দোঁহা

মুখ

 



 
অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

আজকাল গড়পড়তা চাকরি অথবা জীবনের বিষয়টা অনেকাংশে ঝাঁ চকচকে হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর মতো ব্যাপার। একশো কি দেড়শো কিলোমিটার অবধিও গতিবেগ উঠে যায় অনায়াসেই। আবার মুহূর্তেরই অনিশ্চয়তায় গাড়ি ছিটকে যায়। হাড়গোড়, উইণ্ডস্ক্রিণ, গ্লাস-ওয়াইপার সমস্তকিছুই দুমড়েমুচড়ে দ’ হয়ে পড়ে থাকে ব্যুলেভার্ডের ওপাশটায়। কেউ কোনও খবর রাখে না। আবার হয়তো তার পাশ দিয়েই, ভাঙাচোরা কাচের জানালা আর স্টিলের তোবড়ানো ফ্রেম, তাদেরই শিকড় ধরে ঘাস গজায়। ফুল ফোটে। হাওয়াতে সে ফুল মাথা দোলায়। একেকটা মুখ ভেসে ওঠে। যেমনটা ভেসে উঠতে দেখেছিল অরিন্দম।

“মুখ ভেসে ওঠা জিনিসটা ভারী সুন্দর। স্মৃতি যেন তখন রক্ত-মাংসের অডিও-ভিজুয়াল রূপ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। সত্যিই সেবারে লিটল ম্যাগাজিন উৎসবে গিয়ে পড়ব ভাবিনি।” অরিন্দম বলেছিল আমায়।

অরিন্দমের জীবনে তখন মেঘ।

একদিকে উচ্চশিক্ষার্থে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার ডাক, অন্যদিকে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের টানাপোড়েন। পরিহাসবশত সেই মেয়েটিরও নাম ধরা যাক মেঘ। অরিন্দমের আকাশে সেই মেঘবালিকা এসে ধরা দিয়েছিল, তাও প্রায় সাত বছর। এখন এই বিদেশে যাওয়ার অজুহাত, সম্ভাবনা, পূর্বাভাস, যেভাবেই তা বলা হোক না কেন – সাত বছরের ভালোবাসা ছাপিয়ে মেঘ চাইছিল বেঁধে রাখতে অরিন্দমের আকাশ। আর অরিন্দম উড়তে চাইলেও, কোথাও গিয়ে যেন আটকে যাচ্ছিল বারংবার।

মেঘ থাকবে না। অরিন্দম সে কথা উপলব্ধি করেছিল। কোথাও গিয়ে যেন অরিন্দমের বিদেশ-যাত্রার চেয়েও, যে কোনও অজুহাতে অরিন্দমের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়েই মেঘের তাগিদ বেশি দেখা যাচ্ছিল। অরিন্দম তাকে আটকাবে না আর। মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিয়েই সেদিন সে লিটল ম্যাগাজিন মেলায় উপস্থিত হয়েছিল। দেখা হয়ে গিয়েছিল উৎপলদার সঙ্গে। সম্পাদক, প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার উৎপল সেনগুপ্ত। উৎপলদার কাগজে অরিন্দম লিখেওছে কয়েকবার।

-“কিরে অরিন ওরফে অরিন্দম?” পিঠ চাপড়ে দিয়ে উৎপলদা জিজ্ঞেস করেন, “চল তোকে নতুন শতক’এর সন্দীপনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, উফফ এ্যাদ্দিন পর কিনা তুই লিটল ম্যাগে এলি। চল চল,” ইন্টেলেকচুয়াল কলকাতার এগিয়ে আসা ভিড় টপকিয়ে দু’জনে সামনে এগিয়ে যায়। প্রায় তিন-চার বছর হয়ে গেল লিটল ম্যাগাজিন মেলা বা উৎসবে আসতে পারেনি অরিন্দম। তাই তাকে সামনাসামনি পেয়ে এতখানি উচ্ছসিত সম্পাদক।

সন্দীপনের সঙ্গে আলাপের সময়েই কি করে যেন পাশের টেবলের দিকে চোখ চলে গিয়েছিল। অরিন্দমের বুকটা ঠিক তখনই যেন এক পলকের জন্য ছলাৎ করে উঠেছিল হঠাৎ, কোনও পূর্ব-ইঙ্গিত ছাড়াই। হুবহু যেন সুপ্রীতি। কলেজবেলাকার অরিন্দমের প্রথম প্রেম। নাকি ইনফ্যাচুয়েশন?

বড় চেনা মুখ। পানপাতার মতো গোল, ছুঁচলো চিবুক, একখানি ছাইরঙা মাথা-ঢাকা সোয়েটারে মেয়েটিকে স্নিগ্ধ লাগছিল। কপালের ঠিক মাঝখানে অতিক্ষুদ্র বিন্দুর মতোই কালো টিপ একখানি। ব্যস্ত দু’হাতে সে বই সাজিয়ে রাখছিল। মার্কেজের কোনও এক ছোটগল্পে এমনই হঠাৎ খুঁজে পাওয়া এক মহিলা সহযাত্রীর বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন। এখানে অবশ্য মেয়েটিকে কোনও ভাবেই সহযাত্রী বলা চলে না। কিন্তু অরিন ওরফে অরিন্দমের বুক তোলপাড় করছিল। এতগুলো বছর। সুপ্রীতিকে এতগুলো বছর পরেও সে ভুলতে পারেনি। শেষটা অতখানি অপ্রীতিকর হলেও, সুপ্রীতিকে সে মনে মনে শাস্তি দিয়ে ভুলে যেতে পারেনি। ক্ষমাও করতে পারেনি। মানুষের মন বোধ করি এইরকম। সে ছাড়তে পারে না। বাঁধনেও তার সুখ নেই। সে মাঝামাঝি অবস্থায় অবস্থান করে। আপাতত অরিন্দম ‘সুপ্রীতি’র দিকে তাকায়।

নাহ, মেয়েটি সুপ্রীতি নয়। কিন্তু কি অসম্ভব মিল দু’জনের। ঠিক সেভাবেই গালে অল্প টোল, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো। মানুষ কি সত্যিই ভালোবাসা ছাড়া বাঁচে না? অরিন্দম পকেটে হাত দেয়। মেঘের কোনও স্মৃতি বা উপহারই সে পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। মেঘ মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেয়, “তুমি তো আমাকে টেকেন ফর গ্রান্টেড করে তুলেছ। আমাকে নিয়ে আগের মতো আর বেড়াতে যাও কোথাও?” কপালে হাত ঠোকে অরিন্দম। মেঘ আসলে কর্পোরেট চাকরিতে উপরে উঠে গেছে বেশ কয়েক ধাপ। তার কাছে বিষয়, উপলক্ষ, নিয়ম – এই সবকিছুরই গুরুত্ব অধিক। সে কেবল সেই মানুষটিকেই ভালোবাসার আসনে বসাবে যে কিনা সাতদিন-চব্বিশ-ঘণ্টা তাকে একমনে, একপ্রাণে ভজনা করে যাবে। অথবা নিদেনপক্ষে উচ্ছসিত, উৎসারিত ভালোবাসা, অথবা ভালো লাগার সমস্ত অনুভূতিগুলিকেই নিয়মিত জনসমক্ষে প্রকাশ করবে। তাদের এই সম্পর্ক যে টিকছে না, মেঘ বা অরিন্দমের – তেমন একটা দুঃখ নেই কারোর। অরিন্দম আবারও ‘সুপ্রীতি’র দিকে তাকায়।

‘শূন্য অঙ্ক’। মেয়েটির টেবলের পত্রিকার নাম। মেয়েটির নাম তিলোত্তমা। তুলে নেওয়া একটি কবিতার বইয়ের পিছনের পাতায় ছবি সমেত লেখক পরিচিতি দেখেই, তিলোত্তমার নাম জানতে পারে অরিন্দম। কথা বলবে? সাহস হয় না তার। হয়তো বা ইচ্ছে করে না। সে আবারও একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। তিলোত্তমার পত্রিকার নাম ‘শূন্য অঙ্ক’, স্বগতোক্তিতে সে উচ্চারণ করে। শূন্য শব্দটিকেই আবারও যেন অস্ফূটে উচ্চারণ করতে ইচ্ছে হয়। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়েছে। সে মাথা ঘুরিয়ে নেয়। মেয়েটি কাজে মন দেয় আবার। পরদিন আবারও মেলা-চত্বরে ফিরে আসে অরিন্দম।

মেঘ দুরন্ত বেগে গাড়ি ছুটিয়ে যায়। এবারের প্রেমটাকে সে নিজের মতো করে সাজাবে। সেই কর্তৃত্ব রয়েছে তার। সৃজন তার জন্য অপেক্ষা করবে। মেঘ আজ একদমই চড়া মেক-আপ করেনি। বরাবর দামী প্রসাধনে অভ্যস্ত মেঘ। নিজেকে সাজাতে সে জানে ভালো ভাবেই। আজকাল অর্থ থাকলেই রুচির অভিনয় সম্ভব। মেঘ সেই বক্তব্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সৃজন তার জন্য অপেক্ষা করছিল। হাতে করে সে নিয়েছিল দোপাটি ফুলের গুচ্ছ, আর কবিতার একখানি বই। পাতলা, ফর্মা-দুই। যদিও এই ক’দিনেই সে বুঝতে পেরেছিল বাঁধা মাস-মাইনের ব্যবস্থা করতে না পারলে মেঘের অধীনে তাকে একেবারেই অনুকম্পার হ্যালোজেন বাতির উজ্জ্বল বিকিরণের সামনে গরমের প্রভাবে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া, তরল হয়ে পড়া গলন্ত মোমবাতির জীবন কাটাতে হবে।

মেয়েটি আজ অল্প সেজেছে। তিলোত্তমার দিকে তাকিয়ে ছিল অরিন্দম। আজ বেশ একটু দূর থেকেই। আদতে সে তাকিয়েছিল শূন্য অঙ্কের টেবলে। টেবলের ওপাশেই তিলোত্তমার অবস্থান। নাহ, অল্প বলা চলে না বোধহয়। তার সমস্ত মুখটুকুই ফর্সা চকচক করছে আজ। পরনে আজও সেই ছাইরঙা জ্যাকেট, কেবল মাথা থেকে টুপির অংশটা নামানো। ফর্সা কপালে ছোট্ট সেই বিন্দু-টিপ। একটি ছেলে এসে তার সঙ্গে কথা বলছে। অরিন্দমের ভীষণ মনে পড়ছিল। কলেজের সেই শুরুর দিন। প্রথম সেই শুরুর কয়েক মাস। ছেলেটি চলে গেল। তিলোত্তমা বসে পড়ে। হঠাৎ। এতক্ষণ সে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছিল।

সে ক্যাশবইটাকে কাছে টেনে নেয়। পিছনের পাতা উলটিয়ে আঁকিবুঁকি কাটে বোধহয়। অরিন্দম এবারে একটু সরে আসে। এই উঁকি মারার ব্যাপারটা অশোভন বলে মনে হয় তার। মেয়েটিও কি তাকে দেখছে? অরিন্দম আর ফিরে তাকায় না। সে অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করে।

একই সময় দূরের কোনও হাইওয়ের উপর মেঘ তার মনিব্যাগে হাত ঢোকায়। ভাঁজের ভিতরে থাকা কয়েকটি হাতে লেখা চিরকুট বের করে আনে। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে সেগুলিকে সে আকাশে উড়িয়ে দেয়। সৃজন গাড়ি থেকে কফির ফ্লাস্ক বের করে আনে। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ভারী স্টেইনলেস স্টিলের সেই দামী জিনিসটা পিছলে আরেকটু হলেই হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল তার। সে কোনও মতে সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে। মাঠের আরেক প্রান্তে মেঘ দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সৃজন হাঁটতে থাকে আকাশের নীচ বরাবর। মেঘের কাছ অবধি তাকে যে করেই হোক হেঁটে পৌঁছতে হবে। সৃজন গতি বাড়ায়।

সেবারের মূল বইমেলা ছিল লিটল ম্যাগাজিন উৎসবের ঠিক পরেপরেই। অরিন্দম আবারও মেলায় ফেরে। উৎপলদার নতুন বইয়ের উদ্বোধন। অবাক হয়ে অরিন্দম দেখে সেই বইয়ের প্রকাশক ‘শূন্য অঙ্ক’। আবারও সে তিলোত্তমাকে স্টলে বসে থাকতে দেখে। আরও যেন তাকে স্নিগ্ধ লাগছে আজ। সাদা জমির কামিজের উপর হালকা রঙবাহারি কারুকাজ। সেই ছাইরঙা জ্যাকেট। তাহলে কি সে’ই শূন্য অঙ্কের কর্ণধার? নাহ, আশেপাশে তাকায় অরিন্দম। কর্ণধার অন্য কেউ। অন্য আরেকজন। কাকে যেন সে জিজ্ঞেস করে। অরিন্দমের মনে পড়ে না আজ। হয়তো বা উৎপলদাকেই বোধহয়। উৎপলদাই জানান কর্ণধারের নাম। তিলোত্তমার নামের সঙ্গে তার মিল নেই কোথাও। অরিন্দম উৎপলদার বইটা হাতে তুলে নেয়, আর তুলে নেয় আরও একটি বই।

অনেক রাত।

তিলোত্তমা যে তাকে চিনতে পারেনি, একথা মানতে একটু অসুবিধা হয় তার। অরিন্দম নিশ্চিত জানে তিলোত্তমা তাকে লক্ষ্য করেছিল। সেই লিটল ম্যাগাজিন উৎসব থেকেই। তবুও সে শীতল অথচ মিষ্টতায় মোড়া আলাপ করে অরিন্দমের সঙ্গে। তার সেই স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের আড়ালে কোথাও যেন তখন এক অদ্ভুত শীতল, আড়ষ্ট ভাব। পানপাতার মতো মুখ তার। অথচ কাঠ হয়ে আসা গালে টোল পড়ছে না। তবুও তার হাসি অনির্বাণ। অরিন্দমের তখন তাকে কেমন যেন দেবতার মতো ভক্তি করতে ইচ্ছে হয়। যে ভক্তিতে প্রেমের চেয়েও ভয়েরই ভাব বেশি। অরিন্দম বইয়ের পাতা উলটিয়ে দেখে। তিলোত্তমা নামটুকুই প্রচ্ছদে রয়েছে তার। সে পদবীর ব্যবহার রাখেনি। হয়তো বা সে একান্তই নিভৃতযাপন করতে চায়। তার প্রেমের কবিতাগুলি পরপর এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে অরিন্দম। অন্তরে প্রেমিক না হলে এই অক্ষর-সৃষ্টি অসম্ভব। একথা সে মনে মনে উপলব্ধি করে। তখনই অরিন্দমের চোখে পড়ে হঠাৎ।

উৎসর্গ-পত্রে লেখা ছিল, ‘সৃজন’কে দিলাম’। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে অরিন্দমকে বইটি সই করে দেওয়ার সময় সমস্ত পংক্তিটুকুকেই সে কলমের এক কোপে কেটে উড়িয়ে দিয়েছে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন