অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সজ্ঞানে নির্বাচন দেখেছি (অর্থাৎ কিনা ভোট দিয়েছি) বার-ছয়েক। লোকসভা, বিধানসভা মিলিয়ে। পুরসভার নির্বাচনগুলিকে অবশ্য এই হিসেবের মধ্যে আলাদা করে ধরিনি। কারণ সেই নির্বাচনগুলির ব্যাপ্তি বা পরিসর অনেকাংশে কম। ‘ভোট-উৎসব’ বলতে আমরা সচরাচর বৃহত্তর আইনসভাগুলির পঞ্চবার্ষিকী নির্বাচনকেই মান্যতা দিয়ে থাকি। বর্তমান সংখ্যার এই আয়োজনও তেমনই এক বৃহত্তর নির্বাচনকে মনে রেখে। কাজেই আমাদের আলোচনাও সেজে উঠবে সেই ভাবেই।
২০০৯ থেকে ২০২৪এর ভোটযুদ্ধ অবধি প্রধান যে সামাজিক পরিবর্তন এসেছে, তা এসেছে মূলত প্রচার-বৈশিষ্ট্যের পরিসরে। অবশ্য এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত। প্রচার-বৈশিষ্ট্য বলতে আমি কেবল রাজনৈতিক নেতাদের ভাষণ-বক্তব্যের কথা বলিনি। প্রধান যে ইস্যু বা বিষয়গুলিও নির্বাচনী ফলাফলকে ক্রমাগত প্রভাবিত করেছে, বা করে চলেছে-সেগুলির চরিত্রেও এক বিশেষ বদল এসেছে। মূলত ইন্টারনেট বিপ্লব, বিশেষত সামাজিক মাধ্যমের বিপুল প্রচার ও প্রসার এই বিষয়টিতে সহায়তা করেছে। এরফলে লাভের চাইতে ক্ষতির পরিমাণই বেড়েছে। মূল বা প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি থেকে আমরা সরে গিয়েছি অনেক দূর।
সামাজিক মাধ্যমের বিপুল প্রসারের কারণে পাল্লা দিয়ে প্রসারিত হয়েছে মিথ্যা বক্তব্যের প্রচার। সাম্প্রদায়িক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সমস্ত পরিসরেই ব্যাপক আকারে ভুয়ো বক্তব্যের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে আগ্রহীরা চাইলে নোবেলজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসা কর্তৃক লিখিত ‘হাউ টু স্ট্যাণ্ড আপ টু এ ডিকটেটর’ বইটিকে উলটিয়ে দেখতে পারেন। রীতিমতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে মারিয়া সেখানে দেখিয়েছেন কিভাবে সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে ফিলিপিন্সের একনায়ক রডরিগো দুতের্তের সমর্থকেরা নির্বাচনী পরিসরেও একনায়কের উত্থানকে সুনিশ্চিত করে তোলে। বর্তমান ভারতবর্ষের রাজনীতি-পরিসরেও বিগত প্রায় এক দশক যাবৎ আমরা তেমনই এক সুনিবিড়, সামাজিক-মাধ্যম আন্দোলনের ফলশ্রুতিকেই সাংবিধানিক পরিমণ্ডলে সহ্য করে চলেছি। ‘আইটি সেল’ শব্দবন্ধটি যে কতদূর অবধি সত্য, আর কতখানিই বা তার ক্ষমতা, আমরা গড়পড়তা সাধারণ মানুষ তা ধারণাও করে উঠতে পারিনা।
এরফলে এখন নির্বাচনী লড়াইয়েরই বা কেমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে? অন্তঃসারশূন্য প্রচারের অলিখিত প্রতিযোগিতায় রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা একে অপরকে টেক্কা দিয়ে চলেছেন। কেউ বা সেলুনে ঢুকে চুল কেটে দিচ্ছেন, কেউ বা বাড়ির রোয়াকে জনৈক ভোটদাতাকে রীতিমতো মগের সাহায্যে মাথায় জল ঢেলে স্নান করিয়ে, গা মুছিয়ে দিচ্ছেন, আবার কেউ বা রান্নাঘরে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ চালিয়ে ভোটারকে মাছ অবধি ভেজে দিয়ে ভোট প্রার্থনা সারছেন। এঁরা তো ভুলেইছেন যে, সংসদ ভবনটি কোনওভাবেই সেলুন, শৌচাগার অথবা হেঁশেলের সমতুল নয়। বরং অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একেকটি বিষয় নিয়েই বোধকরি সেই ভবনের প্রধান দুইটি কক্ষে আইনপ্রণেতাদের দায়িত্বশীল আলোচনা হয়ে থাকে।
আইনপ্রণেতা শব্দটিই এঁদের প্রসঙ্গে কেমন ভারিক্কি শোনালো বোধহয়। আসলে এমন সব প্রার্থীরাও জানেন, মানুষ যত না তাঁদের মুখ দেখে বা কাজ দেখে ভোট দিয়ে থাকেন, তার চেয়েও বেশী করে তাঁরা প্রতীক বা দলীয় চিহ্নতেই আস্থা রাখতে চান। কাজেই দলীয় প্রচার, বা দলীয় নীতির প্রসার-যে প্রচার আদতে সামাজিক মাধ্যমের সেই বিরাট পরিসরকেই ইদানীং ব্যবহার করে চালানো হয়ে থাকে, সেই ভোটারমুখী ব্যক্তিগত প্রচারের উপরেই একেকটি কেন্দ্রের ফলাফল নির্ভর করে। ভোটারকে বিশ্বাস করানো হয়, তাঁদের গ্রামে আজ এই এতদিন অবধিও আলো অথবা বিদ্যুৎ না’ই পৌঁছতে পারে, কিন্তু ‘মধ্যযুগীয় মোগলদের প্রবল অত্যাচারের অবসান ঘটিয়ে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় আজ যে মন্দির ভব্য-গীত সহযোগে প্রতিষ্ঠা করা হল’, তাই আদতে ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার উদাহরণ। ভোটারকে ভাববারও সুযোগ দেওয়া হয় না, সাংবিধানিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কেমন করেই বা ‘রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা’ কোনও নির্বাচিত সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য হতে পারে!
একই রকম ভাবে গুরুত্ব পায় না কর্মসংস্থান, বেকারত্ব, শিক্ষা অথবা স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংবিধানের মূল প্রস্তাবনায়, ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটির গৌরবময় উল্লেখ থাকলেও, বেলাগাম বেসরকারিকরণ উন্নয়নের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণাকে সরিয়ে তার জায়গা নেয় পুঁজিবাদ; ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের উদযাপনকে সরিয়ে জায়গা করে নেয় একমুখী, একধর্মী, একনায়কোচিত রাষ্ট্রভাবনার প্রকাশ। মারাঠাওয়াড়া অঞ্চলের অনাহারক্লিষ্ট কৃষক সম্প্রদায়কে মগজে গজাল মেরে বুঝিয়ে দেওয়া হতে থাকে, মুম্বাই-আহমেদাবাদ করিডরে বুলেট-ট্রেন চালানোর যে পরিকল্পনা, তাই আদতে বিকশিত রাষ্ট্রের প্রথম উদাহরণ। সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে লাদাখবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, আপাতত ষষ্ঠ তফশিলের যে প্রতিশ্রুতি, সেটুকুকে তারা বিস্মৃত হতে পারে; পাহাড়ের পরিবেশ বাঁচানোর পরিবর্তে, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর পরিবর্তে, এমনকি উত্তর-সীমান্তে চীনা সেনার লাগাতার অনুপ্রবেশ বন্ধ করারও পরিবর্তে, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলিকে বেরাদর-পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়াই এদেশকে আজ অমৃত-কালের অভিমুখে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
জনতাও সেই প্রচার-কৌশলের কারণেই প্রভাবিত হতে বাধ্য হয়। অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যম, অথবা দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে দেখলে যে এক আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী, তা আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। সেই মাধ্যমকে ব্যবহার করেই, সত্য নয় – এমনকি মিথ্যাও নয় – লাগাতার অর্ধসত্যের প্রচার চলেছে। অর্ধসত্যের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, তা যেমন সত্য নয়, তেমনই কিছু কিছু অংশে তাকে মিথ্যাও বলা চলে না। কাজেই সেই সব আবছায়া অঞ্চলের আবছায়াত্বটুকুকেই নির্লজ্জ ভাবে কাজে লাগিয়ে আজকের রাজনীতির কাণ্ডারীরা তাদের প্রোপাগাণ্ডা চালিয়ে যায়। আধুনিক দেশে বুলেট-ট্রেনের ব্যবহার নিঃসন্দেহে উন্নতির উদাহরণ। কিন্তু সেই সমস্ত দেশের বিষয়ে আরও যে কথা বলা উচিত, বুলেট-ট্রেনেরও পূর্বে, তাঁরা স্বদেশের খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যেই যুগ যুগ ধরে কাজ করে এসেছেন।
গান্ধী মহারাজ সেই কতকাল আগেই বলেছিলেন, “ভারতবর্ষে জনতার প্রতিনিধিত্ব করে তাদের ৭৪০০০ গ্রাম”, যতই আমরা মহানগর অথবা মেট্রোপলিটান ‘ভিকাশ’এর সপক্ষে দাঁড়িয়ে চিৎকার করি না কেন, এই সত্যকে আমরা আজও অস্বীকার করতে পারি না। এই প্রসঙ্গে দেখলে, আমি কেবলই বৈষম্যের (disparityর) কথা বলছি এমনটা নয়। আমি বলছি বৈপরীত্যের (contrast) কথা। আজকের এই প্রচারসর্বস্বতার কল্যাণে আমরা গ্রাম ও শহরের চাহিদার যে বৈপরীত্য বা contrast, তাকেও অনেকাংশে বিস্মৃত হচ্ছি বলে মনে হয়। আমরা কর্মসংস্থান বলতে বুঝছি বড় বড় কারখানা, খনিজ-শিল্প স্থাপন, অথবা আরও সমস্ত উন্নয়ন-পরিকল্পনার খতিয়ান, যা কিনা গ্রামীণ অর্থনীতিকেই আমূল উপড়িয়ে ফেলতে চায়। আমরা গ্রামকে শহর দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চাইছি। আমরা আদতে সহাবস্থানের পক্ষে নই। এই পদ্ধতিতে উন্নয়ন কখনই সঠিক দিশায় দেশ বা জাতিকে নিয়ে যেতে পারে না। বৈপরীত্যকে মেনে নিয়ে, সেই ‘বহু’র সহাবস্থানকে সুনিশ্চিত করতেই আমাদের কাজ করা উচিত। তবুও আজকের এই প্রচার-উন্মত্ততায়, আমরা ক্রমশই গুরুবাদী, শহরবাদী, ধনবাদী মানসিকতার পরিচয় দিয়ে চলেছি। আমরা বহু’র বিপরীতে, শক্তিমান একক’কেই ক্ষমতায় দেখতে চাই।
আজকেই গোধূলির সময়, অফিস থেকে খানিক ঘুরপথে, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অঞ্চলের ভিতর দিয়ে ফিরেছিলাম। আমাদের অফিস যেখানে, সেই অংশটি আধুনিক থেকে আধুনিকতর হয়ে উঠতে চাইছে। তথ্যপ্রযুক্তির যে বিরাট কর্মসংস্থান-উৎপাদনের ক্ষমতা, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তা অস্বীকার করার নয়। তবুও সেই পরিসরেও যে একাধিক অনিয়ম চলে, অথবা পুঁজির সঙ্গে সাধারণ কর্মচারীকে লড়তে হয়, তাও আমরা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হই। এখন, আমার একথা বলার যে উদ্দেশ্য ছিল – যে পরিসর থেকে আমি পেশার দায়িত্ব সেরে বেরুলাম, সেই অংশের সঙ্গে জড়িত, সংশ্লিষ্ট যে নাগরিক-সমাজ বা সম্প্রদায়, আইনপ্রণেতাদের কাছ থেকে তাঁদের যে চাহিদা থাকবে – তার পাশাপাশি, যে অংশ দিয়ে আমি বাড়ি ফিরে এলাম, সেই অংশের বাসিন্দাদের তরফে উঠে আসা চাহিদাগুলি যে একেবারেই ভিন্নধর্মী হয়ে উঠবে। এই ভিন্নতাকেই, বৈষম্য বলারও আগে, বৈপরীত্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। বৈষম্য বলে আগেভাগেই চিহ্নিত করে দিলে বোধহয়, দায়িত্ব অথবা কর্তব্যের চেয়েও বোধকরি দয়ার ভাবটিই অধিক পরিমাণে ফুটে উঠতে শুরু করে। বরং নাগরিক-বৈশিষ্ট্যের বৈপরীত্যকে উপলব্ধি করতে পারলেই, একথা স্পষ্ট হয়ে যায় – বৈষম্য ঘোচানো নয়, বরং প্রত্যেক নাগরিক পরিসরের নির্দিষ্ট, প্রয়োজনীয় ও বাস্তবসম্মত বিকাশের লক্ষ্যেই আইনপ্রণেতাদের কাজ করা উচিত।
কৃষিনির্ভর এলাকায় কৃষির উন্নতি, শিল্প-নির্ভর এলাকায় শিল্পের বিকাশ, সর্বোপরি সংবিধানের মূল প্রস্তাবনাতেই যে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা আছে – যেমন কিনা সার্বভৌমত্ব, সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মনিরপেক্ষতা এই বিষয়গুলিকে সুনিশ্চিত করা, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে বলবৎ করা, সার্বিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার, এই বিষয়গুলিই তো যে কোনও রাষ্ট্রের নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধান আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত। কিন্তু কোন পথেই বা আমাদের বিবর্তন? যতই সময় এগিয়েছে, আমরা যেন এই প্রাথমিক, বুনিয়াদী ধারণাগুলির থেকে ক্রমশই আরও দূরে সরে যাচ্ছি, যে দূরত্ব তৈরির কারণ ইতিপূর্বেই আলোচনা করে এলাম।