দোঁহা

এ কোন সকাল, রাতের মতই ঝলমল!

 



শুভজিৎ চ্যাটার্জি

খুব সকাল সকাল উঠে গেছি। এখন বাজে ভোর সাড়ে পাঁচটা। তাড়াতাড়ি বাথরুমের কাজ সেরে, এক কাপ কফি বানিয়ে ল্যাপটপটা নিয়ে বসে গেলাম টেবিলে।
গতকাল অনেক রাত অবধি তিনজন ক্যান্ডিডেটকে নিয়ে অনেক গবেষণা করেও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। আজ কাকে ভোট দেবো? গণতন্ত্রের প্রশ্ন আর আমার প্রথম সাংবিধানিক অধিকার। গুচ্ছের ট্যাক্স দেওয়া ছাড়া, দেশের প্রতি আমার একমাত্র কর্তব্য। তাই কাকে ভোট দেবো সেটা ঠিকভাবে গভীর গবেষণা করে ঠিক করা আমার ন্যূনতম কর্তব্য।

প্রথম প্রার্থী এই কেন্দ্র থেকেই গতবারের সাংসদ। প্রবীণ ডাক্তার মানুষ,  দীর্ঘদিন এইমস্ - এ কার্ডিওলজিতে বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। দেশে বিদেশে বিশাল সুখ্যাতি। অবসর নিয়ে তিনি গতবার 'উন্নয়ন' দলের জোড়া কলম চিহ্নে দাড়িয়ে সাংসদ হয়েছেন আমাদের কেন্দ্র থেকে। আর সাংসদ হিসেবে কী রেকর্ড! সংসদে ৯৫ শতাংশ হাজিরা, চোখা চোখা প্রশ্ন। নিজের সাংসদ তহবিল পুরোটা খরচ করে এলাকার রাস্তাঘাট, জলের ট্যাংক, স্টেডিয়াম সংস্কার, একের পর এক সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্বোধন, নিয়ম করে বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন, কি না করেছেন!

তারপর আছেন ' সমাজ ' দলের নতুন প্রার্থী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, তারপর JNU থেকে অর্থনীতি নিয়ে পড়ে, তারপর প্রথম প্রচেষ্টাতেই আইএস অফিসার। এরপর ১০ বছর দাপটের সাথে কাজ করেছেন অর্থ মন্ত্রক, বিদেশ মন্ত্রকে। সাংসদ হলে এলাকার উন্নয়ন কিভাবে হবে সেটা নিয়ে এমন একটা মডেল তৈরি করেছেন, আর বিভিন্ন সভায় সেটা এত সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছেন, মোটামুটি সবাই একমত এই মধ্য তিরিশের তরুণ জিতলে বিরাট একটা কিছু করবেন, সেটায় কোনও সন্দেহ নেই।

আর তৃতীয় জন 'মানুষ' দলের প্রৌঢ়া প্রার্থী, যিনি সামাজিক কাজের জন্য দেশে বিদেশে তুমুল সমাদৃতা। মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিয়ে কাজের জন্য পেয়েছেন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার। তাঁর বাবা ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজে স্বয়ং নেতাজির ডান হাত। এই ৬৫ বছর বয়সে এবার প্রথমবার প্রার্থী। সুললিত কণ্ঠে এত সুন্দর তার কথা, মনে হয় সমাজে সকল মেয়েদের role model উনিই হতে পারেন। এত বড় বড় কাজ করেও থাকেন একটা ছোট্ট এক কামরার ফ্ল্যাটে, যেখানে ৬ মাস আগে স্বয়ং বিল গেটস, মেলিন্ডা গেটস ঘুরে গিয়েছেন ভারতে তাদের ফাউন্ডেশন এর কাজের ব্যাপারে পরামর্শ চাইতে।

সত্যিই কাকে ভোট দেবো? গত ৩-৪ সপ্তাহ ধরে এই তিনজনের অনেক বক্তৃতা, লেখা পড়ে তুল্যমূল্য বিচার করেও ভেবে উঠতে পারিনি। আমার পরিবার, আত্মীয় বা বন্ধু সবার একই অবস্থা।

আর নতুন করে সাংসদ আর কিইবা করবেন এখানে। এখানে এত সুখ, এত স্বাচ্ছন্দ্য, এত সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা, আর প্রতিটা মানুষ এত ভাল চাকরি, ব্যবসা করছে, কী বা করবেন নতুন সাংসদ। কী আর বাকি আছে!? এই স্বর্গের আর কী উন্নতি করা যায়?

ভাবনাটা একটু এলোমেলো হয়ে গেল কারণ হঠাৎ করে খুব গরম লাগতে শুরু করেছে। একবারে দর দর করে ঘামছি। আর শুনতে পাচ্ছি বৌ বলছে "চা খাও, চা খাও"!
তাকিয়ে দেখি বিছানার উপর ফ্যান, ওদিকে এসি সব বন্ধ আর বউ দাড়িয়ে আছে চা নিয়ে। আজ সকাল ৭ টা থেকেই লোডশেডিং।

চা দিয়ে বৌ বলে, "চলো রোদ ওঠার আগে ভোট টা দিয়ে আসি।" ঘুম চোখেই  বিছানার উপর বসে, গরমে দরদর করে ঘামছি আর চা খাচ্ছি। পেপারটা হাতে নিলাম। গতকাল গোটা রাজ্যে ভোট সংক্রান্ত সন্ত্রাসে মোট ১৯ জনের মৃত্যু, আর ভোটের ডিউটি করতে গিয়ে এই ৪৫ ডিগ্রি গরমে ৫ জন ভোটকর্মীর মৃত্যু। ধুস এগুলো আবার কী খবর, এতো প্রতিবার হয়।

অফিস থেকে ভোট দেওয়ার জন্য ছুটি দিয়েছে, একটুও ইচ্ছে ছিল না, তাও ভাবলাম যাই দিয়ে আসি ভোটটা। আঙুলে কালি লাগিয়ে একটা ইনস্টা স্টোরি দিতে তো হবে। আর এই গরমে আর কী করব? অন্তত স্কুলের মাঠে সকালে একটু হাওয়া পাবো আর দু’চারটে বন্ধুর সাথে একটু দেখা তো হবে।

গত ৪-৫ সপ্তাহ বাইরে মাইকে আর টিভিতে কান ঝালাপালা হয়েছে, তাও ভাবলাম দেখি একটু এবারের এই কেন্দ্রের প্রার্থীদের ব্যাপারে? ল্যাপটপটা খুলে একটু পড়লাম তিনজনকে নিয়ে।

আরে প্রথমজনতো আমাদের এখানকার গত চারবারের সাংসদ, " খাবো " পার্টির সর্বভারতীয় কোষাধ্যক্ষ। প্রতিটা জনসভায় বলছেন, " খাবো খাবো, আবার খাবো" !

আর গত ৪০ বছরে রেলে কী বিশাল কেরিয়ার। ওনার যখন ২০-২২ বছর বয়স, তখন দলবল নিয়ে রেলের ওয়াগন ভাঙতেন! আর তারপর একেবারে ৬৫ বছর বয়সে ২ বছরের জন্য দেশের রেলমন্ত্রী। এই তো সেদিন কাতারে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখেছিলেন মিয়া খলিফার সাথে একই বক্সে বসে। নিন্দুকে বলে খুব ইচ্ছে ছিল ওনার হাতে একটা চুমু খাবেন হালকা করে। এই নিয়ে পরে ঘনিষ্ঠ মহলে নাকি নিজেই বলেছেন। কিন্তু মিয়াজির বডিগার্ডের বাইসেপস, আর কলকাতায় স্ত্রী, বারুইপুরে আর বারাসতে দুই বান্ধবীর ভয়ে মিয়াজিকে আর কিছু বলে উঠতে পারেননি।

দ্বিতীয়জন " ক্যালাবো " দলের স্থানীয় বিধায়ক!

এবার সংসদে যাওয়ার জন্য দলকে নাকি নিজের পেট্রোল পাম্প আর প্রমোটারি ব্যবসার গত এক বছরের সব কামাই চাঁদা হিসেবে দিয়েছেন। এমনিতে নাকি খুব শান্ত মানুষ, শুধু রেগে গেলে একটু খুনটুন করে দেন! নিজের প্রথম স্ত্রী, ওনার এক অ্যাকাউন্ট্যান্ট, এলাকার আরেক প্রমোটার আর একজন অতি সুন্দরী অল্প বয়সী মডেল, এই চারটে খুনে ওনার নাম জড়িয়েছিল।  কিন্তু উনি তো শান্ত মানুষ, তাই চারটে কেসে মোট ৩ বছর জেল খেটেছেন, তাও ভয় পাননি। গত পনেরো বছরে মাত্র  চারবার দল বদলেছেন -  ' খাবো ' থেকে ' ক্যালাবো', থেকে ' খাবো ',  থেকে ' ছড়াবো '। শেষে আবার গতবছর ক্যালাবো' তে এসে একটু শান্তি পেয়েছেন। অনেকে আবার বলে ওনাকে পুলিশ খুনের মামলার চার্জশিট দিলেই উনি সেই সময়কার শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হয়ে যান একটু চাঁদা টাঁদা দিয়ে। আসল কারণ হচ্ছে ওনার বার বার একটু  দমবন্ধ হয়ে আসে তো, তাই একটু ঘুরে ঘুরে বেড়ালে ফুসফুসে শান্তি আসে।

আর তৃতীয়জন কে নিয়ে আর নতুন করে কী পড়ব৷ তাঁকে তো রোজই দেখি ইনস্টাগ্রাম রিলে, বউকে লুকিয়ে। তাঁর রিল তো মাঝে মাঝেই কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় ছেলে-বুড়োর দিলে।

বছর দশেক আগে তিন - চারটে সিনেমা, আর গোটা দু’য়েক মেগা সিরিয়াল করেছিলেন। আর এখন দু’একটা ওয়েব সিরিজ করেন মাঝে মাঝে ' লম্ফঝম্ফ ' OTT-তে। আর গত বছর তো রিলের জন্য "রাজ্যের সেরা ইউথ আইকনশ্রী পুরস্কার" পেলেন। আর প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন আগুনে রিল - কখনও ভিয়েতনামে উত্তাল নাচছেন, কখনও শ্যামবাজারে একটা লিকলিকে নেড়ি কুকুরকে জল খাওয়াচ্ছেন আর তার দুঃখে অঝোরে কাঁদছেন, আবার কখনও রাত একটায় নিজের হাসি হাসি মুখের একটা ছবি দিয়ে লিখছেন, "রুমি বলেছেন সকালে খালি পেটে ভেজানো আলমন্ড খেলে সকাল চারটের সময় ব্যালকনিতে গিয়ে রাকেশ রোশনের মতো করে অম অম অম করে ডাকলে আকাশ থেকে জাদু আসে আর ঝাপ্পি দেয়।"

এলাকার নারী আর নেড়িদের জন্য ওনার খুব মন কাঁদে, তাই এবার ভোটে দাঁড়িয়েছেন " ছড়াবো" পার্টির টিকিটে।

ওনাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এবার ভোটে জিতলে এলাকার জন্য কী করবেন? উনি বলেছেন, " দুয়ারে রিল" প্রকল্প চালু হবে। সব ১২-১৮ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েরা পাবে রিল বানানোর প্রশিক্ষণ, আর প্রয়োজনীয় মোবাইল স্ট্যান্ড, আলো ইত্যাদি।

যাহোক ভোট কাকে দেবো, সেটা নিয়ে আর ভাবার কিছু নেই। আমার মনে ব্যাপারটা জলের মত পরিষ্কার, যদিও বউকে বলেছি অন্য কথা।

যাহোক চা শেষ করে, বউকে স্কুটারের পিছনে বসিয়ে যেই বাড়ি থেকে বেরোলাম, চারিদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। কী হলো এটা? এত্ত শিল্প?

তারপর বুঝলাম এলাকায় দুমদাম বোমা পড়ছে। আমি ভীতু মানুষ, সোজা স্কুটি ঘুরিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম বাড়িতে।

কারেন্ট এসে গেছে দেখে বউকে বললাম "লুচি আর সাদা আলুর তরকারি করো, আমি এক ঘণ্টা শুচ্ছি, উঠে খাবো। আজকে দুপুরে আর রান্না করতে হবে না , জেঠু - জেঠির "খসে গেল, ঝুলে গেল"  বিরিয়ানি আনিয়ে নেব।

বৌ বললো " ভোট দেবে না?" আমি বললাম "ধুর, আমার ভোট দিতে আমাকে যেতে হবে কেন?"

বৌ বললো " সেকি, বুথ দখল করে এবারেও ছাপ্পা হবে? এই যে এত কেন্দ্রীয় বাহিনী? "

আমি বললাম, "পাগল! রিগিং কেন হবে? সব তো AI! জানো না গুগল মাইক্রোসফট হাজার হাজার কর্মী তাড়িয়ে সব কাজ AI দিয়ে করাচ্ছে। তো আমার ভোট ছাপ্পা দিতে এবার দুয়ারে AI. কাউকে বলো না, এটা এবার বিটা টেস্টিং হচ্ছে। আমি কাল রাতেই জেনেছি।"

বৌ মুখ বেঁকিয়ে ময়দা মাখতে বসলো। আমি বিছানায় শুলাম কাত হয়ে। ভোটের সকালের নতুন রিল এল কিছু?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন