সুমি দত্তগুপ্ত
২১ শে জুন বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে, সঙ্গীত প্রেমী কিংবা সঙ্গীত সাধক মানুষদের কাছে, সঙ্গীত সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা বলে মান্যতা পেয়েছে।
আমাদের
ছোটবেলা ইন্টারনেট কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রাবল্য না থাকলেও রেডিও ছিল
সময় কাটানোর এবং বিনোদনের ও শিক্ষার একটা বড় মাধ্যম। সপ্তাহে দুটি দিন
দিল্লি থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে সম্প্রচারিত করা হত, সুনন্দা পটনায়ক,
কিশোরী আমনকরের গান। কিন্তু সত্যি বলতে কি একটুও ভালো লাগতো না। ওই বয়েসে
খেয়াল গান খুবই দুর্বোধ্য এক বিষয় ছিল।
কিন্তু,
একটু বড় বয়েসে ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা।’ হৃদয়কে ছুঁয়ে গেল। গানের
কম্পোজিশন, রেন্ডারিং, দৃশ্যায়ন সবকিছুই খুব মনকাড়া ছিল।
তখনই
শুনলাম গানটি ভীমসেন যোশীর কম্পোজিশন। সপ্ত সুরের ওপর তাঁর বীর বিক্রমে
চলন আমাদের মনে করায় নাদই ব্রহ্ম। সেই নাদ আমাদের নিয়ে চলে গানের ওপারে
অতীন্দ্রিয় জগতে। তাঁর ওই জোয়ারি কন্ঠ, রেন্ডারিং, ছোট ছোট মুড়কি, ভুবন
ভুলানো সুরের জাদুতে শ্রোতা তখন তুরীয় মার্গে অবস্থান করেন। অনেক সাধনা,
রেওয়াজ করে ওই যাদুভরি কন্ঠ মেলে।
বাবা
ছিলেন শিক্ষক, কাকা লিখতেন গান, নাটক কিন্তু কর্নাটকের ভীমসেনকে মোহিত
করেছিল গুরু আব্দুল করিম খান ও সওয়াই গন্ধর্ব এর হিন্দুস্থানী মার্গ
সঙ্গীত।
তিনি
ছুটে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন গানের আসরে, সুর তাকে পাগল করেছে, কিন্তু ‘তুমি
ডাক দিয়েছ কোন সকালে / কেউ তা জানে না' সত্যিই তো তিনি ১১ বছর বয়স থেকে
খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই সুর। ঘুরে বেড়িয়েছেন উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতের তিন
কেন্দ্র লক্ষ্ণৌ, গোয়ালিয়র, রামপুর। কাজ করেছেন গৃহ সহায়কের, অভিনেতা
পাহাড়ী সান্যালের বাড়ী, তখন কে জানত, তিনি ভবিষ্যতের হিন্দুস্থানী
সঙ্গীতের একজন খ্যাতনামা গায়ক হবেন, নন্দিত হবেন ভারতরত্ন পুরস্কার এ।
অনেক অনুনয়, বিনয়ের পরে সুযোগ মিলল সোওয়াই গন্ধর্ব এর কাছে শিক্ষা গ্রহণের। সেই শুরু, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি।
আমরা
জানি, শব্দই ব্রহ্ম। নাদ কিন্তু তাই শব্দ নয়। নাদ আমাদের পৌঁছে দেয়
অমৃতের সন্ধানে। আমরা খুঁজে ফিরি সেই উৎস, মূর্ত থেকে অমূর্ত্যে তার
পরিচলন ঘটে। তাঁর বিলম্বিত লয়ের।
গানকে
কিছুটা দ্রুত চলনে গাওয়া, সুরেলা পকড়, অনাবশ্যক তানকারী বর্জন আর
অসাধারণ সব মোচড় আমাদের নিয়ে যায় এক বিমূর্ত পৃথিবীতে অমৃত রসধারায়।
আমরা শক্তি হই, উপলব্ধি করি আমরা অমৃতস্য পুত্র /পুত্রী।
কণ্ঠের
মাধুর্য ও জাদুতে সারা ভারত কে চমকিত করে তিনি ভারত রত্ন হয়েছেন। কিন্তু
ভারতকে বেঁধেছেন ঐক্য সূত্রে তাঁর সঙ্গীতের মাধ্যমে। কিন্তু আজকের এই
অসুর-বেসুর পৃথিবীতে চারিদিকে শুধু রস নাই, রস নাই আর্তনাদ।
এই
পৃথিবীকে সংহতি সূত্রে বাঁধবে কে এমন শক্তিমান? বিধির বাঁধন ছিন্ন করে
তিনিই পারতেন সঙ্গীতের মূর্ছনায়, সুরের যাদুতে, মোহকারী লয়ে সারা ভারতকে
সুরের বাঁধনে বাঁধতে। খেয়াল গানে তাঁর অবিসংবাদিত জনপ্রিয়তা লাভ করুন না
কেন, ঠুংরি, দাদরায় তাঁর চলন ছিল সহজাত। কিরানা ঘরানার সাথে তিনি তাঁর
সহজাত আবেগপূর্ণ রেন্ডারিং সংযোজন করে তাঁর নিজস্ব শৈলী তৈরি করেছিলেন।
কন্নর, হিন্দী, মারাঠি ভাষায় তাঁর ভজন সত্যিই এক আত্মনিবেদন এবং সমর্পণ।
হিন্দি, মারাঠা, কন্নর চলচ্চিত্র জগৎ তাঁর সঙ্গীতের জাদুকে সঠিকভাবে
ব্যবহার করেছে।
তিনি
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের অধীশ্বর নিশ্চিত। তবে তাঁর নাদ হল এক
অতীন্দ্রিয় ধ্বনি যা এই খামোশি, বা কোলাহল পূর্ণ জগতে উচ্চারিত হলে তা
আমাদের নিয়ে যায় এক অন্য জগতে, বিশ্ব চরাচর ও মানব জগৎ যেখানে
নিমিত্তমাত্র। সেখানে ‘সো অহম' হিসেবে উদ্ভাসিত হওয়ার চেতনা নাদ। তাই
নাদের মধ্যে শব্দ হওয়ার বাসনা নেই। ওম কে নিজের মধ্যে অনুরণিত করার সাধনা
আছে, আর সেই অনুরণন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার মন্ত্র আছে।
শ্রেষ্ঠ
প্লে ব্যাক সিঙ্গার, লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, কর্ণাটক রত্ন,
স্বাতি সঙ্গীতা পুরস্কার, মহারাষ্ট্র ভূষণ, সঙ্গীত, নাটক অ্যাকাডেমি
ফেলোশিপ, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ পুরস্কার এ সম্মানিত হয়েছেন
তিনি। ২০০৮ সালে ভারত রত্ন হয়েছেন তিনি।
তিনি
বিশ্বাস করতেন যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে গানের কাব্যিক বিষয়বস্তু, সাতটি
নোটের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাঁর বন্দিশের আবেগ ও অনুভূতি শ্রোতার
অন্তঃকরণ স্পর্শ করে। এখানেই তো একজন গায়কের স্বার্থকতা। তাঁর ঠুমরি জাদু
ভরেলি কণ্ঠস্বরে ‘বাবুল মোরা কিংবা অব কে শাওন কিংবা পিয়া কি মিলন কি আসর
এক অনন্যসাধারণ পারদর্শিতার নিদর্শন।
“একাকী গায়কের নহে তো গান / গাহিতে হবে দুইজনে, গাহিবে একজন খুলিয়া গলা / আরেকজন গাবে মনে।”
তাঁর গাওয়া রাগ ইমন কল্যাণ, বৃন্দাবনী সারং, শুদ্ধ কেদার, মিয়া কি মল্লার শুধুমাত্র সঙ্গীত নয়। সঙ্গীতের ঊর্ধ্বে এক মার্গ দর্শন।
"পিয়া
বিন না আওয়াত" চাইন করিম খানের এই গান তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল।
যা তাঁকে অবশেষে পৌঁছে দেয় সাওয়াই গন্ধর্ব এর কাছে।
আলাপ
হল গানের প্রাণ শক্তি। আলাপের মধ্যে দিয়ে তিনি শুধু রাগের বিস্তার ঘটান
না, প্রবেশ করেন শ্রোতার হৃদ্ মাঝারে, পৌঁছে যান রাগ প্রতিষ্ঠায়, সুরজালের
মাধ্যমে তৈরি করেন এক আবহ, যে আবহে শ্রোতা, সাধক একীভূত হয়ে যান।
তিনি
বলেন, সঙ্গীত একটি অদ্ভুত ভ্রমণ, এর কোনও শেষ নেই, বাধ্যবাধকতা আছে নিখুঁত
হওয়ার, তৃপ্তি দেওয়ার, সমর্পণের, শৈল্পিকতার, আত্মাকে অনুসন্ধান করার,
মহাজাগতিক শক্তিকে এবং,প্রকৃতিকে বিশ্বাস করার। শূন্য থেকে শুরু করে একজন
শিল্পীর সাধনা থাকে সেখানে পৌঁছনোর, সেখানে শিল্পী হয়ে যান নিরাভরণ,
নিরহংকারী, বেঁচে থাকে শুধু সঙ্গীত আর তার আবেদন। তাই এমন শিল্পীকে শুধু
বলা যায়, ‘সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে তুমি আমারে ছুঁইয়াছিলে' তাই আমাদের
হৃদয়াসনে আপনার স্থান শাশ্বত, চিরন্তন। সঙ্গীত যতদিন বেঁচে থাকবে, আপনিও
প্রাসঙ্গিক থাকবেন। আপনার সঙ্গীত শ্রোতৃমন্ডলীর স্মৃতিতে সদা জাগরূক থাকবে।
দশকের পর দশক তিনি সংগীতপ্রেমীদের মনে কণ্ঠের জাদু, সুরের জাল বিস্তার
করবেন, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।