রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়
২৪শে এপ্রিল, ১৯৯১
প্রথম ভোট দেব। একটা চাপা উত্তেজনা ভেতরে ভেতরে। সদ্য কলেজে ঢুকেছি। রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে পারব বাস্তবে, গণতন্ত্রের উৎসবে সামিল হব – এসব ভেবে আনন্দ আর ধরছে না যেন। গতকাল সন্ধ্যাবেলা বাচ্চুদা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে প্রথম ভোটার হওয়ার শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছিল কি ডকুমেন্টস নিয়ে যেতে হবে, কিভাবে ব্যালট ভাঁজ করতে হবে এসব। সাবালক হওয়ার উষ্ণ আনন্দ বেশ স্বাদু মনে হচ্ছিল। যে স্কুলে পড়েছি, সেই স্কুলে ভোট দিতে ঢুকছি, বেশ অন্যরকম একটা অনুভূতি। আমাদের জুনিয়র সেকশনের ক্লাস থ্রি-এ ঘরটাই সিনিয়ার সেকশনের সেভেন-এ। এই ঘরটাতেই বসেছি টানা দু-দুটো বছর। আজ নাগরিক কর্তব্য পালন করতে এসেছি। অনেকেই অভিনন্দন জানালো। বাচ্চুদা পোলিং এজেন্ট হয়ে বসেছে রুমের ভেতর। দীনেশ কাকুকেও দেখলাম অন্য আরেকটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করছে। আমার আগে টুবলুদা। তার আগেরজনকে ঠিক চেনা মনে হলনা। ভাবলাম পাড়ায় নতুন কেউ এসেছেন। সেই ভদ্রলোক যখন ভোট দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসে কর্তব্যরত পোলিং অফিসারকে স্লিপটা দেখাচ্ছেন, তিনি সজোরে বলে উঠলেন ‘সরোজ রায়'। আমি তো সাঙ্ঘাতিক অবাক হয়ে গেছি। সরোজ কাকু তো বছর তিনেক হল মারা গেছেন! বাচ্চুদা কিছুই বলল না, শুধু লিস্টে একটা দাগ দিয়ে নিল। কিন্তু দীনেশ কাকু চীৎকার করে উঠল – “ইনি সরোজ রায় নন। সরোজ রায় মৃত। কি রে বাচ্চু, এসব কি হচ্ছে?” সেই অচেনা ভদ্রলোক দাঁড়িয়েই আছেন। হঠাৎ দেখি কোত্থেকে রূপক সাহা এসে উদয় হল। সোজা এসে দীনেশ কাকুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল –“বসতে দিয়েছি এই তোর বাবার ভাগ্য ভালো। চুপ করে বসে থাক, নাহলে বেরিয়ে যা।” এই বলে দীনেশ কাকুর কাগজপত্র ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের বাইরে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ ভদ্রলোক যেন কিছুই দেখেন নি। দীনেশ কাকু বাচ্চুদার দিকে তাকিয়ে পাগলের মত চীৎকার করছে –“তোরা তো এটাই চাইছিস। আমি থাকলে তোদের লুচ্চামি ধরা পড়ে যাবে যে!” বাচ্চুদা একটাও কথা না বলে একমনে নিজের কাগজপত্র দেখছে। হাঁ করে তাকিয়ে আছি গোটা ঘটনাটার দিকে। সম্বিত ফিরলে লাইন ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। চেনা অনেকে জিজ্ঞেস করছে - “হয়ে গেল?” বা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে “আমাদের কমিটেড ভোট”…স্কুল থেকে বাড়ির দিকে অনেকটা এগিয়ে এসে মনুদার দোকানের সামনেটায় দেখলাম, দীনেশ কাকুকে ঘিরে অল্প কয়েকজনের একটা জটলা। একঝলক দেখতে পেলাম, দীনেশ কাকুর ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে না! তার মানে…দ্রুত পা চালালাম। নিজের কাছ থেকেই কি পালিয়ে যেতে চাইছিলাম। যে রূপক সাহা আজ দীনেশ কাকুকে সবার সামনে তুই-তোকারি করল, বাবার কাছে শুনেছি দল যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে, সে সময় সক্রিয় কর্মী চিত্ত সাহা মারা গেলে বিপক্ষ দলের কর্মী দীনেশ কাকুই একা দায়িত্ত্ব নিয়ে ছেলেবেলার বন্ধুর শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করেছিল। হয়ত তারই প্রতিদান আজ পেয়ে গেল হাতেনাতে। বাড়ি ফিরে এসে আর গেলাম না ভোট দিতে। বন্ধুরা যখন বাম হাতের তর্জনীতে কালো দাগটা দেখতে চেয়েছিল, আমি বিষন্ন হাসিতে বলেছিলাম – “দেওয়া হলনা রে।” ভেতরে যে কালো দাগ চিরস্থায়ী হয়ে গেল, কাউকে দেখাতে পারিনি। রূপক সাহাকে কোনদিনই আমার পছন্দ হয়না, কিন্তু বাচ্চুদাকেও এরপর দীর্ঘদিন এড়িয়ে চলতাম। এরপরও নির্বাচন এসেছে, আমাদের জীবনযাপনে ভোট-সংক্রান্ত সন্ত্রাস স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ভোট দিয়েওছি, কিন্তু প্রথমবার ভোট বা দিতে পারার সেই কষ্ট আজও মোছেনি। মোছেনা হয়ত।
১০ই মে, ২০১১
ওঃ! আজ দিনটা পার হলে যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারা যাবে। নিজের বাসস্থান অঞ্চলের ব্লকেই ও.সি. ইলেকশন-এর দায়িত্ত্ব পালন করতে হচ্ছে, এমন ঘটনা বিরল এবং আমি এই দুমুখো ছুরিটা অত্যন্ত সাবধানে নাড়াচাড়া করছি। চেনা লোককে পেয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের প্রত্যাশা প্রচুর। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে যেহেতু এই নির্বাচন এক গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের স্বাক্ষী হতে চলেছে, সুতরাং সামান্য ত্রুটিও বিবর্ধিত হয়ে যেতে পারে কয়েকশগুণ। আগেরদিন সন্ধ্যাবেলা পোলিং পার্টি সব বুথে মুভ করে যাওয়ার পর নিয়মরক্ষার জন্য কয়েকটা বুথ ভিজিট করতে হয়। নিজের পাড়ার বুথেই যাব ঠিক করলাম। স্কুলের ২০০ মিটার পর যে রাজনৈতিক দলের কাউন্টার, ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর তারা জেনেই গেছে যে এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসা শুধু সময়ের অপেক্ষা। ইচ্ছে করেই গাড়ি থেকে নামলাম কিছুটা আগেই। ‘স্যার’ কেউ একটা ডাকল শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম। “স্যার, আমার বাবার নাম স্বর্গীয় দীনেশ মজুমদার।” “আচ্ছা! তুমি দীনেশকাকুর ছেলে? কি নাম তোমার?” ছেলেটি নাম বলল। তারপর সোজাসুজি বলল, “স্যার, এ বুথ নিয়ে কোন চিন্তা নেই। কোন ঝামেলা হবেনা। শুধু ওই ঘাটের মরাটা সাবধানে না থাকলে যদি কিছু ঘটে যায়, সে কথা দিতে পারছি না।” দীনেশকাকুর ছেলে বৃদ্ধ বাচ্চুদাকে দেখালো। “আমি এই পাড়ায় বড় হয়েছি, এ পাড়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিন্তু অসুস্থ নয়। সুতরাং এই ঐতিহ্য বজায় যেন থাকে।” না, একথা আমি বলতে পারলাম না। শুধু ওর কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে সামান্য হেসে এগিয়ে গেলাম। স্কুলে ঢুকতে যাব, বাচ্চুদা কি যেন একটা বলতে গেল। তড়িঘড়ি করে বলে উঠলাম, “এখন ইলেকশন ডিউটিতে আছি। পরে কথা হবে।” কথাটা বলার পর বাচ্চুদার অসহায় মুখের দিকে আর তাকাইনি। পরদিন পোল স্টার্ট হয়ে যাওয়ার পর থেকে আওয়ারলি রিপোর্ট পাঠাচ্ছে সেক্টর অফিসাররা। কোথাও কোন অশান্তির খবর নেই। আমারও প্রেশার অনেক কম। সিস্টেম ইজ ওয়ার্কিং ইটসেল্ফ। হঠাৎ ইচ্ছে হল একবার পুরনো পাড়ায় যাই। ফোর্স নিয়ে গেলাম। আমাদের বুথে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, কাকতালীয়ভাবে ঠিক সেই সময়ই এক বৃদ্ধ এসে তাঁর এপিক কার্ড দেখাচ্ছেন পেলিং অফিসারকে। পোলিং অফিসার তাঁকে বললেন, “রূপক সাহা! আপনার তো ভোট দেওয়া হয়ে গেছে! আবার এসেছেন কেন?” একটি রাজনৈতিক দলের পোলিং এজেন্ট বলে উঠল, “না না উনি তো ভোট দেননি।” দীনেশকাকুর ছেলে পোলিং অফিসারের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “ভোট দেওয়ার পরও আবার এসে ঝামেলা করছে, বের করে দিন না, স্যার।” রূপকদা হতাশ হয়ে নিজের মনে বলতে বলতে বেরিয়ে আসছেন, “ভোট দিতে দিবিনা বলে দিতেই পারতি, আসতাম না তাহলে। এভাবে কি আর জনসমর্থন পাওয়া যায়!” আমি একটু আড়াল হয়ে গেলাম, দেখতে পেলেই হয়ত অভিযোগ জানাবে কিছু একটা। কিন্তু এই সেই লোক, যাঁর দৌরাত্ম্যে সেসময় এলাকায় একটা মশাকে উড়তে হলেও লোকাল কমিটির পারমিশন নিতে হত। সবকিছুই ফিরে আসে, আসতে হয়। দিনবদলের ইশারাকে অস্বীকার করবে এমন মূর্খ আর কে আছে। ডিসিআরসিতে তখন আমি খুব ব্যস্ত। একের পর এক পোলিং পার্টি আসছে। হঠাৎ দীনেশকাকুর ছেলে ডাকল, “স্যার, জানি আপনি এসময় খুবই ব্যস্ত। একটু কথা বলা যাবে?” চট করে ভেবে দেখলাম, মিউনিসিপ্যাল ইলেকশন পরের বছরেই। এই উঠতি লিডারকে আনার কাজে লাগবে প্রচুর। সুতরাং একে কিছুটা প্রায়োরিটি দেওয়া প্রয়োজন। “কিছুক্ষণ ওয়েট করতে হবে। সময় হবে তো?” হেসে বললাম। “করছি স্যার।” কিছুক্ষণটা যদিও বেশ কিছুক্ষণই হয়ে গেল। পোল ডে-তে যা হয় আর কি। সবাই ব্যস্ত। সিগারেটের বাহানায় ভেহিকেল সেলের পেছন দিকটায় এলাম। “স্যার, আপনি তো জানেন বাবাকে ওরা কি মারই না মেরেছিল। সেই হিসেব ধরলে আমি তো ওদের শুইয়ে ক্যালাতে…স্যরি স্যার, কিন্তু কিছুই করিনি। আমরা কিন্তু এবার আসছিই স্যার।” আমি ঠিক বুঝলাম না দীনেশকাকুর ছেলে কি বোঝাতে চাইল। শুধু এটা বুঝতে অসুবিধে রইল না যে একাল হোক বা সেকাল, নির্বাচনের চরিত্র বদলায় না…শুধু জার্সির রং বদলে যায়…অবিশ্বাস থেকে আতঙ্ক, আতঙ্ক থেকে অত্যাচারী হয়ে ওঠার প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় কখন যে আমরা সঁপে দিই নিজেদের, খেয়াল থাকেনা। ওপরতলা পর্যন্ত এই টানাপোড়েন, সংঘাতের সব খবর কি পৌঁছয় আদৌ! দুই বন্ধু বা প্রতিবেশী, যারা একই হাওয়ায় শ্বাস নেয়, একই রোদ গায়ে মাখে, একই মাটিতে হেঁটে যায় তারাও নিজেদের অজান্তেই কিভাবে যে একে অপরের চরম শত্রু হয়ে ওঠে! আর এই শত্রুতা পালনের উদযাপনই হল নির্বাচন। কমিশন জানে। নেতৃত্ব জানে। প্রশাসনও জানে। এটুকু জিইয়ে না রাখলে যে ‘নির্বাচনী সন্ত্রাস’ শব্দবন্ধ আর ব্যবহারযোগ্য থাকবে না। সাংবাদিকরা কি করবে তখন! চিত্ত সাহা ও দীনেশ মজুমদার দুই বিপরীত মেরুর হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যুর পর যে মানবিকতার প্রকাশ ঘটেছিল, এই তো সহজাত মনুষ্যপ্রবৃত্তি হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা হয়না বলেই এই সংবাদ আশ্চর্য হয়ে জাগরুক থাকে। এই লজ্জা আমাদেরই। এর চর্চা আমাদের উত্তরাধিকার।