মালবিকা মিত্র
পুলিশ ওৎ পেতেই ছিল। চোর ঝোপের ভেতর থেকে বেরোনো মাত্র ধরে ফেললো। চোর বেচারা জড়সড় হয়ে পায়ে ধরে বলল, আমার পুঁটুলি টা ওই জঙ্গলে ফেলে এসেছি। নিয়ে আসবো স্যার? পুলিশের গম্ভীর উত্তর - যাও। চোর সেই যে গেল, গেল তো গেল, আর এলো না । পরের বারেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। স্যার, আমার পুঁটুলিটা ওই বাদারে ফেলে এসেছি। এবং যথারীতি উত্তর - ঠিক আছে যাও। কিন্তু তৃতীয়বার পুলিশ ঠকতে রাজি না। সে বলল প্রত্যেকবার তুমি পুঁটুলির নাম করে পালিয়ে যাও। এবার তুমি দাঁড়াও, আমি যাব তোমার পুঁটুলি আনতে। আহা! কি সারল্য পুলিশের তাইনা। এত সাদামাটা সহজ-সরল ভালো মানুষ দিয়ে পুলিশের কাজ চলে?
শুধু কি পুলিশ? বিচার বিভাগ কম কিসের? দাবি উঠলো নীট ইউজির পরীক্ষা পুনর্গ্রহণ করতে হবে। তার জবাবে বলা হয়েছে, আগে বিচার করে দেখতে হবে ১) কারচুপির বিষয়টি পরীক্ষার ব্যবস্থাপনার মধ্যেই জড়িয়ে ছিল কিনা ২) কারচুপি এমনভাবে হয়েছে কিনা যাতে পুরো পরীক্ষা প্রক্রিয়াটি পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে ৩) কারচুপি হলে লাভবান পরীক্ষার্থীদের সাধারণ পরীক্ষার্থীদের থেকে পৃথক করা সম্ভব কিনা। এই তিনটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে। মনে পড়ছে সেই ছড়া :
"বলছিলাম কি, বস্তুপিণ্ড সূক্ষ্ম হতে স্থূলেতে,
অর্থাৎ কিনা লাগ্ছে ঠেলা পঞ্চভূতের মূলেতে—
গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কি ক'রে,
রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে ৷
অর্থাৎ কিনা, এই মনে কর্, রোদ পড়েছে ঘাসেতে,
এই মনে কর্, চাঁদের আলো পড়লো তারি পাশেতে..."
পরীক্ষা নেওয়ার যথাযথ প্রক্রিয়া এনটিএ (ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি) মেনে চলেনি। পরীক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই কারচুপি লুকিয়ে ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ও এনটিএ পরীক্ষা বাতিলের তীব্র বিরোধিতা করে। এতো বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থীর পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণ, একি সম্ভব! সেই কারণেই মহামান্য আদালত ওই তিনটি নির্দেশিকা জানিয়েছেন।
কি শিশুসুলভ সারল্য, কি ভালো মানুষী। প্রথম কথা ব্যবস্থাপনার মধ্যে কারচুপির উৎস জড়িয়ে না থাকলে কোন আতঙ্কে পরবর্তী দুটি পরীক্ষা বাতিল করা হলো? নিট পিজি ও নেট পরীক্ষা। কারণ দুটি পরীক্ষায় আয়োজক ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সী, এনটিএ। ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই কেন সাত তাড়াতাড়ি এনটিএ ডিজিকে সরিয়ে দেওয়া হলো? আগে কেউ কিছু জানলো না পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর দুর্নীতি নিয়ে যেইনা শোরগোল উঠলো, তখন বলা হল কিছু ছাত্রকে, মানে কিছু পরীক্ষা কেন্দ্রকে গ্রেস মার্ক দেওয়া হয়েছে । এটা কি সিস্টেমের মধ্যেই গোলমাল এর লক্ষণ নয়।
বলা হয়েছে পুরো পরীক্ষার প্রক্রিয়ার পবিত্রতার কথা। শিক্ষামন্ত্রী প্রথমে জানালেন, কোন প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। তারপর জানা গেল বিহারে , হরিয়ানায়, গুজরাটে, নাকি আগেই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ এসেছিল। পরীক্ষা গ্রহণের একমাস পরেও মন্ত্রীর কাছে এমন তথ্য জানা ছিল না! কিম্ আশ্চর্যম! এটা কি তথ্য গোপন করা নয়? এটা কি আদালতকে মিসলিড করা, ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা নয়? এর চেয়ে বেশি অপবিত্র আর কি হতে পারে?
শুধু তো প্রশ্নপত্র ফাঁস নয়, আমরা শুনেছিলাম প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, সেই প্রশ্ন ও উত্তরপত্র হোটেলে বসে বিশেষ প্রশিক্ষকের সাহায্যে মুখস্ত করানো হয়েছে। রাতারাতি সব উত্তর মুখস্ত করতে না পেরে কোন কোন ছাত্র ফিজিক্সে ১০০ শতাংশ আর কেমিস্ট্রিতে দুই শতাংশ নম্বর পেয়েছে। হোটেল কারা বুকিং করেছিল, তার নাম ধামও নাকি উঠে এসেছে। একুশে জুলাই, সংবাদে প্রকাশ, গুজরাটে রাজকোটের একটি কেন্দ্র থেকে ৮৫% পরীক্ষার্থী সফল হয়েছে। এদের মধ্যে বারো জন ৭০০ এর উপরে নম্বর পেয়েছে। ৬৫০ এর ওপর নম্বর পেয়েছে ১১৫ জন। আর ২৫৪ জন পেয়েছে ৬০০র উপরে নম্বর। পরীক্ষা কেন্দ্রটির নাম ইউনিট স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, যেখানে পরীক্ষার্থী ছিল ২২৭০১ জন। মোদিজীর গুজরাট, ব্যাপারটা কি কাকতালীয়? এমন এক কেন্দ্র যেখানে বাইশহাজার পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়? আবার এও শুনেছি বিহারের পরীক্ষার্থী, উড়িষ্যার পরীক্ষার্থী, বিশেষ বিশেষ কেন্দ্র নির্বাচন করেছে ভেনু হিসেবে গুজরাট, হরিয়ানায়। ওই ভেনুতে রোল নাম্বার পাওয়ার জন্য টাকার লেনদেন হয়েছে। এটাও কি পরীক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটির অন্তর্গত নয়? আবার এমন তথ্য সামনে এসেছে যে ওই সমস্ত পরীক্ষা কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে, প্রয়োজনে সাদা ওএমআর জমা দাও, যা জানো না তা লিখবে না। পরে ওই ওএমআর শীট এক বিশেষ কেন্দ্রে বসে পূরণ করা হয় ও পুনরায় সিল করে ক্যুরিয়ারে পাঠানো হয়। গুজরাটের গোধরার স্কুলে উড়িষ্যা, কর্নাটকের ছেলে ভেনু চাইছে। যেখানে যাতায়াতের সুবিধাটুকুও নেই। হরিয়ানার স্কুলে উড়িষ্যার ছেলে ভেনু চাইছে। এরকম কয়েকটি ভেন্যু বেছে নিয়ে সেখান থেকে এই ১০০ শতাংশ নির্ভুল উত্তর পত্র পূরণ হয়েছে। এরপরেও বলা হবে, বুঝতে বাকি থাকবে, প্রক্রিয়ার মধ্যে গোলমাল আছে কি নেই!
আর নানা স্তরে নানান শেডে যদি দুর্নীতির কাজটি ঘটে থাকে, তখনই সাধারণ পরীক্ষার্থী ও অসাধু পরীক্ষার্থীদের পৃথক করা সম্ভব হয় না। অপরাধটি একটি অঞ্চলে, একটি পর্যায়ে হলে তখন অসাধু অংশকে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু অপরাধ যখন ভিন্ন ভিন্ন স্তরে, ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় ঘটতে থাকে, তখন আর সাধারণ পরীক্ষার্থী ও অসাধু পরীক্ষার্থীকে পৃথক করা যায় না। একটা সর্বভারতীয় পরীক্ষা তাতে হাজার হাজার পরীক্ষা কেন্দ্র। কি সহজে কত তাড়াতাড়ি তদন্তকারীরা জানিয়ে দিল মাত্র তিন চারটি ক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ এসেছে। আর শুধু পশ্চিমবাংলায় কয়েক হাজার নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ধরতে গিয়ে সিবিআই লেজে গোবরে। এখনো ওএমআর সিট নিয়েই কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। নীটের প্রশ্ন ফাঁসের কেন্দ্রের সংখ্যাটা তিন চারটি না তিন চার শো সেটা কে বলবে? বলছে তো সিবিআই। কোন সিবিআই? যে সিবিআই কে রঞ্জন গগৈ থেকে শুরু করে মহামান্য প্রধান বিচারপতি রামানা সকলেই পক্ষপাত দুষ্ট বলে অভিযুক্ত করে গেছেন।
রাজ্য সরকার দুর্নীতি করলে, আমাদের পুলিশ গোয়েন্দার তদন্তের ওপর আস্থা থাকে না। কারণ পুলিশ গোয়েন্দা রাজ্য সরকারের নির্দেশে চলে। সকলেই সিবিআই তদন্ত দাবি করি। সিবিআই সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের তোতাপাখির ভূমিকায় অবতীর্ণ, সেটা ভুলে যাই। তাহলে নিট ইউজি পরীক্ষার দুর্নীতি নিয়ে সরকারের উচিত ছিল বিচার বিভাগীয় তদন্ত করানো। অবশ্য কেউ বলতেই পারেন রঞ্জন গগৈ, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, রোহিত আর্যর পর বিচার বিভাগীয় তদন্ত নিয়েও সন্দেহ থেকে যায়। যাই হোক কেন্দ্রীয় সরকার অন্তত লোক দেখানো সে পথেও গেলো না। পরিবর্তে পক্ষপাত দুষ্ট, চরম সমালোচিত, সিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করানো হল। এখানেই তো সন্দেহ থেকে যায়।
খোঁড়া যুক্তি হাজির করে বলা হলো, কিছু নাকি গ্রেসমার্ক দেওয়া হয়েছে। প্রথমত মেডিকেলের প্রবেশিকার মত পরীক্ষায় গ্রেস মার্ক দেওয়ার রীতি আছে কিনা সেটা প্রশ্নাধীন। এ বিষয়ে আদালতের যে নির্দেশ আছে সেই নির্দেশিকায় মেডিকেলের প্রবেশিকা পরীক্ষার কথা উল্লেখ তো নেইই, সম্ভবত ওটাকে বাদ রাখার সবিশেষ উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া পরীক্ষা সাঙ্গ হওয়ার পরেই কেন জানানো হলো না যে, কটা কেন্দ্রে দেরিতে পরীক্ষা শুরু হয়েছে ও গ্রেসমার্ক দেওয়া হবে। জানানো হলো তখন, যখন প্রকাশিত ফল নিয়ে চতুর্দিকে শোরগোল পড়ে গেছে। গোবরটা লেজে লেগে গেছে তখন। প্রশ্ন তো উঠবেই, কারণ তাড়াহুড়ো করে যেভাবে ১০ দিন আগে নিট ইউজি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হলো, ঠিক লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন। আবারও মনে পড়ছে সিনেমার সেই দৃশ্য - যখন গ্রামের মানুষ ওম পুরীকে জবাব চাইছে যে, তাদের হাজার হাজার টাকা স্বল্প সঞ্চয়ের নামে জালিয়াতের তহবিলে রেখে তাদের ঠকানো হয়েছে কেন? আমাদের টাকা ফেরত দাও । জবাবে ওম পুরী বলছে, ঠকানো হয়েছে বলো না, আমি নিজেও তো ঠকেছি। আমি নিজেও টাকা রেখেছিলাম, ঠকেছি। তখন গ্রামবাসী পরেশ রাওয়াল বলেছিল, নাহানেকা টাইম কোই পিসাব কিয়া কি নেহি কিয়া কঁউন সমঝেগা? হ্যাঁ সেই কারণেই ৪ঠা জুন নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিনটিকে বেছে নেওয়া হলো নীট পরীক্ষার ফল প্রকাশের জন্য। কোই নেহি সমঝেগা কিয়া কি নেহি কিয়া।
যাগ্গে এসব কথা। পুলিশ, সিবিআই, আদালত, এদের সাদা মনে কাদা নেই। ফলে এরা অনেক সহজ করে, পবিত্র ভাবে ভাবতে পারে, চিন্তা করতে পারে। আমাদের দুষ্ট লোকেদের সদাই ঘোরানো প্যাঁচানো মন। সোজা জিনিসকে বাঁকা দেখি। তাই এ প্রসঙ্গ থাক। বরং ভাবা যাক, এমনটা ঘটছে কেন? পাওয়ার ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশনের একটা অন্যতম সমস্যা হলো, যত দূরবর্তী স্থানে বিদ্যুৎ পৌঁছানো হবে, ততই মধ্যবর্তী স্তরে বিরাট পরিমান বিদ্যুতের অপচয় ঘটবে। দীর্ঘ পরিবহনের পথে রোধ বা রেজিস্ট্যান্স বেশি হয়। বাতাসে যে সমস্ত ভাসমান কণা উপাদান থাকে, তাদের সাথেও ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয়। পথ মধ্যে নানাবিধ শর্ট সার্কিটের সম্ভাবনা থাকে। এর ফলে বিদ্যুতের অপচয় বেশি হয়। বিদ্যুতের পরিবহন যত বেশি ক্ষুদ্র পরিধি তে সীমাবদ্ধ থাকবে, অর্থাৎ লোকালাইজড হবে, অপচয় ততই কম হবে। ২০১১-১২ সাল নাগাদ এই অপচয় এর পরিমাণ ছিল ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ।
প্রসঙ্গটা উঠল এইজন্য যে ভারতের মতো একটা বিশাল দেশ, সেখানে ২৪ লক্ষ পরীক্ষার্থী ডাক্তারি পরীক্ষায় বসবে। আর পরিচালনার কেন্দ্রটি হবে এককেন্দ্রিক। এটা খুবই অবৈজ্ঞানিক। কারণ কেন্দ্র থেকে পরিধির দূরত্ব যত বাড়বে, মধ্যপথে কোথায় কি সমস্যা ঘটে যাবে তার হদিশ না পাওয়ার সম্ভাবনাই বাড়বে। আরো লক্ষ্য করার বিষয়, নিট পরীক্ষার দুর্নীতির সাথে যুক্ত রাজ্যগুলি, সবই ডবল ইঞ্জিন সরকার। সেক্ষেত্রেও কিছু বাড়তি প্রশ্নচিহ্ন হাজির হয়। রাজ্য গুলি তার সুবিধা ও চাহিদা মত প্রবেশিকা পরীক্ষা নিলে দেশব্যাপী গোলযোগের সম্ভাবনা থাকত না। আমি বিশ্বাস করি ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষার পরিচালনা কঠোরভাবে আঞ্চলিক হওয়া প্রয়োজন। কোথাও কোন বিষক্রিয়া হলেও তার প্রভাব আঞ্চলিকভাবে সীমাবদ্ধ থাকে । অতীতেও ছাত্ররা এইমসের জন্য পৃথক পরীক্ষায় যেতে পারত। ভেলোর সিএমসির পরীক্ষায়, পন্ডিচেরির পরীক্ষায় পৃথকভাবে সুযোগ পেতো। আসলে বর্তমান শাসকের চেতনায় এক দেশ, এক ধর্ম, এক নেতা, একদল, এক আইন, এক ভোট, একটা কেন্দ্রীকতার দর্শন কাজ করছে। তারই ফলশ্রুতি নিট ইউজি পরীক্ষার বিভ্রাট।
মহামান্য আদালত, একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন ব্যবস্থার মধ্যেই গলত সৃষ্টি হয়ে আছে। একবার ভেবে দেখুন, নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে যে গণতান্ত্রিকতা ছিল, তা আজ অন্তর্হিত। বিচার ব্যবস্থায় বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে যে কলেজিয়াম এর গুরুত্ব ছিল, বর্তমান সরকার কলেজিয়ামের সদস্যদের ঢেলে সাজাতে চাইছেন। যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিপত্য থাকবে। এমন একটি ব্যবস্থায় সর্বভারতীয় স্তরে ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষায় কাঠামো ত্রুটিহীন হবে ভাবা যায় কি?
এরপরেই প্রশ্ন আসে এমসিকিউ ধরনের উত্তর কেন থাকবে? এই ধরনের পরীক্ষায় মেধার যথাযথ যাচাই করা যায় না। বরং একজন মেধাহীণ ও মেধাবী ছাত্রের পার্থক্য করা যায় না। সর্বোপরি ওএমআর শীটে দুর্নীতি সম্ভাবনা বেশি থেকে যায়। একটি বর্ণনাধর্মী, আলোচনাধর্মী, বিশ্লেষণ ধর্মী উত্তরপত্রে এই ধরনের দুর্নীতি করা অসুবিধে জনক। জানি সরকার যুক্তি দেবে, এই ধরনের প্রশ্নে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সুসমতা বজায় রাখা সম্ভব হয়। আবার এ কথাও সত্যি, এই ধরনের প্রশ্নে একটি সম্পূর্ণ ফাঁকা ওএমআর শীটকে ১০০ শতাংশ নির্ভুল হিসেবে হাজির করা যায়।
এমসিকিউ ধাঁচের পরীক্ষায় সমস্যাটা কেমন বলি। স্কুলে পড়াচ্ছিলাম মাইকেল মধুসূদন দত্তের "বঙ্গভাষা"। হে বঙ্গ, ভান্ডারে তবু বিবিধ রতন...।বলছিলাম, কবি মাইকেলের মধ্যে একটা আত্ম দংশন কাজ করছিল। তিনি বাংলা ভাষা ছেড়েছেন ইংরেজি সাহিত্য সাধনার জন্য। ইনি বঙ্গদেশ ছেড়েছেন, হিন্দু ধর্ম ছেড়েছেন, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন । এর ফলে একটা সময় মাইকেলের মধ্যে তীব্র অনুশোচনা ও আশঙ্কা, বাংলাদেশ আমাকে মনে রাখবে তো! কখনো বলছেন,
রেখো না দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে...
আবার পরক্ষণেই বলছেন,
কিন্তু কোন্ গুণ আছে,
যাচিব যে তব কাছে,
হেন অমরতা আমি,
কখনো তার জন্মভূমির কপোতাক্ষ নদকে বলেন,
সতত হে নদ তুমি পড়ো মোর মনে... তুমি যতদিন বাংলাদেশ দিয়ে বইবে, বঙ্গজ জনের কানে তুমি এই মন্ত্র শুনিও যে, বঙ্গ সন্তান প্রবাসে থেকেও বাংলাকে আজও ভোলেনি। কখনো বলছেন, আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়...এই সামগ্রিক আশঙ্কা ও আক্ষেপ থেকে, বঙ্গভাষার বিবিধ রত্ন ভান্ডার উপেক্ষা করে, তিনি ভিন্ন ভাষায় আশ্রয় নিয়েছেন, এই আক্ষেপ নিয়ে আমাদের বঙ্গভাষা কবিতা আলোচনা করব। একজন ছাত্র প্রশ্ন করল, আপনি যে কবিতাগুলোর কথা বললেন, বঙ্গভাষা ছাড়া আর কোন কবিতাই তো আমাদের কাজে লাগবে না। সিলেবাসে নেই। তাহলে এগুলো বললেন কেন? ছাত্র ঠিকই বলেছে স্যার। এমসিকিউ উত্তর দিতে পটভূমি, বোধ, অনুভূতি, বিচার্য নয়।
পরীক্ষা সর্বভারতীয় হওয়ার ফলে তার প্রতিযোগিতা অনেক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে হাজির হয়। এর জন্য বিশেষ কোচিং এর প্রয়োজন হয়। বিশেষ কোচিং এর জন্য কিছু বিশেষ সংস্থা গড়ে ওঠে। সেই সংস্থা লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময় কোচিং দেয়। তারা নানাবিধ পরীক্ষা অনুশীলন অভ্যাস করায়, যে অনুশীলনটা অনেকটাই যান্ত্রিক। ছাত্রের কাছে শুনেছি জ্ঞানের ভিত্তিতে বা বোধের ভিত্তিতে উত্তর দিতে গেলে অর্ধেক উত্তর দেওয়া সম্ভব। কারণ হাতের সময় অত্যন্ত সীমিত। কোচিং সেন্টারে অবিরাম অনুশীলন অভ্যাসের মধ্য দিয়ে যান্ত্রিকভাবে কোন্ প্রশ্ন তার কোন্ উত্তর রপ্ত করানো হয়। সেখানে যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগের সুযোগ নেই। যে কোচিং সেন্টার যত বেশি যথাযথ প্রশ্নপত্রের অনুশীলন করাবে তাদের সাফল্যের হার ততই বাড়বে। এই কোচিং সেন্টার শেখায় যে বিদ্যালয় কলেজ এগুলি অর্থহীন। তাদেরই একটি নির্দিষ্ট স্কুলে নাম নথিভূক্ত করে রাখা হয়, বোর্ডের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য। আসল লক্ষ্য নিট ইউজি। এর ফলে অবিরাম আওড়ানোর মধ্য দিয়ে তোতা পাখির মত একটা শিক্ষা আয়ত্ত করে এবং যে কোচিং সেন্টারের অনুশীলন যত নির্ভুল, যথাযথ, সংক্ষিপ্ত ও ফাইনাল প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের অনুরূপ হবে, ততই সেই কোচিং সেন্টারে সাফল্যের হার বাড়বে। ব্যাবসাও বাড়বে। আর এই ব্যবসার বৃদ্ধির শর্ত হলো ফাইনালের প্রশ্নপত্র টি হুবহু সংগ্রহ করা। মাননীয় ধর্মাবতার, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে যুক্ত হয়ে আছে এই ধরনের কোচিং সেন্টারের বাণিজ্যিক সাফল্য। সিস্টেমের মধ্যে গলদ কিনা বুঝতে কি এখনো বাকি?
একজন এমবিবিএস পাশ করা আমার প্রাক্তন ছাত্র। তার বাবাও একজন স্পেশালিস্ট ডাক্তার। বাবাকে প্রশ্ন করলাম, ছেলে কি করছে? এম বি বি এস পাস করল, এবার আপনার তৈরি সেট আপে নিয়মিত বসছে তো? হাত পাকানোর এত ভালো সুযোগ কজন পায়? আর আপনিও সপ্তাহে দুটো দিন ছেলেকে বসিয়ে বিশ্রাম নিতে পারবেন। তারপর আবার দু চার বছর বাদে পিজির জন্য ভাববে। সেই অভিভাবক বললেন আমাদের সেই দিন গেছে। হেল্থ সার্ভিসে জয়েন করে কয়েক বছর অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তারপর এমডির জন্য প্রস্তুত হতাম। এটা শুধু আমি না, আমাদের বন্ধু বান্ধব সবাই এমবিবিএস করার ৪/৫ বছর পর পোস্ট গ্রাজুয়েশন করত। কিন্তু এখন এমবিবিএস এর পরেই পিজির প্রস্তুতি শুরু হয়। শুরু হয় আবার কোচিং। সেই কোচিংয়ে এমন পড়ানো হয় যে, হুবহু সেইরকমই প্রশ্ন পরীক্ষায় আসে। প্রেক্ষাগৃহ বুকিং করে সেখানে মুম্বাই দিল্লি চেন্নাই থেকে ডাক্তার উড়ে আসছে। পাওয়ার পয়েন্টে ডেমনস্ট্রেশন করে লেকচার দিচ্ছে। সকাল থেকে সারাদিন এটা চলবে। ব্রেকফাস্ট থেকে লাঞ্চ সবই সেখানে হবে। আমার ছেলেও সেই লেকচার শোনার টিকিট কেটেছে, ১০ হাজার টাকার টিকিট। বক্তা নামি চিকিৎসক। ভোরের ফ্লাইটে আসছেন, সারাদিন বক্তৃতা দিলেন, আলোচনা করলেন, কয়েক কোটি টাকা নিয়ে রাতের ফ্লাইটে ফিরে গেলেন। ওই লেকচারটা এটেন্ড না করলে পিজি পরীক্ষায় বহু প্রশ্নের উত্তর করা যাবে না। পরীক্ষা হলে গিয়ে অবাক হয়ে দেখবে যা যা লেকচার দিল, ঠিক সেগুলোই প্রশ্নে রয়েছে। মহামান্য আদালত, সিস্টেমটার পবিত্রতা বজায় আছে তো? কি মনে হয় ?
এভাবে যে ছাত্রটি লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করে ডাক্তারি পরীক্ষার প্রবেশিকায় উত্তীর্ণ হল, একটি সুনাম ধন্য মেডিকেল কলেজে ভর্তি হল। সেই ছাত্রটি ডাক্তার হওয়ার পর তার প্রধান লক্ষ্য কি হবে? প্রধান এবং প্রথম লক্ষ্য হবে, যে অর্থ ও সময় এতদিন ব্যয় করলাম, কত দ্রুত সেই অর্থ রিটার্ন পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করা। আর বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোম, ওষুধ কোম্পানি, তারা তো মধুমক্ষিকা হয়ে মৌচাকের চারপাশে গুঞ্জন করে চলেছে -- ভালো দামি ফ্ল্যাট, অসাধারণ ইন্টিরিয়ার, চোখ জুড়ানো গাড়ি, এসবের হাতছানি। সঙ্গে আছে বিদেশ ভ্রমণ ও বিদেশী ডিগ্রি অর্জনের ব্যয়ভার বহন। এসব মিলিয়ে একটা দারুন আয়োজন। সেই কেজি নার্সারি থেকে শুরু হয়েছিল কোচিং আর কোচিং, তারপর এমবিবিএস পাশ করার পরেও কোচিং শেষ হলো না। এমডির জন্যেও চাই কোচিং। আমার এক ছাত্র তখন এমবিবিএস পড়ছে। তাকে একদিন ফোন করেছিলাম, সে জানালো এখন আমি একটু ব্যস্ত আছি, অমুক স্যারের কাছে ফিজিওলজির প্রাইভেট কোচিং ক্লাশ করতে এসেছি। বেরিয়ে আপনাকে ফোন করবো। সেদিন জানলাম ডাক্তারি পরীক্ষাতেও প্রাইভেট কোচিং চলে। কিছু জানার ও জ্ঞানার্জনের চেষ্টায় নেই আমি তখন কার্ডিয়াক বাইপাস সার্জারির পর আইটিইউতে ভর্তি। নার্সিংহোমগুলোতে রাতে ডিউটি করতে আসে এম বি বি এস পাশ করা ছাত্ররা। তাদের উদ্দেশ্য, নাইট ডিউটিতে সারারাত পড়াশুনা করা। পেশেন্টের দিকে মনিটরিং টাও তারা করে না। অথচ সেখানেই আছে ওর পাঠ্যসূচির বিষয় জলজ্যান্ত। সকাল হলে ঘন্টা হিসাব করে টাকা গুনে নেয়, ঘরে চলে যায়। ওর কাছে একদিকে রাত জেগে পড়াও হলো। আবার মোটা টাকা অর্থ উপার্জন হলো। ধরুন না ঘন্টায় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকার হিসেবে ৮-১০ ঘণ্টা ডিউটি। এভাবেই কোথাও কোন জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টার নেই। শুধুই ডিগ্রি অর্জন, আর পয়সা অর্জন, learning এর অপর নাম earning.
এর ফল হল এমডি করে যে ছেলেটি চাকরিতে জয়েন করে, তারা সিনিয়র ডাক্তার, এমনকি নার্সদের কাছে কেমন হাসির খোরাক হয় শুনুন। এমার্জেন্সিতে একজন ৬৮ বছর বয়স্ক পেশেন্ট এসেছে। তার কথায় জড়তা (slurring) হচ্ছে। সেই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ (blood pressure high), আরো সমস্যা হলো পেশেন্টের খিঁচুনি (convulsion) হচ্ছে ও সেই সাথে মুখ দিয়ে সাদা ফেনা (white foaming) উঠছে। আই সি ইউ তে সে সময় রয়েছে নব্য এমডি করা ডাক্তারবাবু। তিনি পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছেন না, কি করবেন, কি বলবেন, দিশেহারা। এই পেশেন্টকে যে ডাক্তারবাবু দেখেন ও আইসিইউতে পাঠিয়েছেন সেই কনসালটেন্ট কে ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না। পেশেন্টের সমস্যা বেড়ে চলেছে। হাতে সময় কম। পরিস্থিতি দেখে বুঝে অগত্যা সিস্টার নিজেই দায়িত্ব নিলেন। পেশেন্টকে left lateral side করে শুইয়ে দেওয়া হল। কারণ ওই সময় যে ভমিটিং ও ফোমিং হচ্ছে তা শ্বাসনালীতে ঢুকে শ্বাসবন্ধ যাতে না হয় তার জন্য এই ব্যবস্থা। এরপর ১৪ নম্বর সাকশন ক্যাথিটার দিয়ে সাকশন করে নাক মুখের ভেতর পরিষ্কার করা হলো। তারপর অক্সিজেন মাস্ক দেওয়া হলো। পেশেন্ট খুব ছটফট করছিল (restless), তাই পেশেন্টকে ঘুম পাড়ানোর জন্য সিডেসিভ ইনজেকশন, তারপর এন্টি কনভালশন ইনজেকশন levipil 1gm stat দেওয়া হলো। পরবর্তী দুদিন এই ইঞ্জেকশনই দিনে দুবার করে চালাতে বলা হলো। একে একে রাইলস টিউব, ক্যাথিটার করানো হলো। সিটি স্ক্যান অফ ব্রেন করা হলো। এবিজি (arterial blood gas) করতে দেওয়া হল। অনুমান করা হলো সিভিএ (cerebral vascular attack). পরে সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাক্তার কে নব্য ডাক্তারটি ফোন করে সমস্ত রিপোর্ট জানায়। সিনিয়র ডাক্তার বলেন "কি কি করেছো বলো?" সে নার্সের দেওয়া এডভাইসগুলি আওড়ে গেলো। সিনিয়র ডাক্তার বলেন "গুড! ওয়েল ডান। রাইট ডায়াগনোসিস!" আর নব্য ডাক্তার ফোন নামিয়ে রেখে, নার্সকে বলে "থ্যাংক ইউ সিস্টার। এ যাত্রা আপনি বাঁচালেন।" ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানের বয়।
আমরাও না হয় এভাবেই এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে যাব ধর্মাবতার। কিন্তু এই নব্য ডাক্তার রা আর ১০-১৫ বছর পর সিনিয়র ডাক্তার হবে। ওইসব সিনিয়র সিস্টাররাও তখন থাকবেন না। তখন আমি রোগী হিসেবে ইমার্জেন্সিতে এডমিশন নিলে আমার কি হবে স্যার? তাহলে গল্পটা বলেই ফেলি আমার একজন ছাত্র ডাক্তারি পড়ে। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলল, জানেন আমি না ফার্মাকোলজিটা একদম বুঝতে পারছি না। ওটা যদি কেউ একটু বুঝিয়ে দিত ভালো হতো। আমি তাকে আগ বাড়িয়ে বললাম, ঠিক আছে তোদের সিনিয়র এক দাদা এখন তোদের কলেজেই এমডি করছে। তাকে বলে দেবো। ওর কাছে বুঝে নিস। সেই সিনিয়ার কে আমি যখন একটু বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বললাম, সে বলল, "কি যে বলেন আপনি, লজ্জায় ফেললেন দেখছি। কবে পরীক্ষা দিয়েছি, পরীক্ষার পরেই ফার্মাকোলজি ভুলে গেছি। ইনহিবিশন আরকি। অত কি আর মনে রাখা যায়।ফার্মাকোলজি আমি বুঝতে যাব কেন। ওটা তো এমআর (মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ) রা বলে দেবে, কোন ওষুধের কি বৃত্তান্ত, তার ঠিকুজি, কুষ্ঠি। ফার্মাকোলজি বুঝে যদি ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়, তাহলে তো আদ্যিকালের বদ্যি বুড়োর মত মিক্সচার বানাতে হবে। স্রেফ মুখস্ত করতে বলুন । আমি কিন্তু মুখস্ত করেই ফার্মাকোলজিতে অনেক নম্বর পেয়েছিলাম। বোঝার দরকার নেই।
বুদ্ধি না, মেধা না, শুধুমাত্র কিছু মুখস্ত বিদ্যা, স্মৃতির ভান্ডার, আর ছবির মত মনে রাখা। এর জন্য লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা ব্যয়। অনেকে যারা যুক্তি বুদ্ধি বর্জিত মুখস্ত বিদ্যার উপর আস্থা রাখতে পারে না, তাদের মানসিক সমস্যা দেখা যায়। কেবলই ভাবে আমি হেরে যাচ্ছি, আমি পারছি না, এই সুবিশাল জ্ঞান সমুদ্র পাড়ি দেওয়া, আমার দ্বারা এটা হবে না। যার পরিণতিতে প্রতিবছর এই ধরনের কোচিং পাড়ায় ঘনঘন আত্মহত্যার খবর আসতে থাকে । কোটা বুঝি জলজ্যান্ত মৃত্যুপুরী। আর যারা এরপরেও টিঁকে থাকে, তাদের এক বৃহৎ অংশ কোটি কোটি টাকা খরচ করে পরীক্ষা কেন্দ্র কিনে নেয়, গোধরায়, হরিয়ানার জর্জর, কিনে নেয় প্রশ্নপত্র। আত্মবিক্রয় করে। আত্মাহুতির বিপরীতেই তো থাকে আত্মবিক্রয় তাই না?
ধর্মাবতার, আপনাকে বলছি স্যার। সিস্টেমে ঘূণপোকার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন?