দোঁহা

পোস্ট মর্টেম না - প্রি মর্টেম

 

 

মালবিকা মিত্র


ইন্ডিয়া জোটের সম্পর্কে দু-চারটে কথা আগেভাগে বলে ফেলা প্রয়োজন। কারণ নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর একটা সিদ্ধান্ত মিলিয়ে বিশ্লেষণ করার প্রবণতাটা কখনোই গ্রহণযোগ্য না। তাই ফলপ্রকাশের পূর্বেই ইন্ডিয়া জোট সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। 

প্রথমত সিপিআইএম দলের পক্ষে জোট ধর্ম আক্ষরিক ভাবে পালন করা সম্ভব না। কারণ কেরলে তার প্রধান প্রতিপক্ষ জাতীয় কংগ্রেস, ত্রিপুরায় জোট ধর্ম পালন করা সম্ভব, কারণ সেখানে বিজেপি ক্ষমতাসীন। ফলে বিজেপি তাদের কমন এনিমি। যদিও পশ্চিমবাংলায় সিপিএমের পক্ষে জোট ধর্ম রক্ষার আগ্রহ দেখানো সম্ভব ছিল। কিন্তু সমস্যা হল এই রাজ্যে  ক্ষমতাসীন তৃণমূল্ দল। সম্ভব ছিল এই কারণে যে সিপিএম বা কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল নয়। কংগ্রেস সিপিএম এখানে তৃতীয় চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে। সেই হিসেবে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া উচিত ছিল বিজেপি। সেই ভূমিকায় সিপিএমকে দেখা গেল না। সর্বোপরি ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়া জোটের সভার পর সিপিএম নেতারা খোলামেলা বলতে থাকেন, আমাদের পার্টির সিদ্ধান্ত হয় পলিটব্যুরো বৈঠকে, ব্যাঙ্গালোরে গৃহীত হয় না। স্পষ্ট ইন্ডিয়া জোটকে অস্বীকার করার ঘোষণা। 

দ্বিতীয়ত তৃণমূল দল। তার পক্ষে জোট ধর্ম রক্ষা করা সহজ ছিল। কারণ তৃতীয় চতুর্থ স্থানাধিকারী কংগ্রেস ও সিপিএম বিধানসভায় এরা দুজনেই শূন্য। কেবল লোকসভায় কংগ্রেসের আসন সংখ্যা দুই। অতএব যেকোনো সংখ্যায় রফা হতে পারতো। কিন্তু সেটা হলো না। প্রথমত সিপিএম চায়নি। ফলে সিপিএমের ইচ্ছায় প্রভাবিত অধীর চৌধুরীও জোট চায়নি। অতএব জোট হলো না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিনিধি পাঠিয়ে আসন রফার আলোচনার জন্য বারে বারেই নিজে আগ্রহ দেখিয়েছেন। দুটি আসন দিয়ে কথা শুরু করেছিলেন। কথা এগোলে সেটা বাড়তো না এমন নয়। কিন্তু কংগ্রেস কথাই বলতে চাইলো না। আসলে কংগ্রেস তৃণমূল জোট হলে সিপিএম একাকী অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারতো না। অবশেষে একতরফা ভাবে তৃণমূল প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। এইসঙ্গে মনে রাখতে হবে,  কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল দল তৈরি হয়েছে। আর তৃণমূলের হাতে সিপিআইএম সরকার থেকে ক্ষমতাচ্যুুত হয়েছে। অতএব এক সাধারন শত্রুতা এদের সাথে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মসূত্রে লেখা আছে। 

তৃতীয়ত আপ (আম আদমি পার্টি) তারা দিল্লিতে ক্ষমতাসীন। তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দিল্লিতে বিজেপি। কংগ্রেস তৃতীয় স্থানে। অতএব দিল্লিতে কংগ্রেসের সাথে আপের আসন রফা সম্পন্ন হল। কিন্তু পাঞ্জাবে আপ প্রধান শক্তি এবং কংগ্রেস দ্বিতীয় শক্তি। দ্বিতীয় শক্তি হওয়ার কারণে তার সাথে আসন রফা হয়নি। হলেও তার ফলে বিজেপির লাভ হত। কারণ একটি তৃতীয় শক্তিকে দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে তুলে আনা হতো। 

শিবসেনা, এনসিপি, অখিলেশের সমাজবাদী পার্টি, তেজস্বী যাদবের আরজেডি, লিবারেশন, হেমন্ত সরেনের ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা, তামিলনাড়ুতে স্ট্যালিনের ডিএমকে, এই দলগুলিও ঐক্যের ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। তাদের পক্ষে জোটের যে ভূমিকায় থাকার কথা সাধ্যমত সেই ভূমিকা পালন করেছে। তবে উল্লেখযোগ্য, হেমন্ত সরেন ও স্ট্যালিন বাদে বাকি এই দলগুলো কেউ ক্ষমতাসীন নয়। 

এরপরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যে দলের কাঁধে ছিল সেই দলের কথায় আসি, জাতীয় কংগ্রেস। ভারত জোড়ো যাত্রা এবং ইন্ডিয়া জোট গঠন করার মধ্য দিয়ে একটা মোদি বিরোধী, গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার আগ্রহ ও আবহ তৈরি করেছিল। যে আবহে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বিচলিত বোধ করছিলেন। এই আবহেই  কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। কর্নাটকে বিপুল জয়লাভ করল কংগ্রেস। এই জয়টাকে ইন্ডিয়া জোটের জয় হিসেবে আরো দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতো। পরিবর্তে কেমন একটা আত্মতুষ্টির মনোভাব কংগ্রেসকে গ্রাস করল। মনে করে দেখুন, ধূপগুড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের জয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইন্ডিয়া জোটের জয় হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলতো বিপরীতে "আচ্ছা ঠিক আছে", ভাবটা যেন "জোটের বড়কর্তা একাই সব সামলে নেবে" গোছের মনোভাব দেখা দিলো। পরবর্তী সময়ে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী সংগ্রামে ইন্ডিয়া জোট কোন মহড়াই দিলো না। জোটের একটা সভাও হলো না। একাই সামলে দেবো মনোভাব পরিণতিতে ভয়ংকর বিপর্যয় আনলো। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। 

কর্ণাটক যেমন অতিরিক্ত আত্মতুষ্টি এনে দিয়েছিল, পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী বিপর্যয় ঠিক সেভাবেই অতিরিক্ত ভীত সন্ত্রস্ত, গুটিয়ে থাকা, আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরি করল। রাজ্যে রাজ্যে মানুষ যে বিজেপি বিরোধী মনোভাব নিয়ে ফুঁসছে, তাকে নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থায় ইন্ডিয়া জোট ছিল না। আঞ্চলিক দলগুলি তার নিজের নিজের জায়গায় সেই দায়িত্ব পালন করেছে। সেগুলোকে দমন করার জন্য ইডি সিবিআই ইনকাম ট্যাক্স সমস্ত অস্ত্র নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ঝাঁপিয়ে পড়ল। কংগ্রেস তখনও জোরালো ভাবে সোচ্চার হলো না। এমনকি শুরুর দিকে কংগ্রেস রাজ্যের নির্বাচনী আসন সমঝোতায় আরেকটু তৎপরতা দেখালে জোটটা পক্ত হতো। কংগ্রেস হাল ছেড়ে দেওয়া নাবিকের মতো। অতঃপর নির্বাচন যখন ক্রমশ এগিয়ে এলো, এমনকি প্রথম দফা নির্বাচন সাঙ্গ হল, তখনই একটু স্পষ্ট হলো মানুষের স্বতস্ফূর্ত সরকার বিরোধী মনোভাব। আর সরকারও এতদিন যে খেলাটাকে ওয়াক ওভার ভেবে নিয়েছিল, সেটাকেই সে ভয় পেতে লাগলো। সাধারণ মানুষ নিজস্ব কায়দায় ও ভাষায় ২০১৪ এর পর থেকে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ অসন্তোষ গুলিকে এক দশক পর প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে। না সরকারি দল, না সরকারি বিরোধী দল, কেউই এটা বুঝতে পারেনি। প্রথম দফা নির্বাচনের পর এটা দুপক্ষের কাছেই স্পষ্ট হলো বলে বিজেপির কাছেও নির্বাচন নিয়ে নতুন আখ্যান, ন্যারেটিভ তৈরি করার প্রয়োজন হলো। আর কংগ্রেসও এই নির্বাচনকে খুবই সিরিয়াসলি গ্রহণ করল। যার প্রমাণ দেখা গেল পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির বিরুদ্ধে এ আই সি সি  সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের মন্তব্যে। দুমাস আগে এই মন্তব্য করলে পশ্চিমবাংলায় জাতীয় কংগ্রেস ও তৃণমূলের জোট তৈরি নিশ্চিত হত। 

ইন্ডিয়া জোটে নেতাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ উনিশে এপ্রিলের পর পাল্টে গেল। এই হাব ভাব কদিন আগে দেখাতে পারলে নিশ্চিত ভাবে একটি বীরত্বপূর্ণ নির্বাচনী সংগ্রাম দেখতে পেতাম। বিলম্বে হলেও কিছুটা দেখা গেল। ইতিহাসের একটি বিরত্বপূর্ণ গণ সংগ্রাম মহাবিদ্রোহ (১৮৫৭)। উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদ্রোহী সেনা কৃষক জনতা সামন্ত প্রভু ও ধর্মীয় নেতারা দিল্লি অভিযান করে ও দিল্লি দখল করে। এরপর দিল্লিতে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে। অতঃপর ইংরেজ সরকার সারা ভারতের সেনাবাহিনী কে সংগঠিত করে দিল্লি অভিযান করে ও অবরোধ করে। প্রবল দুঃসাহসিক লড়াই করেও, ভয়াবহ রক্তপাতের মধ্য দিয়েও বিদ্রোহীরা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কার্ল মার্কস এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, দিল্লি দখল করার পর এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রত্যন্ত প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন ছিল। তাহলে সরকার বিদ্রোহকে দমন করতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়তো। পরিবর্তে সমস্ত বিদ্রোহীরা দিল্লিতে কেন্দ্রীভূত হলো। যাকে দমন করা ইংরেজ সরকারের পক্ষে সহজ হয়েছিল। দিল্লি রক্ষা করার যে বীরত্বপূর্ণ লড়াই বিদ্রোহীরা করেছিল, সে সম্পর্কে মার্কস বলেন, কদিন আগে এই বীরত্বের প্রদর্শন করলে নিঃসন্দেহে বিদ্রোহের ফলাফল ভিন্নতর হতে পারত। ইতিহাসের এই সমালোচনা ও বিশ্লেষণটি বড় বেশি প্রাসংগিক বলে মনে পড়ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন