মিঠুন মুখার্জী
সঙ্গীত প্রিয় ভারতবাসী। ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্যে সঙ্গীত ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। সারা বিশ্বের মানুষ সঙ্গীতকে জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মনের হতাশা ও একাকীত্ব দূর করার জন্য সঙ্গীতের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কথায় বলে, যে মানুষ ফুল, শিশু ও সঙ্গীত ভালোবাসে না, সে অনায়াসে মানুষ খুন করতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে সঙ্গীতের ঘরানা গড়ে উঠেছে। ভারতবর্ষের বুকে এযাবত অসংখ্য বড় বড় পন্ডিত, ওস্তাদ ও সঙ্গীতশিল্পীর জন্ম হয়েছে, যাঁরা তাদের সঙ্গীতকলার উপর নির্ভর করে ভারতবর্ষের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। কেউ আধুনিক, কেউ চলচ্চিত্রের গান, কেউ রবীন্দ্রসংগীত, কেউ নজরুল গীতিকে তাঁদের চলার পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আবার কেউ ভারতের প্রাচীন শাস্ত্রীয় সংগীতকে সাধনার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
সমগ্র ভারতবর্ষের বুকে অতীতকাল থেকে বহু শাস্ত্রীয় শিল্পীর জন্ম হয়েছে, যাঁরা নিজেদের প্রতিভার দীপ্তিতে দেশ মাতৃকার সঙ্গে নিজের নামও উজ্জ্বল করেছেন। হাজার হাজার গুণী শ্রোতাকে মনোরঞ্জন করে তাঁদের প্রশংসায় অভিভূত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ভীমসেন জোশী। ধ্রুপদী সঙ্গীতে তিনি একটা যুগ বললে ভুল বলা হয় না। তাঁর সম্পর্কে যতই আলোচনা করা হোক না কেন, তা তুলনামূলকভাবে কম।
এই প্রবাদপ্রতিম প্রতিভাধর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী ভীমসেনকে খেয়াল গায়কির স্কুল বলা হয়। সঙ্গীত শেখার ছাত্রদের বলা হয় যে তাঁরা যদি খেয়ালে রাগগুলির বিশুদ্ধতা শুনতে চান এবং এই রাগগুলি বা রাগদারি (রাগগুলি উপস্থাপন করা) গাওয়ার আদর্শ উপায় জানতে চান তবে তাঁদের অবশ্যই ভীমসেন জোশীর কথা শুনতে হবে। ভীমসেন জোশী কন্নড়, সংস্কৃত, হিন্দি এবং মারাঠি ভাষায় অনেক ভজন (ভক্তিমূলক গান) এবং 'অভঙ্গ' গেয়েছেন, যেগুলো খুবই জনপ্রিয়। ভীমসেন জোশী কিংবদন্তি পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং বালামুরলিকৃষ্ণের সাথে গান গেয়েছেন এবং অসংখ্য 'মাস্টারপিস' তৈরি করেছেন। তরুণ প্রজন্মের গায়কদের মধ্যে, তিনি ওস্তাদ রশিদ খানের সাথেও গান করেছেন যিনি রামপুর সাসওয়ান ঘরানার অন্তর্গত। তবে সমসাময়িক সঙ্গীতের ধারাক্রম ভীমসেন জোশীকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তাঁর উপর একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করার সময়, গুলজার জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আপনি যখন আজকের গায়কদের কথা শোনেন তখন আপনার কেমন লাগে?" তাঁর উত্তর ছিল, "আমরা বড়ে গুলাম আলি, আমির খান এবং গুরুজির (সওয়াই গন্ধর্ব) গান শুনেছি এবং তাঁদের গান আমাদের গানে গেঁথে আছে। আজ অনেক গায়ক আছেন যাঁরা বুদ্ধিমান। তাঁদের প্রশিক্ষণও ভালো, কিন্তু তাঁদের গান আমার হৃদয় স্পর্শ করতে অক্ষম।” ভীমসেন মনে করতেন যে বিশুদ্ধ রাগ গাওয়ার শিল্প আয়ত্তের পাশাপাশি এটি উপস্থাপনে একজনকে সমানভাবে উজ্জ্বল হতে হবে। যাতে কেউ যখন গান গায়, শ্রোতা যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়। ভীমসেন জোশী নিজেই এমন তেজস্বীতার উদাহরণ।
সেই সময় তানপুরা ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন তিনি। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তিনি রেওয়াজ করতেন। কখনো কখনো সেই বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তেন তিনি।
ভীমসেন জোশীর প্রথম সঙ্গীত শিক্ষক ছিলেন কুর্তাকোটির চন্নাপ্পা, যিনি বর্ষীয়ান গায়ক ইনায়েত খানের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ভৈরব এবং ভীমপলশ্রী রাগ শেখার পর, অন্য শিক্ষকদের দ্বারা উন্নত প্রশিক্ষণের সাথে সাথে তিনি যে এক এবং একমাত্র অনন্য জোরালো স্টাইলটি গড়ে তুলেছিলেন তার জন্য চন্নাপ্পা থেকে প্রাপ্ত প্রাথমিক প্রশিক্ষণের জন্য দায়ী।
ভীমসেন জোশী শৈশবে উস্তাদ আব্দুল করিম খানের ঠুমরী 'পিয়া বিন নাহি আবত চৈন'-এর একটি রেকর্ডিং শুনেছিলেন, যা তাঁকে সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। ১৯৪১ সালে মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি মঞ্চে প্রথম পারফরম্যান্স করেন। মারাঠি এবং হিন্দিতে কয়েকটি ভক্তিমূলক গান দিয়ে তাঁর সঙ্গীত জীবনের সূত্রপাত হয়। ১৯৪৩ সালে তিনি কর্নাটক ছেড়ে মুম্বাই পাড়ি দেন। মুম্বাইয়ে এসে রেডিওতে গান গাওয়ার সুযোগ পান তিনি। তাঁকেও কম পরিশ্রম করতে হয়নি। খুব সহজেই সব জায়গায় সুযোগ জোটেনি তাঁর। ১৯৪৬ সালে তাঁর গুরু সওয়াই গন্ধর্ব-এর ৬০তম জন্মদিন উদযাপনের জন্য একটি কনসার্টে তাঁর গান তাঁকে দর্শক এবং তাঁর গুরু উভয়ের কাছে প্রশংসিত করেছিল। ১৯৮৪ সালে, তিনি তাঁর ১ম প্ল্যাটিনাম ডিস্ক পেয়েছিলেন, প্রথম হিন্দুস্তানি কণ্ঠশিল্পী হিসেবে এই পুরস্কার প্রাপ্ত হন।
সেই সময়গুলো ভীমসেন জোশীকে গানের ভীমসেনে রূপান্তরিত করতেও বড় ভূমিকা পালন করেছিল। এটা এমন একটা সময় যখন মাইক ছিল না বা না থাকার সমান। সেজন্য, একটি সহজাত প্রতিভা থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হত। একজন গায়ক এবং কুস্তিগীরকে একই মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। ভীমসেন জোশীর সামনে বড়ে গুলাম আলি, ফৈয়াজ খান, আবদুল করিম খান এবং আবদুল ওয়াহেদ খানের মতো সিনিয়ররা ছিলেন, যাঁরা গলার ব্যায়ামের পাশাপাশি তাদের শরীরের জন্য কঠোর পরিশ্রমও করেছিলেন। এবং তাঁদের এত শক্তি ছিল যে গান গাওয়ার সময় তাদের মাইকের প্রয়োজন হতো না। কুমার গন্ধর্ব এবং মল্লিকার্জুন মনসুরের মতো শক্তিশালী গায়ক ছিলেন তাঁর সমকক্ষ দলে।
একটা সময় ছিল যখন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুধুমাত্র দরবার ও ঘরানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয়, প্রয়াগ সঙ্গীত সমিতি এবং ভাতখন্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানগুলি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু একই সময়ে, সঙ্গীতের গুণমান মারাত্মকভাবে খারাপ হয়। জোশীজিও একমত যে স্কুলে শিল্পী তৈরি করা যায় না। শিল্পী হওয়ার জন্য গুরুর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণই একমাত্র উপায়। ভীমসেন জোশী সারা দেশে শিল্পীদের সন্ধান করতেন এবং তারপরে তাঁদের সওয়াই গন্ধর্ব মহোৎসবে গান গাওয়ার সুযোগ দিতেন, এমন একটি উৎসব তাঁর গুরুর স্মরণে শুরু হয়েছিল। এই উৎসবটি এতই সুনামপূর্ণ যে উৎসবে গান করার সুযোগ পেলে যে কোনও গায়ক সম্মানিত বোধ করতেন। মিঁয়া কি টোড়ি, মারওয়া, পুরিয়া ধনশ্রী, দরবারী, রামকালী, শুধ কল্যাণ, মুলতানি এবং ভীমপলশ্রী ছিল ভীমসেন জোশীর প্রিয় রাগ। কিন্তু সুযোগ পেলেই গান গেয়েছেন চলচ্চিত্রের জন্যও।
শাস্ত্রীয় সংগীত ছাড়াও বিভিন্ন অঙ্গের গান তিনি গেয়েছিলেন। ভক্তিমূলক গান, চলচ্চিত্রের গান, দেশাত্মবোধক গান, প্লে-ব্যাক ইত্যাদি। 'মিলে সুর মেরা তুমহারা' মিউজিক ভিডিও (১৯৮৮)-তে সুরারোপনের কারণে জোশী ভারতে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছিলেন, যা তাঁকে দিয়ে শুরু হয় এবং যেটি মূলত তাঁর দ্বারা রচিত হয়েছিল, যখন তাঁকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নির্মাণ করতে বলেছিলেন।
দীর্ঘ জীবনে ভীমসেন জোশী পেয়েছিলেন অসংখ্য পুরস্কার যার মধ্যে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্ম বিভূষণ এবং দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান 'ভারত রত্ন' অন্যতম। শুধু ভারত নয় সমগ্ৰ পৃথিবী তাঁর গানে মুগ্ধ হয়েছিল। ভারতবর্ষ ও ভারতের বাইরে থেকে তিনি অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছিলেন।
পরিশেষে বলা যায় ভারতীয় সঙ্গীতে ভীমসেন জোশী এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর মতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সঙ্গীতশিল্পী শুধু ভারতবর্ষ নয়, সমগ্ৰ পৃথিবীতে বিরল। পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গীত শিল্পীরা তাঁর গান শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তিনি তাঁর যোগ্য অনেক সঙ্গীত শিল্পী তৈরি করে গেছেন। যাঁরা গুরুর মতোই ভারতীয় সঙ্গীতের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। ভীমসেন জোশির গায়কী ও সঙ্গীত প্রতিভা সে দিক থেকে আজও কালজয়ী এবং পরম শ্রদ্ধার সম্পদ।