকাল আমি লন্ডনের ইস্ট এন্ডে শ্রমিক কলোনিতে গিয়েছিলাম। বেকারদের এক সভা দেখলাম। প্রচন্ড সব বক্তৃতা, "রুটি চাই, রুটি চাই" চিৎকার। যা দেখলাম, যা শুনলাম, তা থেকে সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজন সম্পর্কে আমি নিশ্চিত হলাম। যুক্তরাজ্যকে একটা বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচাতে গেলে, সাম্রাজ্যবাদই হলো একমাত্র পথ। অর্থাৎ উপনিবেশে শোষণ পীড়ণ বাড়িয়ে দিয়ে, মুনাফাকে বৃদ্ধি করা ও তারই অংশ বিশেষ স্বদেশে বেকার, শ্রমিক এদের কল্যাণে ব্যয় করা সম্ভব। এভাবেই গৃহযুদ্ধ ঠেকানো সম্ভব। স্পষ্ট বোঝা যায় উপনিবেশে শোষণ ও পীড়নের মাত্রা যে ভয়ংকর রূপ নিয়েছিল, সেই রূপটি রবীন্দ্রনাথকে যন্ত্র সভ্যতা ও শিল্প সভ্যতা বিমুখ করেছিল।
ইন্ডিয়ান ফ্যাক্টরি লেবার কমিশনের রিপোর্টে জানা যায় আমেদাবাদে শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা ছিল গড়ে দৈনিক ১২ ঘন্টা, ব্রোচ শহরে শ্রমিকদের দৈনিক সাড়ে চোদ্দ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। টেক্সটাইল ফ্যাক্টরি কমিশনের রিপোর্টে প্রকাশ উদয় অস্ত খাটুনির পর যখন শ্রমিকরা কাজ থেকে ছুটি পেতো, প্রায়ই অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো। নন্দিনী যখন বলে, মরে যাই, ওদের এমন দশা কে করলে? সেটা একটুও বাড়াবাড়ি নয়। মজুরির চিত্রটিও ছিল সমপরিমাণ বিপর্যয়কর । ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের রিপোর্টে প্রকাশ ৬০% শ্রমিকের আয় ছিল দৈনিক সর্বোচ্চ এক সিলিং দুই পেনি আর নিম্নতম সীমা ৭ থেকে ৯ পেমি। নারী ও শিশু শ্রমিকদের ক্ষেত্রে মজুরী আরো কম। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে এস ভি পারুলেকর বলেন, ন্যূনতম জীবন ধারণের পক্ষে এই মজুরি যথেষ্ট কম। গোঁসাইজি বলেছিলেন, সবদিক ভেবেচিন্তে যেটুকু বাঁচিয়ে রাখা দরকার, সর্দার শ্রমিকদের ততটুকু বাঁচিয়ে রাখবেন। খুব কি বেসুর শোনালো। মিস্টার ফিন্ডলে শিররাস তার রিপোর্টে লেখেন বোম্বাইয়ের জেল কোডে কয়েদিদের জন্য বরাদ্দ ন্যূনতম খাদ্যের চেয়েও শ্রমিকরা কম খাদ্য পেত।
এ এ পার্সেল ও জে হলসওয়ার্থ শ্রমিকদের বাসস্থান প্রসঙ্গে লেখেন দৈর্ঘ্যে নয় ফুট ও প্রস্থে নয় ফুট একটি ঘর। সেখানেই রান্না খাওয়া চলত। মাটি দেওয়া টালির চাল, ছোট উঠানের কোনায় মলমূত্রত্যাগ চলতো। ১৯৩১ সালে সেন্সাস রিপোর্টে প্রকাশ, শতকরা ৯৫ টি শ্রমিক পরিবার একটি ১১০ বর্গফুট ঘরে বাস করে নিকাশী নর্দমা বলতে কিছু ছিল না। রাস্তাগুলি অপ্রশস্ত ও সেগুলি নর্দমায় পরিণত হতো।
বিপরীতে মুনাফার চিত্রটি হল উৎসাহব্যঞ্জক। ডান্ডি জুট ট্রেড ইউনিয়নের রিপোর্টে প্রকাশ, তিন লক্ষ মজুরের মাথাপিছু গড় বাসিক মজুরি বারো পাউন্ড ও মাথাপিছু মুনাফার পরিমাণ ছিল ১০০০ পাউন্ড। কোম্পানির বাৎসরিক ব্যালেন্স সিটে দেখা যায় অংশীদারদের কোথাও ১০০, ২০০, কোথাও বা ৩৬৫, ৪২০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছে। এ থেকে ভারতীয় শ্রমিকের উপর শোষণ পীড়ন, লুণ্ঠন ও বঞ্চনার মাত্রা অনুমান করা যায়। এই রূপটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ফলে তিনি যন্ত্র সভ্যতা বিরোধী ছিলেন এবং হতেই পারেন। আমরা বইয়ে পড়া দাসতন্ত্র সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রের সামাজিক অগ্রগতির লিনিয়ার মডেল কে বেদবাক্য বলে অনুসরণ করি। ভুলে যাই উপনিবেশ ভারতে সামাজিক বিবর্তনের হাত ধরে নয়, ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর হাতে, তার একান্ত নিজস্ব স্বার্থে।
(২)
এইরকম একটি নির্মম অমানবিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই ফাগুলাল, চন্দ্রা, গোকুল, এইসব মজুরেরা সরাসরি হাতুড়ি-শাবল-গাইতি নিয়ে যন্ত্র ভাঙতে যাবে এতে আশ্চর্য হবার নেই। কারণ তাদের কাছে তত্ত্ব কথা নয়, বাস্তব পীড়নকারী ব্যবস্থাটা হল যন্ত্র সভ্যতা। এই যন্ত্রের জন্যেই মানুষের যত যন্ত্রণা, এই উপলব্ধি থেকেই যন্ত্র ভাঙ্গা, যক্ষপুরী ভাঙার অবতারণা। ইউরোপীয় যন্ত্র ভাঙ্গার আন্দোলন ল্যুডাইজম শুরু হয়েছিল বৃটেনের মিডল্যান্ড ও নর্দান কাউন্টটিতে। সেখানে নটিংহ্যাম, লিসেসটার, ডার্বি, ইয়র্কশায়ার, চেশায়ার, ল্যাংশায়ার সর্বত্র ল্যুডাইট বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৪৮ এ ফ্রান্সেও শ্রমিক বিদ্রোহে ল্যুডাইট চরিত্র লক্ষণীয়। জর্জ রুদ বলেন, Like other forms of popular actions appropriate to the pre industrial age , Luddism had no future in the new industrial society. মনে রাখা দরকার জজ রুদ বলেছেন প্রি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটির কথা। আর রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন হায়েস্ট ফেসবু অফ Highest stage of capitalism কে। দুটি ক্ষেত্রেই পুঁজিবাদের রূপটি বিকৃত। অতএব তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিক্রিয়াটিও অপরিণত বিকৃত হতে বাধ্য।
(৩)
আমাদের মত যান্ত্রিক কমিউনিস্টদের চোখে খটকা লাগে, যখন দেখি রবীন্দ্রনাথ সমাধানের পথ হিসেবে রাজা-মজুর সকলের মিলিত এক প্রয়াসের কথা বলেন। রাজা নিজেই তার যক্ষপুরী ভাঙতে চলেন। যে ভাবনার অংশীদার আজকের দিনে হীরকের রাজা, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে রাজা নিজেও সকলের সাথে ছুটছেন, "দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান"। আমাদের চোখে বিভ্রান্তি ঠেকে। বলা যায়, অবাস্তবও বটে। কিন্তু স্মরণ রাখা প্রয়োজন ইউরোপে পুঁজিবাদের প্রথম যুগে যখন যন্ত্রসভ্যতার নির্মম রূপটি স্পষ্ট। কিন্তু ব্যবস্থাটি তখনো পরিপূর্ণ পরিণত রূপ নেয়নি। সেই অপরিণত পুঁজিবাদের যুগে সমাধানের উপায় খুঁজতে গিয়ে শ্রমিকের দুর্দশা লাঘব করতে গিয়ে মানবতাবাদী চার্লস ফ্যুরিয়ে, সে্ট সিমন্স, রবার্ট আওয়েন প্রমুখ সমাজতন্ত্রীগণ বৌদ্ধিক বিশ্লেষণ দিয়ে সমাধানের পথ খুঁজেছেন। অপরিণত ধনতন্ত্রের সমাধানের সূত্রটিও অপরিণত হতে বাধ্য। রোগের লক্ষণ গুলি যখন সুপ্ত, তখন রোগ নির্ণয় অসম্ভব। এঙ্গেলস যাকে কাল্পনিক সমাজতন্ত্র বা ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র আখ্যা দিয়েছিলেন। এঙ্গেলস কখনোই ইউটোপীয় শব্দটি নিন্দাচ্ছলে ব্যবহার করেননি। বরং যথেষ্ট সম্ভ্রমের সাথে ব্যবহার করেছেন। কারণ সে যুগে এরাই ছিলেন সমাজতন্ত্রের বার্তাবাহক। এরা শ্রমিক মালিক সমবায়ের মাধ্যমে শিল্প পরিচালনা করে, নিউ ল্যানার্কে এইরূপ শিল্প গঠন করেন। শ্রমিকদের মধ্যে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টি বিধানের দিকে দৃষ্টিদান ইত্যাদি কাজে হাত লাগিয়েছিলেন।
গান্ধিজীও শ্রমিক মালিক সমবায় ও সমঝোতার মধ্যেই সমস্যার সমাধান খুঁজেছিলেন। রবীন্দ্রনাথও এই পথকেই বেছে নিয়েছিলেন। সমাজতন্ত্রের এই বুদ্ধিমার্গীয় অনুশীলন সফল হওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য গুলি তখনও ছিল নিহিত সুপ্ত। কিন্তু প্রশ্ন জাগে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ যা প্রতিষ্ঠার পর কম বেশি নানাবিধ অনুশীলন, বিভিন্ন দেশে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। শেষ অবধি কি কোন একটিও পরীক্ষা সাফল্য লাভ করল? কতো কতো শ্রমজীবী সমবায় কে দেখলাম শেষ পর্যন্ত একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন মাথাভারি আমলাতন্ত্রে পরিণতি লাভ করেছে। আজ তো অধিকাংশ দেশেই কমিউনিস্টদের আশু কর্মসূচি উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করা ও জনকল্যাণকারী রাষ্ট্রের কর্মসূচিকে রক্ষা করা। কারণ গণতান্ত্রিক দেশ গুলি ক্রমাগত স্বৈরাচারী, জনবিরোধী, জনকল্যাণ বিমুখ, নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র হয়ে উঠছে। হয়তো ভবিষ্যতে ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রই পথ দেখাবে সারা বিশ্বকে।
(৪)
রবীন্দ্রনাথ দেশীয় শিল্পদ্যোগ সম্পর্কে বিশেষ আশাবাদী ছিলেন না সেই কারণেই ঘরে বাইরে উপন্যাসে নিখিলেশ নানাভাবেই স্বদেশী শিল্প উদ্যোগকে সমালোচনা করেন। স্বদেশী যুগের নানান ভাষণে ও বক্তব্যে এই সমালোচনার সুর পাওয়া যায়। এমনকি শ্রীনিকেতনে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে, দেশীয় ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে হস্তশিল্পের প্রসারে নিযুক্ত হলেন। দেশীয় শিল্প সম্পর্কে এই হতাশা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ অধ্যাপক সুমিত সরকার তার স্বদেশী শিল্প উদ্যোগ সংক্রান্ত আলোচনায় বলেছেন, প্রকৃত শিল্প পুঁজির অভাবে স্বদেশী শিল্প কখনোই বেড়ে উঠতে পারেনি। এযুগের শিল্পোদ্যেগ ছিল মধ্যবিত্ত আকাঙ্ক্ষা নির্ভর। তিনি উল্লেখ করেছেন তারাচাঁদ ঘনশ্যাম দাশের গ্রেট ফার্ম, ছিল আসলে শ'ওয়ালেসের বেনিয়া। অনুরূপ বেনিয়ার সম্পর্ক দেখা যায়, গোয়েঙ্কার সাথে Rallys, ঝুনঝুনওয়ালার সাথে গ্রাহাম, জেটিয়ার সাথে অ্যান্ড্রু হিউলের। অর্থাৎ ভারতীয় শিল্পপতি বলে যাদের বলা হয়, তারা আসলে শিল্পপতি নয়। তারা বিদেশি পুঁজির বেনিয়া। শিল্পের পুঁজি ছিল মাড়ওয়ারি বণিক, বাংলার সাহা-বসাক, এদের হাতে। কিন্তু এরা শিল্পে বিনিয়োগে ঝুঁকি নেওয়ার অপেক্ষা বিদেশি কোম্পানির আমদানি রপ্তানি এজেন্ট হিসেবে কাজ করাতেই অধিক লাভের সম্ভাবনা দেখেছিল। ঝুঁকি গ্রহণ, জাতীয় পুঁজি গঠন, স্বাধীনতা এসব নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না। শিল্প উদ্যোগ তাই এলিট মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, পেটি বুর্জোয়ার মধ্যে আবদ্ধ ছিল। আর যাই হোক, এই শিল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভেতরে কোন আশা বাঞ্জক স্বপ্ন জেগে ওঠার সুযোগ ছিল না, জাগার কারনও ছিল না। ফলে রক্তকরবী শিল্প সভ্যতা বিরোধী হবে এটাই ভবিতব্য।
আমরা তথাকথিত কমিউনিস্টরা মার্কসের চেয়েও বেশি মার্কসবাদী, রাজার চেয়েও রাজকীয়। সংশোধনবাদী, সংকীর্ণতাবাদী, ইউটোপীয়ান, অতিবাম তকমা দিয়ে দেগে দিতে শিখেছি। ফলে না পারলাম মানবিকতাবাদী ইউটোপীয়ান হতে, না পারলাম কমিউনিস্ট হতে। রক্তকরবীর পুনর্পাঠ আরও একবার সেই সত্যই প্রকাশ করলো।