দোঁহা

রাখালদেবতার রাখালিয়াগীত: ভীমসেন জোশির মারাঠি অভঙ্গ গান

 

ঋত্বিক মল্লিক 

ভীমসেন জোশি। ভারতীয় সংগীতের কিরানা ঘরানার উজ্জ্বল নক্ষত্র। মনে রাখতেই হবে, এই কিরানা ঘরানায় ইতিপূর্বেই আলো জ্বেলেছেন স্বয়ং আবদুল করিম খান এবং কিংবদন্তি সংগীতগুরু রামভাউ কুন্ডাগোলকর, যিনি সওয়াই গন্ধর্ব নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। কিন্তু পণ্ডিত ভীমসেন জোশির আশ্চর্য সিদ্ধি এখানেই যে, তিনি কেবল নির্দিষ্ট একটি গণ্ডির মধ্যে নিজের সাধনাজাত ফলকে বেঁধে রাখেননি। তাঁর সুরে একইসঙ্গে মেলে গোয়ালিয়র ঘরানার ‘বোল-তান’, আগ্রা ঘরানার অপূর্ব ছন্দোময় চলন, জয়পুর ঘরানার ঐশ্বর্যময় রূপ এবং অবশ্যই এই সমস্ত কিছুকেই ধরে রেখেছে কিরানার নিজস্ব স্বতন্ত্র গায়নশৈলী। জনপ্রিয়তার নিরিখে তিনি যে তাঁর প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদী গায়ক, তা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়। তবে এই বিপুল জনসমর্থন আর মুগ্ধতার রেশ কিন্তু শুধু তাঁর ধ্রুপদী সংগীত, কিংবা তাঁর গানে এই বৈচিত্র্যময় ভারতীয় রাগরূপের অসামান্য মিলমিশের কারণেও নয়।
ভীমসেন জোশি তাঁর দীর্ঘ সংগীতজীবনের আগাগোড়াই বিশুদ্ধ ধ্রুপদিয়ানার পাশাপাশি খুব নিভৃতে, ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটু একটু করে সাজিয়ে রেখে গেছেন সহজ সুরের মনকেমন-করা মায়া। সন্ত পুরন্দর দাসের ‘যাদব নি বা’-এর মতো খাঁটি কর্ণাটী ভক্তিসংগীত থেকে শুরু করে কুভেম্পু-র ‘জলগর নিনিরু দুরা’ বা ডি আর বেন্দ্রে-র ‘নানু ভিনে নিনু থান্তি’-র মতো একেবারে আধুনিক বিশ শতকের কাব্যভাষ্য পর্যন্ত সর্বত্রই সোনা ফলিয়েছে তাঁর কণ্ঠের পরশপাথর। মার্গসংগীতের জগতে অবশ্য ভজনগীতি গাওয়ার চল কোনো অর্বাচীন বিষয় ছিল না। সেক্ষেত্রে পূর্বসূরীদের রীতি মেনেই ‘হরি ভজনে মাদো নিরন্তর’ বা ‘ইয়েলে মন মুরারিয়ানে’ জাতীয় ভজন গেয়েছেন তিনি। 
তবে, ভক্তিগীতির ক্ষেত্রে পণ্ডিত ভীমসেন জোশি যে ক্ষেত্রটিতে তাঁর একেবারে স্বকীয় নিজস্বতার ছাপ রেখে গেছেন, নির্দ্বিধায় বলা যায়, সেটি মারাঠি অভঙ্গ গান। ১৯৪২ সালে এইচএমভি থেকে প্রকাশিত তাঁর সংগীতজীবনের প্রথম রেকর্ড তো বটেই, এমনকি তাঁর সংগীতায়োজনের প্রায় আবশ্যিক অঙ্গ হয়ে উঠেছিল প্রতিটি সংগীতানুষ্ঠানের শেষে একটি করে বিশেষ অভঙ্গ পরিবেশনা।

কেন পণ্ডিত ভীমসেন এই অভঙ্গ সংগীতের প্রতি আজীবন অনুগত থেকেছেন, তা বুঝতে হলে অবশ্য অভঙ্গর ইতিহাসটি একটু ফিরে দেখা প্রয়োজন। ইতিহাসের যে বিশেষ কালপর্বে আমাদের দেশের নানা জায়গায় ভক্তি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, মহারাষ্ট্রে সেই ভক্তিস্রোতের জোয়ার প্রথম নিয়ে এসেছিলেন সন্ত ধ্যানেশ্বর এবং তাঁর থেকেই ক্রমপরম্পরায় পাওয়া যায় সন্ত নামদেব, একনাথ ও তুকারামের ভক্তিকাব্য। মহারাষ্ট্রে বিট্‌ঠল দেবতাকে কেন্দ্র করে সেই ভক্তি আন্দোলন সম্প্রদায়ের একটি দল ‘ওয়ারকারি’ বলে পরিচিত হয়। এই ওয়ারকারি আন্দোলনের প্রবক্তা হিসেবে প্রাথমিকভাবে সন্ত জ্ঞানেশ্বর-এর নাম পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ শতকের ভক্তিবাদী কবি-দার্শনিক জ্ঞানেশ্বর ভগবদ্গীতার টীকাভাষ্যকার (জ্ঞানেশ্বরী) এবং অম্রুতানুভব গ্রন্থের রচয়িতা। বিট্‌ঠল বা বিঠোবা, বিষ্ণুর এই রাখালবেশী রূপকে কেন্দ্র করে গোটা মহারাষ্ট্রে দ্বাদশ থেকে শুরু করে প্রায় অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত শতাধিক ভক্তিকাব্য ও ভক্তিগীতির সন্ধান মেলে। 
গানগুলি ঠিক ব্যক্তিগত গীতপ্রকাশের জন্য নয়, বরং ভক্তি-আন্দোলনের স্বাভাবিক ধারা মেনেই এতে অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সম্মেলনকেন্দ্রিক গীতানুষ্ঠানের রীতি। ব্যষ্টির নয়, এই কীর্তনপ্রধান গানগুলির সমষ্টির সম্মিলিত ঈশ্বর প্রণিপাতের প্রকাশ। মহারাষ্ট্র জুড়ে এই কীর্তনাঙ্গের মূল তিনটি ধারা প্রাথমিকভাবে প্রচলিত ছিল— নারদীয় কীর্তন, ওয়ারকারি কীর্তন ও রামদাসী কীর্তন। পরবর্তীকালে স্বরাজ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় উত্তাল মহারাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তার ছাপ গাঢ় হয়ে পড়ে, তৈরি হয় রাষ্ট্রীয় কীর্তনের একটি আধুনিক, নবনির্মিত ধারা।
 
 
মহারাষ্ট্রের দক্ষিণে চন্দ্রভাগা নদীর পশ্চিম তীরে পান্ধারপুর অঞ্চল। এই পান্ধারপুরেই বিষ্ণুর অবতাররূপে স্বীকৃত বিট্‌ঠল দেবতা বা বিঠোবার মন্দির। এই বিট্‌ঠল দেবতাকে নিয়ে গোষ্ঠীর ভক্তি, উৎসব এবং দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার গান অভঙ্গ। ‘অভঙ্গ’ শব্দের মধ্যেই আছে এর বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত। ‘যা ভঙ্গ নয়’, বা ‘নিরন্তর’ বা ‘চিরকালীন প্রবাহিত’, তা-ই ‘অভঙ্গ’। সহজ সুরে মারাঠি ওবি ছন্দে গাঁথা অভঙ্গ বাণী। প্রথাগত মারাঠি ভজন সাধারণত শুরু হয় ‘নমন’ বা ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। এর পরের অংশটিকেই বলা হয় ‘রূপছা অভঙ্গ’, যেখানে ঈশ্বরের মানুষী অবতার বা মনুষ্যরূপের দেহসৌন্দর্যের বর্ণনা করা হয় প্রশস্তিগীতির রীতিতে। গুরুর প্রতি আন্তরিক প্রণাম ও একনিষ্ঠার ভাবও প্রকাশ পায় অভঙ্গ গানগুলিতে, বহুক্ষেত্রে ধর্মীয় নীতিবাক্য, কর্তব্য-অকর্তব্য ও আচরণীয় বিষয় নিয়ে সুরে সাজানো উপদেশও ঠাঁই পেয়েছে অভঙ্গ গানের কথায়।
 
অভঙ্গের চলনেও একটি বিশেষ ছন্দ রয়েছে। লোকমুখে কথিত আছে, এই বিশেষ ছন্দোবদ্ধ চলনটি গড়ে দিয়েছিলেন সন্ত জ্ঞানেশ্বর নিজেই, আর সাধারণের দরবারে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন সন্ত নামদেব। অভঙ্গের মূলত দুটি ধারা— দেবদ্বার আর দেবীওয়ার। চারটি চরণ নিয়ে গঠিত অভঙ্গের কাব্যশরীর। প্রথম তিনটি চরণ সমমাত্রিক, শেষ চরণটি সাধারণত তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত হয়। মারাঠি অভঙ্গ বা ভজন সাধারণত নির্দিষ্ট একটি রাগরূপে আধারিত, বহুক্ষেত্রে তার তালও পূর্বনির্ধারিত। কিন্তু যে-কোনো লোকসংগীতের অত্যন্ত প্রচলিত এবং পরিচিত বৈশিষ্ট্যের মতোই, এক্ষেত্রেও খুব ধরাবাঁধা সুরের কাঠামোয় অভঙ্গকে সবসময় বেঁধে রাখা যায়নি। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভঙ্গগুলির একাধিক গায়নরীতি গোটা ভারত জুড়ে প্রচলিত, উপরন্তু নির্দেশিত রাগরূপ থেকে বিচ্যুতিও খুবই সাধারণ ব্যাপার। বহুকণ্ঠে গীত হতে হতে, গায়কের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত রুচির নিরিখে বৈচিত্র্যময় বদল এসেছে মারাঠি অভঙ্গতে। ধাতুনির্মিত বাদ্যযন্ত্র ‘তাল’ এবং পাখোয়াজে বেজে-ওঠা ধূমালী বা ভজনী তালের সংগতেই সাধারণত গাওয়া হয় অভঙ্গ, সঙ্গে থাকতে পারে একতারা, বীণা তানপুরা, চিপলি অথবা ঝাঁঝর, একেবারে আধুনিক সংযোজন হিসেবে হারমোনিয়াম অথবা তবলার ব্যবহারও রীতিমতো জনপ্রিয়। মূল তারযন্ত্রটি, একতারা হোক বা বীণা, সেটি থাকে মুখ্য গায়কের হাতে, সঙ্গে থাকেন দোহার দল, যাঁরা ধুয়ো তুলে গানটি এগিয়ে নিয়ে চলেন ক্রমাগত। অভঙ্গ গানের সঙ্গে একটু আলাপ, তান এবং সরগমের জোড়মিল খোলে ভালো। অধিকাংশ অভঙ্গের সুর কিন্তু একেবারে মারাঠি লোকসংগীতের ছাঁচে বসানো। আর সেই সব সুর মহারাষ্ট্রে প্রচলিত গাওলান (কিশোরী মেয়ের গান), বিরানি (বিরহগীত), ভারুদ, আউয়ি, পঞ্চপদী— প্রায় সব ধরনের লোকজ গীতিপ্রচেষ্টার মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায়।
 
 
কর্ণাটকের তৎকালীন ধারওয়াড় জেলার রণ অঞ্চলের সঙ্গে মহারাষ্ট্রের পান্ধারপুরের দূরত্ব তিনশো কিলোমিটারের মতো। কর্ণাটকের এই রণে বড়ো হচ্ছিলেন ভীমসেন। একেবারে শৈশব থেকেই সুরের প্রতি এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ ছিল ভীমসেন জোশির। জীবনের যাবতীয় অনুভূতির গভীর স্পর্শ বয়ে কানের ভেতর দিয়ে তাঁর মরমে তোলপাড় তুলত গানের সুর, ছন্দ। এমনও হয়েছে, গান শুনতে শুনতে পথচলতি শোভাযাত্রার সঙ্গে আপনমনে সব ভুলে চলতে শুরু করেছেন তিনি। সম্বিত ফিরেছে যখন, বেলা গড়িয়ে অসময়। ঘরে ফিরেছেন যখন, মাথার মধ্যে শুধুই সুরের সুসময়। ছোটো থেকেই সংগীতপাগল ভীমসেন বাড়ির পাশ দিয়ে-যাওয়া এরকম যে-কোনো গানের দলের সঙ্গে গানের টানে বেরিয়ে পড়তেন, তাদের পিছন পিছন যেতেন যতটা সম্ভব। তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন অজানা পথের ধারে, পাথরে মাথা রেখেই। এদিকে বাড়িতে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যেত না তাঁকে, ছেলের খোঁজে পুলিশের কাছে হাজির হতেন বাবা, গুরুরাজাচার্য জোশি। পেশায় শিক্ষক ছিলেন গুরুরাজাচার্য। বারবার এই ঘটনা ঘটতে থাকায় বিরক্ত হয়ে শেষপর্যন্ত ছেলের প্রতিটি জামায় লিখে দিতেন, ‘শিক্ষক জোশির ছেলে’। যাতে পথের প্রান্তে, আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুমিয়ে-থাকা ভীমসেনকে কেউ-না-কেউ বাড়ি পৌঁছে দিতে পারে। যত দিন গেছে, তত বেড়েছে এই বেরিয়ে পড়ার অভ্যাস। শহর থেকে গ্রামে, নগর থেকে গঞ্জে ফিরেছেন তিনি সুরের টানে। এমনকি এই কলকাতাতেই আর-এক সংগীতপ্রতিভা পাহাড়ি সান্যালের পায়ের কাছে ভৃত্য হয়ে থেকে যেতে চেয়েছিলেন জোর করে, শুধু একটু গান শুনবেন বলে! তখন অবশ্য বয়সও নেহাতই অল্প। 

ভীমসেনের ছেলেবেলার এই প্রবণতা থেকে দুটি সম্ভাবনার কথা মনে হয়। সুরের প্রতি এমন আশ্চর্য আকর্ষণে যে ঘর ছাড়তে পারে, তার মধ্যে ভক্তির এক চোরা স্রোত থাকাটা অসম্ভব নয়। আর মহারাষ্ট্র ঘেঁষা এই অঞ্চলে মারাঠি ভাষা আর মারাঠি ভক্তিমূলক গানের একটা প্রভাব থাকতে পারে। ১৯৪১-৪২ সালে যখন লখনউ বেতারে ছিলেন, তখন সাপ্তাহিক দশ মিনিটের ভজনগীতিটি তিনিই নিয়মিত গাইতেন। ১৯৪৩ সালে তিনি পাড়ি দেন তৎকালীন বোম্বাই শহরে, চাকরি শুরু করেন বেতারশিল্পী হিসেবে। মহারাষ্ট্র এবং মারাঠি ভাষাসংস্কৃতির সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মধ্যেই সম্ভবত রয়ে গিয়েছিল মারাঠি ভাষায় লেখা অভঙ্গ বাণীর প্রবেশের বীজ। এমন সুরপাগল মানুষ যে অর্থমূল্যে বা শ্রেণিমূল্যে সংগীতের জাতবিচার করবেন না, সে তো বলাই বাহুল্য! গান আসরের হোক বা ঠাকুরদালানের, ব্যক্তিগত সাধনারই হোক বা জনরঞ্জিনী সুরের— পণ্ডিত ভীমসেন জোশি শুধুই সুরের অনুগত। হিন্দুস্তানি সংগীতপরম্পরার সার্থক উত্তরসূরী হয়েও মারাঠি লোকগীতির মিষ্টি সুরে আর ছন্দে সেজে-ওঠা এই অভঙ্গ গীতসংরূপটিকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন সব অর্থেই।

সারাজীবনে অভঙ্গ গেয়েছেন প্রচুর, তার মধ্যে সন্ত তুকারামের লেখা অভঙ্গ গান যেন ভীমসেনের গলায় এক অপূর্ব মুর্ছনায় ভরিয়ে দেয়। মালকোষ রাগে ‘সাবরি সুন্দর রূপ মনোহর’ কিংবা শিবরঞ্জনী রাগে ‘রাজাসে সুকুমার মদনাঞ্চ পুটড়া’ গান এর উদাহরণ হতে পারে। এছাড়াও ‘বিট্‌ঠল গীতি গাওবা’, ‘বিট্‌ঠল হা চিট্টি’, ‘পাবল পান্ধারি বৈকুণ্ঠ ভুবন’ তুকারাম আর ভীমসেনের বিখ্যাত যুগলবন্দি।।  তাঁর কণ্ঠে একনাথের বিখ্যাত ‘মাঝে মাহের পান্ধারি’ এক আশ্চর্য সৃষ্টি। পবিত্র ভূমি পান্ধারপুর একনাথের মাতৃভূমি, তাঁর পিতা-মাতা হলেন বিট্‌ঠলদেব আর রুক্মিনী, ভগিনী চন্দ্রভাগা নদী যিনি সব পাপ ধুয়ে দেন আর ভক্ত পুণ্ডলিকা তাঁর বঁধু। আগেই বলেছি, এই অভঙ্গগুলি মূলত সম্মেলকগীত। ফলে সমষ্টিগানের আনন্দ আর উৎসবমুখরতার ছাপ লেগে রয়েছে এই গানটির সুরেও। কিন্তু ভীমসেন একেই যখন বেছে নিচ্ছেন ব্যক্তিগত গীতপরিবেশনার জন্য, তখন তাঁর নির্বাচিত দ্রুত লয়, কণ্ঠস্বরের উদাত্ত প্রক্ষেপণ আর মন্দিরার  শ্বাস ধরা-ছাড়ার ফাঁকে ফাঁকে ঘনঘন মন্দিরার অনুরণন গানটিকে মুহূর্তেই অলংকারে সাজিয়ে তোলে। এই গান পান্ধার নগরীর কীর্তন, বিট্‌ঠল দেবতা আর রুক্মিণীর কীর্তন, চন্দ্রভাগা নদী আর সবুজ মাটির কীর্তন আর সেইসঙ্গে অবশ্যই ভক্তের চিরপরিচিত মায়ের ঘরটি, তার দেশগাঁয়ের একেলা নিরালা ঠিকানাটিরও কীর্তন। আশ্চর্য সংবেদনশীলতায় এই আরতিটি অভিমুখ তাঁর গানে ছুঁয়ে যাচ্ছেন ভীমসেন জোশি, নিরলংকার সুরের মাধুরী দিয়ে। এই প্রসঙ্গে আরেকটি গানের কথা বলি, সন্ত নামদেবের লেখা ‘পান্ধারিচ বাস চন্দ্রভাগে স্নান’। এই যে পান্ধারপুরে তিনি থাকেন আর চন্দ্রভাগায় স্নান করেন, মুখে সদাই নামকীর্তন আর সন্ত দর্শন, সারাজীবন যেন এভাবেই কেটে যায় নামগান করে। আভোগী কানাড়ায় সমর্পিত এই গানটি ভীমসেন গলায় অনবদ্য। সন্ত নামদেবের গান ‘তীর্থ বিট্‌ঠল, ক্ষেত্র বিট্‌ঠল’ ভীমসেনের কণ্ঠে গানটি শুনতে শুনতে কুমার গন্ধর্বের গাওয়া গোরক্ষনাথের নির্গুণ ভজন ‘শূন্য ঘর শহর, শহর ঘর বস্তি’ গানের অনুরণন কানে বাজতে থাকে। সন্ত রামদাস  ‘আরম্ভি বন্দিন অযোধ্যে চ রাজা’ আর ‘রামা চ ভজন তেচি মাঝে ধ্যান’ গান দুটির কেন্দ্রীয় চরিত্র রাম, দুটি গানেই রামের নামগান এবং এই রামনামেই যে সংকট মোচন সেই কথাই বলা হয়েছে। এই দুটিও ভীমসেনের অতি জনপ্রিয় অভঙ্গ গান।
 
 
সংগীতের সংরূপ নির্বাচনের নিরিখে শুধু নয়, পণ্ডিত ভীমসেনের আরও একটি বিশেষত্ব অবশ্যই রয়ে গেছে খাঁটি রাগসংগীতের পাশাপাশি এই তুলনামূলক লঘু সংরূপগুলি পরিবেশনার রীতির মধ্যে। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদী গায়ক তিনি। ধ্রপদী রাগরূপের বিন্যাস ও আলংকারিক চলন বারংবার তাঁর কণ্ঠের অপূর্ব কারুকাজে যখন ধরা পড়েছে, তখন তাঁর আশ্চর্য স্বরক্ষেপণের দক্ষতা, দ্রুত থেকে শুরু করে বিলম্বিত পর্যন্ত অবাধ গতায়াত শুনে চমৎকৃত হয়েছে আপামর শ্রোতা। অথচ, সেই তিনিই যখন অভঙ্গগীতির মতো সহজ সরল সুরের একটি রূপকে কণ্ঠদান করেন, তখন তার স্বাভাবিক চলন এতটুকু ক্ষুণ্ণ করেননি কোথাও। দক্ষতা প্রদর্শনের বেলাগাম তাগিদ যেন ভারতীয় ভক্তিগীতির সুরের সারল্য আর কথার মাধুর্যের অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে তাঁর যে বিশেষ প্রযত্ন বজায় থেকেছে চিরকাল— এই অপূর্ব পরিমিতিবোধ সত্যিই অবাক করে দেওয়ার মতো। সাংগীতিক কারুকার্যময়তা ফুটিয়ে তোলার ঐশ্বরিক প্রতিভা নিয়ে এসেও, কতদূর পর্যন্ত সেই প্রতিভার সদ্ব্যবহার করলে, তা সংগীতের মূল ভাবটিকে বজায় রাখতে পারে, সে বিষয়ে চিরকালই ছিলেন সচেতন। অনাড়ম্বরতাই ভারতীয় ভক্তিগীতির চিরকালের অলংকার, বাইরে থেকে সুর আর স্বরের জটিল গয়না চাপিয়ে তাকে বিড়ম্বিত করার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না একেবারেই। অনায়াস গতি আর অকপট মাধুর্য— এইই তাঁর গানের সম্পদ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন