দোঁহা

কিসি কে বাপ কা হিন্দুস্তাঁ থোড়ি হ্যায়!

 


অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

৪ঠা জুন, ২০২৪। রাত ১০টা বেজে ২মিনিট। চব্বিশের সাধারণ নির্বাচন এখনও অবধি সম্পূর্ণ নয়। বেশ কিছু আসনে এখনও ফল ঘোষণার অপেক্ষা। তদুপরি চব্বিশ ঘণ্টা না কাটতেও ‘মোদী’ সরকার থেকে ‘এনডিএ’ সরকার হয়ে যাওয়া শাসকদল – এখনও অবধি কিন্তু মাননীয়া রাষ্ট্রপতির কাছে সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে উঠতে পারেনি। যদিও অঙ্কের হিসেবে এনডিএ জোটের নিরাপদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তবুও আসন-সংখ্যার বিচারে বিশেষ যে দুইটি রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্বের নাগালেই এখন সরকার গঠনের প্রধান চাবিকাঠি, পালটি খাওয়ার বিচারে সেই দুইজনেরই পূর্ব-ইতিহাস কোনওভাবেই ভোলার নয়। কাজেই নির্বাচন মিটলেও, তার উত্তেজনা এখনই মিটছে না। এই ফলাফলের উপর তর্ক-বিতর্ক-বিশ্লেষণ চলবে। সে মূলত রাজনীতিক অথবা সমাজতাত্ত্বিকদের বিষয়। কিন্তু সাহিত্য-বিষয়ক পরিসরে এই ভোটের ফলাফল নিয়ে সামান্য কিছু কথা বলার উৎসাহ কিছুতেই সামলানো গেল না। কথা বলতেই হল।

বহুবার গুরুদেবের সেই বাণী নিজেকে সাহস দেবার প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়েই মনে মনে উচ্চারণ করে এসেছি। তিনি বলেছিলেন ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ তাঁর জীবনের শেষ জন্মদিনে কবির মুখে উচ্চারিত হয়েছিল এই অমোঘ সত্যস্বর। অথচ দশক-ব্যাপী এই তীব্র হিংসার পরিবেশ, নিরবিচ্ছিন্ন বিভাজনমূলক উসকানি, ক্ষমতার চরম দম্ভ, ইত্যাদি সমস্ত কিছুকে পেরিয়ে চলতে চলতে সেই বিশ্বাসেও ফাটল ধরেছিল বোধহয়। ইদানীং ব্যক্তিগত পরিসরে একাধিকবার বিরূপ মন্তব্য করেছিলাম। মন্তব্য করেছিলাম সাধারণ ভারতীয় জনতার ‘গণতন্ত্রবোধ’ নিয়ে। হতাশা প্রকাশ করেছিলাম, এবারেও বোধহয় দেশের সংবিধান চরম অস্তিত্ব-সংকটে ভুগলেও, এদেশের মানুষ ধর্মীয় রাজনীতিতেই আস্থা রেখে চলবেন। মন্তব্য করেছিলাম।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে, এও বলেছিলাম – একান্ত পরিসরেই, যদি কোনওভাবে আমার এই বক্তব্য ভারতীয় জনতা ভুল প্রমাণ করে, তাহলে কেবল ব্যক্তিগত পরিসরেই নয়, প্রকাশ্যে, আমার পক্ষে যতটুকু প্রকাশ্য-পরিসর সম্ভব – সেই অবধি পৌঁছিয়ে সেই জনতার কাছে মার্জনা চেয়ে নেব। স্বীকার করব তাঁদের অপরাজেয় অস্তিত্বকে। আজ সেই নম্র হওয়ার সময়। ভারতীয় জনতা আমাদের ভুল প্রমাণ করেছেন। ভুল প্রমাণ করেছেন আমাদের মতো অগণন শহুরে ভদ্রলোক-আঁতেল-আরবান-সমালোচকদের। কারণ তাঁরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, গ্রামীণ ভারতবর্ষ থেকেই শাসকের বিভাজনমূলক রাজনীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো রায় ভোটবাক্সে জমা পড়তে পেরেছে। আমাদের চেয়ে তাঁরা অনেক বেশি রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়েছেন। অযোধ্যার মন্দিরনগরীতেও জনতার রায় বিভাজনের হিংসার বিরুদ্ধে গিয়েছে। মহারাষ্ট্রের চরম সাম্প্রদায়িক প্রচার-পরিমণ্ডলকে তুচ্ছ করে, সেখানকার মানুষ সংবিধান, সত্য ও স্বদেশের ধারণার প্রতিই আস্থা রেখেছেন। হরিয়ানা, রাজস্থান, পঞ্জাব, তামিলনাড়ু, মণিপুর – বিবিধ জায়গা থেকে বিভাজনের বিরুদ্ধে রায় উঠে এসেছে। বহুত্ববাদের ভারতবর্ষ হারিয়ে যায়নি। আমরাই বরং কোনওদিন তাকে খুঁজে দেখতে চেষ্টা করিনি। কেবল আস্থা রেখেছিলেন গান্ধী-পদবীধারী সেই ‘যুবক’। দশকের পরে দশক, চরম-তাচ্ছিল্যবাণ সয়েও, তিনি জোড়বার কথা বলেছিলেন। আরও অনেক মানুষ তাঁকে সহায়তা করেছিলেন। আমার সৌভাগ্য, আমি সেই যাত্রার সপক্ষে একাধিকবারে কলম ধরেছিলাম। আমার সৌভাগ্য দেশব্যাপী বিভাজনের হিংসার বিরুদ্ধে আমি একাধিকবারে অক্ষর সাজিয়েছিলাম। তবুও আমার শহুরে-বুদ্ধিজীবী মন, আমাকে ‘বিশ্বাস’ করিয়ে উঠতে পারেনি। মোহনদাস গান্ধীর সেই উচ্চারণ, “ভারতবর্ষ মানে তার ৭৪,০০০ গ্রাম”, আমি বিস্মৃত হয়েছিলাম। আদতে আমরা কোটেশন মুখস্থ করে থাকি। পরীক্ষায় নম্বর পাওয়া ব্যতীত যার কোনও অর্থবহ অস্তিত্ব নেই। এই সমালোচনা তাই আমার নিজেরও উপরে আজ।

আরও শহুরে ভদ্রলোক যাঁরা, একটু ফিরে দেখা যাক – তাঁরাই বা কতখানি রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন। কলকাতা অথবা মুম্বাই এই বিষয়ে ভালো ফল রেখেছে। তাঁদের রায় সংবিধানের সপক্ষে গিয়েছে। কিন্তু রাজধানী দিল্লী অথবা প্রযুক্তিনগরী বেঙ্গালুরুর মানুষ? দুই শহরেই কেন্দ্রীয় শাসক দল সংশ্লিষ্ট প্রতিটি লোকসভা আসনে জয়লাভ করেছে। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, কোনও মানুষ, অথবা ভোটাধিকার প্রাপ্ত নাগরিক নির্দিষ্ট কোনও দলের পক্ষে বা বিপক্ষে যে কোনও মত প্রকাশ করতে পারেন। সেই সূত্রে তাঁদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অধিকার আমার নেই। কিন্তু আমার সেই অধিকার আছে, যখন আমরা দেখতে পাই তাঁদের সেই সমর্থন কোনও সংবিধান-বিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী, দেশবিরোধী দলের সপক্ষে গিয়ে জমা পড়ছে। এবারের নির্বাচন, কেন্দ্রীয় শাসকদলের নিজস্ব প্রচারের কারণেই সংবিধানরক্ষার নির্বাচনে পরিণত হয়েছিল। দেশের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে সযত্নে রক্ষার নির্বাচনে পরিণত হয়েছিল। ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে মৌলিক অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, এমন একাধিক প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যকে নিজের সবটুকু দিয়ে রক্ষার নির্বাচনে পরিণত হয়েছিল। কাজেই যে দল তাদের প্রচারে সরাসরি দেশের একাধিক বর্গের মানুষদের হুমকি দিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে চায়, সংবিধানের পবিত্রতাকে অসম্মান করতে চায়, বহুত্ববাদের সমস্ত অস্তিত্বকে নির্মূল করতে চায় – সেই দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়াটা তখন আমাদের সাংবিধানিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। দুঃখের সঙ্গে দিল্লী এবং বেঙ্গালুরুর ফলাফল আমাদের মানতে বাধ্য করেছে – শহুরে ‘ভদ্দরলোকেদের’ পরিবর্তে গ্রামীণ ‘চাষা-মজুরেরাই’ অনেকাংশে সেই কর্তব্য পালন করে দেখিয়েছে। আমাদের স্বীকার করা উচিত।

অবশ্য ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণাতেই একথা বলতে চাইব, গুজরাত গণহত্যার আগেই, (অর্থাৎ কিনা আমাদের বর্তমান ‘প্রধানমন্ত্রী’র ব্র্যাণ্ড হয়ে উঠবারও অনেক আগেই), খোদ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বরিষ্ঠ অধ্যাপক, আবাসিক অধ্যাপকদের দুর্গোৎসব অনুষ্ঠান চলাকালীন এক ভিন্নধর্মী অধ্যাপকের সেই উৎসবে অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার বীজ তাহলে কি সত্যিই প্রথাগত শিক্ষার উপরে নির্ভর করে না? নাকি প্রথাগত ডিগ্রিধারীদেরই সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়ার সম্ভাবনা অধিক? কিন্তু একথা অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও সত্য, যে একই সময়ে, (বা কাছাকাছি সময়ে দাঁড়িয়ে) পূজারী রামদাস রামজন্মভূমি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একজন ‘হিন্দু পূজারী’ হয়েও উচ্চারণ করছেন, “ভগবান যে স্থানে রয়েছেন, তাই তো মন্দির। কাজেই মন্দির-মসজিদের আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে লড়ালড়ি করে কি লাভ!”, তার কিছুকাল পরেই অনেক ডিগ্রিধারী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য এক প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট, বরিষ্ঠ অধ্যাপক চরম সাম্প্রদায়িক ব্যবহারের নজির রেখে চলেছেন। আমরা বরাবরই সুবিধেবাদী, সুযোগসন্ধানী মানুষ। আমরা গ্রামীণ মানুষদের কাছে মাথা নোয়াতে অপমান বোধ করি।

তবুও কি শহুরে মানুষেরাও এই লড়াইতে একেবারে অনুপস্থিত ছিলেন? একেবারেই তা নয়। নির্বাচন কমিশনের আমলা-আধিকারিকেরা চরম পক্ষপাতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যমের কথাও প্রায় না বললেই হয়। তবুও যে অজস্র সংখ্যাতে স্বাধীন সাংবাদিক, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে জনমত গড়ে তুলতে চাওয়া মানুষ সংবিধানরক্ষার এই লড়াইতে শামিল হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যেও শহুরে-পরিসর থেকে উঠে আসা মানুষের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না একেবারেই। এতদসত্ত্বেও শহর-কেন্দ্রিক অঞ্চলগুলি থেকে সংবিধানরক্ষার এই লড়াইতে আরও ব্যাপক সংখ্যায় গড়পড়তা সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের হার আরও একটু বেশি হতে পারত বলে মনে হয়। সবশেষে তবুও বলব, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ” – এরচেয়ে বড় সত্যি নেই।

শাসক-বিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দলেরও বোধহয়, নেতাদের একাংশেরও বোধহয় এই নির্বাচন পরবর্তীতে নম্রতার পাঠ নেওয়া উচিত। করুণা করে নেতৃবর্গ ভোটে দাঁড়িয়েছেন বলেই, তাঁদের জ্ঞান-বুদ্ধিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মানুষ তাঁদের ভোটের ঝুলি আশীর্বাদে ভরে দেবেন – এই বিশ্বাস গোড়া থেকে ভুলে যাওয়ার সময় এসেছে। ‘সব জানে জনতা’ এখন আর রসিকতার শ্লোগান নয়। ‘জনতাকে শ্রদ্ধা করতে শিখব’, অঙ্গীকার যেন থাকে এইটুকুই। এই নির্বাচন, নেতা থেকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ – আমাদের কাছে আত্মশিক্ষার নির্বাচন হয়ে রইল। একদিকে যেমন আমরা জানলাম, শত্রু যতই পরাক্রমশালী হোক না কেন – সে যত বেআইনেরই আশ্রয় নিক না কেন, সত্যের সাফল্য সুনিশ্চিত। দেরীতে হলেও তাই। আগে হলেও। অন্যদিকে আমরা গ্রামীণ ভারতবর্ষের শক্ত কাঁধে ভর দিয়েই সরাসরি বিভাজনসৃষ্টিকারী প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট উচ্চারণ ছুঁড়ে দিলাম,

‘সভি কা খুন হ্যায় শামিল, ইয়াহাঁ কি মিট্টি মেঁ – কিসি কে বাপ কা হিন্দুস্তাঁ থোড়ি হ্যায়!’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন