দোঁহা

একটি কুড়ি বারুদগন্ধে

 



ঋষভ চট্টোপাধ্যায়
  
আমাদের রোজকার মধ্যবিত্ত সংসারগুলো অন্য সময়ে "পলু পিসিরা তোমার ছেলের অন্নপ্রাশনে কেন আসেনি"র মতো জটিলতায় ব্যস্ত থাকে, প্যাচ-পয়জার বলতে বোঝে পৈতৃক সম্পত্তি আদায়ের আইনি ছুতো, আর বিতর্ক বাঁধায় পনের বছরের প্রাণান্তকর বৈবাহিক জীবনে কে প্রাণভরে আয়েশ করেছে আর কার প্রাণ অন্ত হওয়ার জোগাড় হয়েছে সেই নিয়ে। সেই সংসারগুলোই ভোট আসলেই কেমন দুম করে পাল্টে যায়।

বিশ্বাস না হলে কোনো অল্প পরিচিত বা দূর আত্মীয়র (আজকাল অবশ্য সব আত্মীয়ই দূরের) বাড়িতে পরীক্ষামূলক ভাবে ভোটের অনেক দিন আগে আর ভোটের মুখে একবার করে গিয়ে দেখতে পারেন। সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে আপনি ডুবোতেলে বিরোধীপক্ষের ফ্রাই হওয়ার গন্ধ পাবেন। সদর খোলামাত্র সরকার পক্ষের আর্থিক জালিয়াতির ব্যাসনে বানানো বড়া আপনার খিদে বাড়িয়ে দেবে। আর ড্রইংরুমে বসার পর অবধারিত ভাবে আপনি শুনবেন যে কিভাবে বিশেষ কোনো একটি দল পরিবারের কোনো একজন ব্যক্তির সকল ব্যর্থতার মূল কান্ডারি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

ব্যাপারটা হল, আমরা বাঙালিরা এক রবিঠাকুর আর ঘটি-বাঙাল ছাড়া আর কিছুকে চট করে খুব একটা পার্সোনালি নিই না। কিন্তু এই জাতিগত ঐতিহ্য ইলেকশন এলেই হাওয়া হয়ে যায়। বাড়ির বাতাসেই আপনি একটা তীব্র রাজনৈতিক গন্ধ পাবেন। বুঝতে পারবেন, এতদিন আত্মসুখ ও পরদুঃখে তুমুল ব্যস্ত থাকা বাঙালি হঠাৎ করে সচেতন নাগরিক হয়ে উঠেছে।

সাধে কী কবিগুরু বলেছিলেন- "না জানি কেন রে এতদিন বাদে জাগিয়ে উঠেছে প্রাণ", ইত্যাদি। তা এহেন 'হঠাৎ জাগরণ' ঘটার ফলে যেটা হয় সেটা হল যে, পরিবারের লোকজন রাজ্য বা দেশের পরিস্থিতিকে বেশ ব্যক্তিগতস্তরে নিয়ে আসতে শুরু করে। কীরকম জিনিসটা? ধরুন, বাড়ির কর্তার DA আটকে আছে বহু বছর ধরে, অতএব তিনি সরকারবিরোধী। মানে অন্তত এই ভোটে সরকারবিরোধী। কারণ পাল্টি সাধারণ মানুষেও খায়, সবাই মিছেই নেতানেত্রীদের দোষ দেয়। সে যাই হোক, যা বলছিলাম-ওদিকে বাড়ির কর্ত্রী নিয়মিত লক্ষীর ভান্ডারের টাকা পাচ্ছেন। আর যদি তিনি হোমমেকার হন তাহলে তো কথাই নেই। সেই যে স্বামী-শ্বশুরের চক্রান্তে, নিজের যোগ্যতায় পাওয়া চাকরি ছেড়ে ঘরে বসে গিয়েছিলেন বছর কুড়ি আগে, সেই ক্ষোভের আগুন মনের মধ্যে আজও তো ধিকিধিকি জ্বলছে! 

শুধু কী তাই? একটু নিজের মনোমত খরচ করলেই কর্তার ঠেস দেওয়া কথা শুরু। লক্ষীর ভান্ডারের টাকা যতই কমহোক, প্রশ্নটা সম্মানের, প্রশ্নটা হাত না পাতার। অতএব সরকারের পক্ষে তাঁর যে একটু নরম জায়গা থাকবে, সেটা স্বাভাবিক।
ওদিকে পরের প্রজন্মের যিনি দশটা অবধি ঘুমোচ্ছেন, তিনি বছর ছয়েক আগে না জানি কেন হঠাৎ হিন্দু-জাগরণে ব্রতী হয়েছেন। ত্রিশূল হাতে রামনবমীর দিনে বাইকবাজি করলে কেমন করে হিন্দু-জাগরণ হবে তা আমাদের কাছে যতই ধন্দের ব্যাপার হোক, ওনার কাছে এই নিয়ে কোনো সংশয় নেই। রাজনৈতিক পছন্দ অপছন্দের ক্ষেত্রেও তাই মা-বাপের কারোর সাথে বনেনা তার।
        প্রায়শই, মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের ছবিটা ইদানিং অনেকটা ঠিক এরকমই দেখা যায় |    
          সারাবছর রাজনীতির সংসর্গকে জাত যাওয়ার মতো পাপ মনে করা মানুষ যখন দুদ্দাড় গতিতে রাজনৈতিক হয়ে ওঠে, তখন সেটা সার্বিক বা মানুষের স্বার্থে হওয়া সম্ভবও না | দেশের ভালো বা দশের মন্দ যাতেই হোক, নিজের জমানো ক্ষোভ বা পাওয়া সুবিধার পরিপন্থী কোনোভাবেই হওয়া যাবেনা | মজার ব্যাপার হল এই যে পরিবারের মধ্যে রাজনৈতিক দলাদলি, সেটার ইতিহাস কিন্তু অনেক গভীরে শিকড় ছড়িয়ে রেখেছে | কী রকম ? 
                       আমার নিজের মাতুলালয় সমকালের বঙ্গ-রাজনীতির একেবারে আদর্শ খন্ডচিত্র তুলে ধরে | আশির দশকের শেষদিকের কথা বলছি | সিপিআই (এম) ক্ষমতায় ভালো রকম জাকিয়ে বসেছে ততদিনে, অপারেশন বর্গা প্রায় সফলভাবেই সদ্য শেষ হয়েছে, ভয়ানক পুলিশি নিষ্ঠুরতার সৌজন্যে নকশাল আন্দোলনও প্রায় স্তিমিত | এই যখন বাইরের পরিস্থিতি, ঠিক সেই সময়ে যদি আমার মাতুলালয়ে নজর দিই আমরা তাহলে অনেকটা এইরকম একটা ছবি পাওয়া যাবে | 
          আমার দাদুর বাবা ছিলেন বাঁকুড়া শহরের যাকে বলে বিজনেস টাইকুন | বিশাল পৈতৃক সম্পত্তি, অন্তহীন প্রজণ্মগত ঐশর্য্য আর পায়ের নীচে কাজ করার জন্য একটা দক্ষিনবঙ্গীয় মফসলের হাজারো গরিব দলিত | হিসেবমতো জমিদারি কোনোকালেই ছিলনা ঠিকই, কিন্তু যে পর্যায়ে নিজের ব্যবসাকে নিয়ে গিয়েছিলেন আর যত লোকের জীবিকা ওনার উপরে নির্ভর করতো তাতে করে ছাপ্পামারা সামন্ততান্রিক প্রিভিলেজকে অস্বীকার করা যায়না | অর্থবল এতটাই ছিল যে আজ বাঁকুড়া শহরের একটা বিশেষ পাড়ায় গেলে সারি বেঁধে ওনার বংশধরদের বাড়ি দেখতে পাওয়া যাবে | আস্ত একটা পাড়া শুধু একটাই বিশাল বটগাছের হাজারো ঝুরির বাস | এই এত টাকা, ক্ষমতা সবের মুলে রয়েছে একটি প্রভূত লাভজনক বিড়ি বাঁধাই কারখানা যেটাকে এক ডাকে গোটা শহরের যে কেও চিনতো | পুরাতন নিবাস যে প্রতন্ত্য গ্রামে, সেখানেও সম্পত্তির বহর কম ছিল না |
              শাসকগোষ্ঠীকে হাতে না রেখে কেই বা কবে ব্যবসা করতে পেরেছে? আমার প্রমাতামহও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না | তাঁর ব্যবসার সমস্ত বাড়বাড়ন্তই মূলত কংগ্রেস আমলে | এখন তিনি আদর্শগত ভাবে কংগ্রেসি ছিলেন নাকি 'বাণিজ্যে বসতে রাজনীতি'-র সূত্রে কংগ্রেস করতেন, সেই উত্তর সময়ের গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে | তবে এইটুকু নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এমার্জেন্সির ঝড় আসার অনেক আগেই নিজের সাম্রাজ্য বেশ পোক্ত হাতেই গড়ে ফেলেছিলেন বিধান রায় আর প্রফুল্ল সেনের আমলে | '৬৭ তে ইউনাইটেড ফ্রন্ট গঠন হওয়ার পরেও সেই বিত্ত বা প্রভাব বড়ো একটা নড়বড়ে হয়নি | 
                       আমার দাদু রাজনৈতিক আদর্শ সম্ভবত পিতৃসূত্রেই পেয়েছিলেন | আজীবন মন থেকে কংগ্রেসি ছিলেন | প্রচন্ড পরিশ্রমী এবং কর্মঠ মানুষ ছিলেন, কিন্তু ব্যবসার জন্য যে বিশেষ রকম বুদ্ধি লাগে, সেটা পিতার মতো বুঝি ছিল না | দাদু যখন কারখানার হাল ধরলেন এবং নিজে লোহার ব্যবসা শুরু করলেন, ততদিনে রাষ্ট্রপতির শাসন শুরু হয়ে গিয়েছে | নকশাল আন্দোলন ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছে, গোটা কলকাতা উত্তাল | তার আঁচ মফফসলেও পড়তে বাকি নেই | ব্যাপক আর্থিক দুর্বিপাকের মাঝে পড়ে ব্যবসা পড়তে শুরু করল | এদিকে গোটা রাজ্যব্যাপী শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাবে কারখানায় শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে | যে শ্রমিকদের সঙ্গে দাদুর দাদা-ভাইয়ের মতো সম্পর্ক, তাদের কাছে শ্ৰেণীবৈষম্যের বাস্তবতা নতুন করে ধরা পড়ছে | সৌজন্যের আড়ালের লাভের হিসাব আর ঢাকা পড়ছে না সূক্ষ্ণ আন্তরিকতায় | পেটে ভাতের পরিমানের উপর সম্পর্কের সমীকরণ নির্ভর করে | যে শ্রমিকদের কোলে পিঠে মা মামারা মানুষ, তাদের সঙ্গেই দাদুর সম্পর্কের সমীকরণ বদলাতে শুরু করেছে | শুরু হয়ে গেল অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ এবং শেষমেশ ঘেরাও | মা'র থেকে গল্প শুনেছি শ্রমিকরা বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছে, শত রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না | শেষমেশ মায়ের শরীর খারাপ হওয়ায় হাসপাতাল নিয়ে যেতে দেওয়া হয় | 
                    '৭৮ নাগাদ অপারেশান বর্গা হল | গ্রামের প্রভূত জমিজমা সরকারি খাতায় জমা পড়ল | ততদিনে ব্যবসার হাল পড়তে শুরু করেছে | সব মিলিয়ে এককালের বর্ধিষ্ণু পরিবার চরম আর্থিক দৈন্যের মুখে এসে দাঁড়ালো | ইতিমধ্যে দাদুর সন্তানেরা সবাই কলেজ রাজনীতির সূত্রে বামপন্থী ভাবধারায় দীক্ষিত হয়েছে | বাড়তি জমিজমা সরকার নিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কাগজপত্র সইসাবুদ করছেন দাদু, ওদিকে আমার মামা-মাসিরা অন্তহীন পৈতৃক সম্পত্তির বিরুদ্ধে ৱ্যালি করছে শহরজুড়ে | লক আউট হওয়ার আগে অবধি নিয়মিত শ্রমিক আন্দোলন চলেছে বিড়ি কারখানায় | লাভের অঙ্ক সঙ্কুচিত হতে হতে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে দাদু চাইলেও শ্রমিকদের বাড়তি বেতনের দাবি মানতে পারছেন না | দিনের পর দিন কারখানা বন্ধ, উৎপাদন বন্ধ, মুনাফা এবং মজুরি দুই-ই বন্ধ | ট্রেড ইউনিয়নগুলি গোটা রাজ্যজুড়ে নিজেদের ব্যাপক দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে | তার মধ্যে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনও কম না সংখ্যায় | ক্ষমতায় থাকা সরকারের প্রতি তাদের বিশ্বাস হারিয়েছে | আদর্শগত ঘনিষ্ঠতার ফাঁকা বুলিতে আর চিড়ে ভিজছে না | ঘরে চিড়ে থাকলে তবে তো ভিজবে ! 
                 রীতিমতো মার্ক্সিস্ট তত্ব পড়ে যে বিপুল সংখ্যক তরুণ-যুবরা বামপন্থী রাজনীতি করতে এসেছিল সেই সময়, আমার মামা ছিলেন ঠিক সেই সম্প্রদায়ের মানুষ | বাম জমানার শেষদিকে দুর্নীতির বেনোজল যখন রাজ্য ডুবিয়ে দিচ্ছে, গায়ে কাদা লাগেনি এমন কিছু মানুষ তখন ছিল | ৩৪ বছর সুযোগ পেয়েও প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়ে নেয়নি এমন কিছু কমুনিস্ট তখনও ছিল | 2011 র পরে ভেড়ার পালের মতো সরকারপক্ষে যোগ দিতে ছোটেনি এমন কিছু কমুনিস্ট তখনও ছিল | যাই হোক, তো '৮৪, '৮৫ র এই সময়গুলোতে দাদু আর মামা কোথায় অবস্থান করতেন বলে দিতে লাগেনা | আজীবন কংগ্রেসি দাদু এমার্জেন্সি শুরু হওয়ার পর ছেলেমেয়েদের সামনে আর নিজের দলকে সমর্থন করার মতো কিছু খুঁজে পেতেন না | পরিবারের মধ্যে জনসমর্থন হারিয়ে বাধ্য হয়ে বামেই সমর্থন করতেন |যদিও মা'দের বরাবরই সন্দেহ ছিল--- মুখে যাই বলুন, দাদু ভোটটা ঠিক হাত চিন্হেই দিয়ে থাকেন | পিতৃসূত্রে পাওয়া রাজনৈতিক আনুগত্য বড়ো দায়--- জমিদারের সামনে মজুরের শতাব্দী-প্রাচীন আনুগত্য ভেঙে যায়, তবু এই দাসবৃত্তি মরমে পশিল রে!           
                    ২৪ বছরের আমার মামা কলকাতায় পড়তে এসে নকশালদের উপর ভয়াবহ পুলিশি অত্যাচার একেবারে কাছ থেকে দেখতে পান | গোটা শহরটা জুড়ে সদ্যযুবক কিছু লাশের ঢের তৈরী হচ্ছে | প্রতিদিন সকালে উঠে উত্তর কলকেতার কোনো না কোনো গলির পাশে ড্রেনে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ দেখে ইউনিভার্সিটি যান | প্রায়দিন সন্ধেবেলা মেসের দেয়াল ভেদ করে আসা গুলির শব্দে পড়ার ছন্দ কেটে যায় | বাংলার তরুণ সমাজের মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করছে লাশের উপর বসা শকুনমুখী পুলিশ | কংগ্রেস আমলের পুলিশ আর বাম জমানার পুলিশের মধ্যে ফারাক করতে পারেন না তিনি | একদিকে ট্রেড ইউনিয়নের দাবি-দাওয়ার প্রতি সরকারি গয়ংগচ্ছ ভাব আর অন্যদিকে নিজের বাড়ি ঘেরাও করা শ্রমিক ঐক্যের মাঝে নিজের অবস্থানটা বারবার গুলিয়ে যায় তাঁর | কলেজে পড়ার সোজা সাপ্টা রাজনৈতিক দিনগুলোকে কোন দূরের স্বপ্ন মনে হয় |  
                আমাদের দেশে ধর্মপরিচয়ের মতো দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্যও প্রায়শই বংশানুক্রমে আসে | আমরা যখন বালক থেকে কিশোর হয়ে উঠছিলাম, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে তখন আগুন জ্বলছে,  তখন আমরা দেখতাম বেড়ে ওঠা সন্তানদের রাজনৈতিক আদর্শ চয়ন করার কোনো জায়গা ছিল না আমাদের মতো পরিবারে | কেও কোনোদিন বলেনি যে বামপন্থী হতে হবে; বলেনি কারণ এটা ছাড়া আর হওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনেই করা হতনা | CPM এর তৎকালীন দুর্নীতি, বিপুল বেনোজলে পার্টির মধ্যে ঢুকে পড়া এসব নিয়ে সমালোচনা অবশ্যই হত রাতের ডিনার টেবিলে বসে, মায়ের মুখে একটা খুব কাছের কারোর বেইমানির কষ্টের ছাপও দেখতে পেতাম সবসময় --- কিন্তু আদর্শ বদলে অন্য দলের হয়ে যাবো বা পার্টিকে সমর্থন করা বন্ধ করে দেব, এসব কল্পনারও অতীত ছিল | একই গৃহশিক্ষকের কাছে সকলের পড়ার মতো করে, বাড়ির ব্যবসায় প্রশ্নহীনভাবে নেমে পড়ার মতো করে ওই আদর্শে তুমি দীক্ষিত হয়ে যাবে, এরকমই দস্তুর ছিল | তুমি ব্যবসা নিয়ে আদৌ আগ্রহী কিনা, হলেও এই ব্যবসায় আগ্রহী কিনা, বা এই ব্যবসা করতে চাইলেও বাড়ির ব্যবসার নিয়মনীতি তোমার পছন্দ কিনা এসব প্রশ্ন করার কথা আমাদের মাথায় আসেনি--অন্তত তখন তো আসেইনি | কোনো বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শে সাবস্ক্রাইব করা বা না করা কখন যে পারিবারিক মর্যাদার সঙ্গে জুড়ে গেল আর কেন জুড়ে গেল, সেসব বোঝার মতো বয়েস তখন আমার ছিল না |  
             আরেকটু বড়ো হতে বুঝেছিলাম, আমাদের মতো মধ্যবিত্ত, কমুনিস্ট, ঘটি পরিবারে মোহনবাগান আর সিপিএম-এর প্রতি আনুগত্যটা 'মায়ের দিয়ে যাওয়া সোনার বালগোপাল'-এর মতো করে আসে | ভুল করেও ভাববেন না, বিষয়টা শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক আদর্শের | আমরা যারা নব্বইয়ের সন্তান, আমরা যারা একটা ভীষণ সংবেদনশীল বয়েসে নন্দীগ্রাম হতে দেখেছি; আদর্শের থেকে দল ঠিক কিভাবে আর ঠিক কতটা বড়ো হয়ে উঠতে পারে, সেটা আমাদের অজানা নয় | তাছাড়া একটু আগেই প্রমাতামহ আর মাতামহের বংশানুক্রমিক কংগ্রেসি আনুগত্যের কথা তো বললামই |   
                উচ্চমাধ্যমিকের ঠিক কদিন পরেই যে দলটা ৩৪ বছরের শাসনে দাড়ি টেনে ক্ষমতায় এলো, গোটা কলেজ জীবন জুড়ে তাদেরকে দুর্নীতির অন্ধকারের নিমজ্জিত হতে দেখে, ভাবী বেকারত্বের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে গুনতে আমরা বুঝেছিলাম দলীয় রাজনীতি যখন পৈতৃক মাতৃক সম্পত্তি হয়ে যায়, তখন কী যুগ নেমে আসতে পারে মানুষের উপর | শিক্ষা-দুর্নীতিতে চাকরি না পাওয়া সমবয়সী যুবক-যুবতীদের উপর পুলিশি লাঠিচার্জের ভিডিও দেখতে দেখতে আমরা জেনেছিলাম যে, যে জাতির কাছে একবার রাজনৈতিক আদর্শের থেকে দল বড়ো হয়ে গিয়েছে, তার কাছে আদর্শহীনতাকেই রাজনীতির বীজমন্ত্র বানিয়ে ফেলা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা | 
                    কিন্তু তবু ফারাক ছিল | আমাদের কৈশোর আর যৌবনের বৃহত্তর বাঙালি সমাজের রাজনীতি-মনস্কতার মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল | অন্তত হাতে একটা বা দুটো পাঁচশ'র নোট দিয়েছে বলে নারী-পুরুষ কারোরই চাকরি নেই সে কথা বেমালুম ভুলে যাবো; বা DA পেয়েছি কি পাইনি শুধুমাত্র এটার উপরে আমার রাজনৈতিক সমর্থন নির্ভর করবে--- আত্মকেন্দ্রিকতার এতো গভীর খাদে নামতে আমাদের তখন দেরি ছিল | নিজের এবং নিজের পরিবারের আর্থিক স্বার্থের কথা চিন্তা করা কোনোভাবেই নীতিগত অন্যায় নয়, সরকার আমার দিকটা দেখছে কিনা সেটা নিয়ে ভাবিত হওয়া শুধু স্বাভাবিক নয়, উচিতও বটে; কিন্তু আত্মস্বার্থ ছাড়া রাজনৈতিক সমর্থন নির্ধারণের ক্ষেত্রে আর কোনো মানুষের কথা ভাববো না, এটা কী আদৌ সচেতন রাজনৈতিক নাগরিক করে তোলে আমাদের ? এইভাবে অন্যের হয়ে কথা না বলতে বলতে, আমাদের নিজেদের হয়ে কথা বলার মতো লোক বেঁচে থাকবে তো ? বৃত্তের মধ্যে ক্রমহ্রাসমান ব্যাসার্ধের বৃত্ত আঁকার এই যে অভ্যাস, এর                  ফলে নিজের অজান্তে নিজেদেরই কোনদিন বৃত্তের বাইরে ঠেলে দেব না তো ? 
                          এই যে এতো কথা এতক্ষন ধরে বললাম, এ পুরোটাই আমার বংশের গত ষাট বছরের রাজনৈতিক আদর্শগত ইতিহাস | আমার বেড়ে ওঠার সময়কাল জুড়ে এবং এখন নিজের আশেপাশে তাকিয়ে যতটুকু যা বাঙালি পরিবারকে পর্যবেক্ষণ করেছি তাতে করে আমার এই ইতিহাসটাকে আমার একার ইতিহাস বলে মনে হয়নি | হলে হয়তো ভালোই হত, কিন্তু যত বেশি পর্যবেক্ষণ করি আমাদের এই ইতিহাসের এক বা একাধিক অধ্যায় বহু সমকালীন বাঙালি পরিবারের মধ্যে খুঁজে পাই | এক বা একাধিক একই রকম চরিত্র, তাদের মধ্যে হওয়া একই ধরণের কল্পিত সংলাপ বারবার চেতনায় ধরা পড়ে | চেনা কিছু দ্বন্দ্ব, জানা কিছু উত্তরহীনতা, কিছু ব্যর্থতা, কিছু না করা আত্মসমীক্ষা ঘুমের আগের মুহূর্তে স্থবির জীবনে গতি এনে পালায় | 
                ক্ষমতায় আসা, ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়া এবং বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় থাকা লোকজন তো আমাদের হতাশ করেইছে, জাতি হিসেবে আমরা কি নিজেদের হতাশ করে বসলাম ?  এতো বিবিধ বারুদগন্ধে আমাদের রাজনৈতিক চেতনার কুঁড়িগুলো কবেই অকালে ঝরে গিয়েছে আমরাই নিজেরাই হয়তো বুঝতে পারলাম না 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন