দোঁহা

প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে

 


সুনির্মল বসু


সত্যিকার ভালোবাসতে পারলে ভালোবাসুন, ফালতু প্রেম প্রেম খেলবেন না, যদি সত্যিই ভালবাসতে চান,
তাহলে কি পাবেন, ভুলে যান, কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারবেন, সেটা ভাবুন। আজকাল ভালবাসাও গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি অনুসরণ করে চলে।

 ভালোবাসা তো জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুভূতি। অথচ আজকাল দেখি, সীমাবদ্ধ ভালোবাসা গণ্ডিবদ্ধ হতে হতে আমি তুমিতে এসে পথ হারিয়েছে। এইসব ভালোবাসা দেখলে, সম্রাট শাহজাহান লজ্জা পেয়ে যেতেন। 

ভালোবেসে চন্ডীদাস রামী ধোপানির প্রেমে পড়েছিলেন। কবি লিখে ছিলেন, তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার গলায় পরিতে সুখ। কিংবা কবি বিদ্যাপতি লিখেছিলেন,

দুহু শোকে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।

ভালোবাসার উপর শত শত কবিতা লেখা হল। মির্জা গালিব, কাইফি আজমি, শৈলেন্দ্র, রাজা মেহেদী আলী খাঁন কত শের শায়েরী লিখলেন।

গালিব প্রেমিকার উদ্দেশ্যে লিখলেন, তুমি কখনো জ্যোৎস্নার রাতে একলা ছাদে শুতে যেওনা, তুমি এত সুন্দর, আকাশের নক্ষত্রেরা কক্ষ চ্যূত হতে পারে।

কিংবা, একজন কবি লিখলেন, আমি কবি নই, অথচ মনে হয়, কোনদিন আমি কবি হয়ে যাবো, কেননা তোমার ভালোবাসার মধ্যেই কবিতা রয়েছে।

ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক হিসেবে শুধু একটি বারের জন্য প্রেমিকার সাথে ঘোড়ায় চড়তে চেয়েছিলেন। মহাকবি কালিদাস মেঘদূত কাব্যে মেঘকে দ্যূত হিসেবে বরণ করে নিয়ে
বিরহিনী প্রেমিকার কাছে বার্তা পাঠাতে চেয়েছিলেন। 

প্রেম হল মধুর রস আশ্রিত। স্বর্গীয় সৌভাগ্য ছাড়া জীবনে সত্যিকার প্রেম জোটে না।

অথচ, আজকাল প্রেম খেলা হয়ে যাচ্ছে। জীবনে যদি সত্যিকার প্রেম থাকতো, তাহলে ছবির নাম কখনোই ,কহোনা পেয়ার হ্যায়, হতো না। কারণ, আর যাই হোক, প্রেম তো বিজ্ঞাপনের বস্তু নয়। 

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি কবিতায় লিখেছেন,

এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোন পাপ করতে পারি,
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে  ভালোবাসি,
এই ওষ্ঠে এত মিথ্যা কি মানায়।

অতি ব্যবহারে ভালোবাসা শব্দটা তার প্রাচীন গৌরব হারিয়েছে। সিরিয়াল ধাঁচের প্রেম, পরকীয়া প্রেম, একেবারে নরক গুলজার ব্যাপার আর কি। আসলে, সফল প্রেম দীর্ঘায়ু লাভ করে না, ব্যর্থ প্রেম কিন্তু দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে। 

প্যারিসে প্রেমিকাদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত না হলে, ফরাসী লেখক বালজাক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখক হতে পারতেন না।

ডাক্তার অমর চ্যাটার্জির মেয়ে পার্বতীর সঙ্গে প্রেমে ব্যর্থ না হলে, শরৎচন্দ্র দেবদাস উপন্যাসটি লিখতে পারতেন না।

 চরিত্রহীন উপন্যাসে গৃহ সেবিকার সঙ্গে ভদ্র ঘরের মানুষের প্রেম কাহিনী লিখে, শরৎচন্দ্র খুব টেনশনে ছিলেন। বাজে শিবপুরের বাড়িতে হাওড়ায় যখন তিনি একটি মুদি দোকানে বসে আছেন, কলকাতা থেকে ল্যান্ড রোভার গাড়ি চালিয়ে এক ভদ্রমহিলা তাঁর খোঁজ করতে গেলেন।

শরৎচন্দ্র সামনে এসে দাঁড়াতেই, ভদ্রমহিলা তাঁকে বললেন, আপনি চরিত্রহীন শরৎচন্দ্র,
হ্যাঁ আমি চরিত্রহীন উপন্যাসের লেখক শরৎচন্দ্র,
ভদ্রমহিলা লেখকের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন, বললেন, আমি আপনার চরিত্রহীন উপন্যাসটি পড়েছি। আপনার চরিত্রহীন উপন্যাসটি আমার চরিত্র রক্ষা করেছে।

এমন প্রশংসা শরৎচন্দ্রের কাছে তখন অভাবনীয় ব্যাপার।

প্রেম না থাকলে পৃথিবী তো মরুভূমি। এক লেখক আফসোস করে বলেছিলেন, পৃথিবীতে সুন্দরী মেয়ে নেই, তাহলে এমন মরুভূমিময় পৃথিবীতে বেঁচে আছি কেন?

প্রেম আছে, প্রেম থাকবে। পাড়ার বখাটে ছেলেরা
ভালোবাসা নিয়ে নব নব ইতিহাস রচনা করবে। তা করুক, কিন্তু তার মধ্যে যেন একটা মার্জিত ভাব থাকে। যে প্রেম মানুষকে স্বার্থপরতা শেখায়, সেটা আসলে প্রেম নয়। সত্যিকারের প্রেম মানুষকে অমরত্ব দেয়। 

যে প্রেম নায়ককে একদিন সর্বস্বান্ত করে, ঘৃণার অন্ধকারে ঠেলে দেয়, আবার কখনো  কোন দূর ভবিষ্যতে প্রেমিকা নিজের ভুল বুঝতে পেরে অসহায় প্রেমিকের পাশে দাঁড়ায়, আবার নতুন করে জীবন শুরু করে। তেমন প্রেম ত কাম্য।

লায়লা মজনু, শিরি ফারহাদ, দিওয়ান মদিনা, মহুয়া ও নদ্যার চাঁদ, হীর রনঝা, সেই ভালোবাসার কথাই বলে এসেছেন।

মহান ইংরেজ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার রোমিও জুলিয়েটের প্রেমের কাহিনী লিখেছেন।

নদীর ঘাটে মহুয়া কলসি কাঁখে জল তুলতে এসেছে। নদ্যার চাঁদ তাঁকে ভালোবাসা জানিয়েছে। মহুয়া রেগে বলেছে,
লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর 
লজ্জা নাইরে তর,
গলায় কলসি বাইনধ্যা
জলে ডুইব্বা মর।

তখন নদ্যার চাঁদ বলেছে,

কোথায় পাইবাম কলসি কন্যা
কোথায় পাইবাম দড়ি
তুমি হও গহীন গাঙ
আমি ডুইব্বা মরি।

শ্রীকৃষ্ণ রাধার প্রেম পরকীয়া প্রেম। শ্রীকৃষ্ণ সকল রসের আধার। নিজের আনন্দ শক্তিকে উপলব্ধি করবার জন্য রাধার জন্ম।

সময় পেরিয়ে যুগে যুগে ভালোবাসার চেহারা বদল হয়েছে। কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসা কিন্তু একরকমই আছে। তা না হলে, কেন বাদল রাতে
কোনো নারীর কান্না কেন প্রেমিককে সারারাত ঘুমাতে দেয় না। ভালোবাসা মানে, পেয়ে হারানোর ভয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, রাত জাগা। 

আর ভালোবাসায় গভীরভাবে ডুবে গেলে অনেক সময় শচীন কর্তার স্টাইলে প্রেমিককে গেয়ে উঠতে হয়,
শোনো গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি।

কিংবা, প্রেমিকা কত সুন্দর, তা বোঝাতে গিয়ে প্রেমিককে গাইতে হয়,

সেদিন চাঁদের আলো চেয়েছিল জানতে, তার চেয়ে সুন্দর কেউ আছে কি, আমি তোমার কথাই বলেছি।

এই তুমি ভাবনা না থাকলে, সংসারটা সাহারা মরুভূমি। কাব্য সাহিত্য ভাবনা সব জলাঞ্জলি। খাঁটি প্রেম ভালবাসা থাকুক। গভীর রাতে একটা নারীর গোপন কান্না কারো একটা রাতের ঘুম কেড়ে নিক না। তবেই তো বোঝা যাবে, প্রেম ছিল, প্রেম আছে,
প্রেম থাকবে।

প্রেমিক দেবদাসের শব যাত্রা পার্বতীর বাড়ির ফটকের সামনে দিয়ে যাবে। সব রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপ ভেঙে পার্বতীকে সেদিন ফটক ছেড়ে বাইরে বেরোতে হবে।
ভালোবাসার জোর যদি থাকে, একমাত্র তখনই 
এটা সম্ভব।

সেই যে কবি মির্জা গালিব লিখেছিলেন,
আমার কাছে প্রেমহীন হাজার রাতের চেয়ে, প্রেম পূর্ণ একটি রাতই যথেষ্ট।

এই ভাবনা শিমূল তুলোর মতো বাতাসে ভেসে যাক। হৃদয় থেকে হৃদয়ে ভালোবাসার ঝাড়বাতিটা জ্বলে উঠুক।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন