সুনির্মল বসু
আকাশ ফুটো হয়ে গেছে মনে হয়। প্রথমে হাঁটু পর্যন্ত, পরে গলাবুক জল। পুরো গ্রামটা নদী হয়ে গেছে যেন। কোথাও কোথাও বাঁশ বন, কাঠগোলাপ গাছ, জগ ডুমুরের ডাল, তাল গাছের মাথা জেগে আছে।
শস্য ক্ষেত্র জলের তলায়। মানুষের দুর্ভোগের আর সীমা নেই।
অসহায় মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
গত সাত দিন ধরে টানা বৃষ্টি চলেছে। পলাশপুর গ্রাম জলে ভেসে গেছে। পাশে রাঙ্গামাটি, সোনাডোবা সহ আশপাশের সব গ্রামগুলি জলমগ্ন। গবাদি পশু জলে ভেসে গেছে। নদীর পাড় ভাঙছে। কত আস্ত দোতলা বাড়ি নদীর জলে ধুয়ে মুছে গেল। মানুষের কষ্ট বর্ণনাতীত।
শহর থেকে অনেক দূরে পলাশপুর গ্রাম।
চারদিকে মানুষের হাহাকার। খাবারের জন্য আকাশের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রয়েছে মানুষ। সরকারি সাহায্য হিসেবে হেলিকপ্টার থেকে মাঝে মাঝে শুকনো খাবার, পোশাক, ওষুধপত্র নিচে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায়টা অতি সামান্য।
এই গ্রামের ছেলে নবীন, প্রশান্ত, গগন, প্রসন্ন প্রমুখেরা মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেক পরিবারকে নিকটের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকবার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। ওরা লঙ্গরখানা খুলেছে। লাইনে বসিয়ে মানুষকে খিচুড়ি খাওয়ানো হচ্ছে।
পূর্ণর বউ সকাল থেকে কেঁদে চলেছে। ওদের গোয়াল থেকে দুটো গরু বাছুর সমেত জলে ভেসে গিয়েছে।
ওর বর সোনা যখন বেঁচেছিল, তখন দেড় কাঠা জমির উপর যে কুঁড়েঘর বানিয়ে ছিল, সেটা খড়কুড়ো কুটোর মতো জলে ভেসে গিয়েছে।
প্রশান্ত ভোরবেলা থেকে গগনকে সঙ্গে করে দূর্গত মানুষদের সঙ্গে দেখা করে যথাসম্ভব সাহায্য করে চলেছে।
মানুষের জন্য অস্থায়ী ঘর করবার প্রয়োজনে ত্রিপল পাঠানো হয়েছিল। সেগুলি স্থানীয় নেতার বাড়িতে রয়েছে। মানুষ হাতে পায়নি।
খালের ধারে চলতে গিয়ে প্রসন্ন আজ সকালে একটি অল্প বয়সী মেয়েকে জলে ভেসে যেতে দেখেছিল। নবীন ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে উদ্ধার করেছে।
মেয়েটির কোনো সাড় নেই। প্রসন্ন কানের কাছে মুখ এনে বুঝতে পারল, মেয়েটি বেঁচে আছে।
ও বলল, গুরু, মেয়েটা বেঁচে আছে।
সত্যি বলছিস, প্রাণ আছে।
হ্যাঁ, প্রাণ আছে।
যদি প্রাণ থাকে, তবে আশা আছে।
চল ওকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাই।
হাসপাতালে জ্ঞান এলো মেয়েটার। ও বলল, ওর নাম মালতী। ওর বাবা রাধা কমল দোলুই। ওদের কামারশালা ছিল,তে মাথার মোড়ে। জলে সব ভেসে গিয়েছে। ওর ছোট ভাই, আর মা-বাবার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রশান্ত ততক্ষণে এসে পড়েছে। বলল, তুই ভাবিস না বোন, আমরা এখনই খোঁজ খবর লাগাচ্ছি।
নবীন বলল, ত্রিপল এসেছে। কিন্তু পাবলিক পায় নি।
প্রসন্ন বলল, কেন?
নবীন বলল, কালু, ভোম্বল ওরা সব নিজেদের বাড়ি নিয়ে গেছে।
কিন্তু সাধারণ মানুষ পায়নি কেন?
সব প্রশ্নের উত্তর হয় না, গুরু।
শোনা গেল, এখানকার জননেতা জল প্লাবিত অঞ্চল পরিদর্শনে আসছেন। পুলিশ প্রশাসন তৎপর হয়ে পড়ল। নতুন করে অস্থায়ী সেতু নির্মাণ হল। নেতা আসছেন। নতুন করে বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপন করা হলো।
নিয়তির মা অভুক্ত শিশুকে খেতে দিতে পারেননি, তাই কপাল চাপড়াচ্ছেন।
প্রশান্ত উঁচু ঢিপির উপর দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে চেয়েছিল। মানুষের এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা, এত অভাব ওর মন খারাপ করে দিয়েছিল।
ও ভাবছিল, প্রকৃতির মার এতো ঈশ্বরের মার, অসহায় মানুষ তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
নবীন বলল, গুরু, ওদিকটা মাঠের দিকে চেয়ে দ্যাখ্,
কি দেখবো?
চারদিকে এত জল থৈ থৈ। তারই মধ্যে পলাশ গাছটি কেমন আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
হ্যাঁ তাইতো!
কিছু বুঝলি?
কি বলতে চাইছিস?
বলতে চাইছি, ধ্বংস যদি সত্যি হয়, সৃষ্টি ও সত্যি। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।
প্রসন্ন বলল, আড়তদার হিমাংশু বিশ্বাসের বাড়ির চন্ডী মণ্ডপে আজ যুধিষ্ঠির মাঝি আসছেন।
তাই নাকি!
দেখছিস না, লোকে খেতে পারছে কিনা, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল, যুধিষ্ঠির মাঝি আসছেন।
বিকেলে হিমাংশু বিশ্বাসের চন্ডীমন্ডপে জনসভা হল।
যুধিষ্ঠির মাঝি বললেন, মাননীয় বন্ধুগণ, আপনাদের পাশে আছি। সাহায্য আসছে। সাহায্য পাঠানো হচ্ছে। আপনাদের জন্য ত্রিপল এসেছে।
জনতা চিৎকার করে উঠলো, আমরা পাইনি তো!
তাই নাকি! জানিনা তো!
দেখছি।
নতুন ব্রিজের উপর দিয়ে যুধিষ্ঠির মাঝি তার গাড়ির চাকায় কাদা জল ছিটিয়ে শহরে চলে গেলেন।
মালতীর বাবা ভাইকে খুঁজে পাওয়া গেল। মালতী সুস্থ হয়েছে। ও প্রশান্তকে বলল, দাদা, আমি তোমাদের সঙ্গে কাজে যোগ দেব। কে কি করবে মানুষের জন্য জানিনা। কিন্তু তোমাদের মত ভাল কাজে আমি মানুষের মাঝখানে থাকতে চাই।
পলাশপুর গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ দুঃশাসন সামন্ত বললেন, মানুষ যখন মানুষের পাশে আছে, তখন আর কোনো ভাবনা নেই। দেখছো না, নেতানো ফুল গাছগুলো আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
বাঁধের ওই দিক থেকে ছুটতে ছুটতে গগন এলো। ও প্রশান্তকে বলল, বস, জল নামছে। এবার আমরা মানুষকে আশ্রয় জায়গা ফিরিয়ে দিতে পারবো।
দুঃশাসন সামন্ত উঁচু ঢিপির উপর বসে বিড়ি টানছিলেন। বললেন, যার কেউ নেই, তার জন্য ঈশ্বর আছেন। তোমরাই গ্রামের অসহায় মানুষের কাছে ঈশ্বর।
প্রসন্ন বলল, লে হালুয়া! দাদু কি ডায়লগ দিচ্ছ। আমরা শালা যমের অরুচি।
দুঃশাসন সামন্ত বললেন, দুঃসময় না পড়লে, মানুষ চেনা যায় না। আমার চার কুড়ি বয়স হয়ে গেল। বেঁচে থেকে নিজের চোখে ধ্বংস দেখলাম, আর তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি দেখলাম। জীবনে বেঁচে থাকায় আমার কোনো আফসোস রইলো না।
নবীন ইয়ার্কি করে বলল, কি যে বলছো, গ্র্যান্ডফাদার!
দুঃশাসন সামন্ত বললেন, আমরা চলে যাবো, কিন্তু ভয় পাচ্ছি না, ভবিষ্যতে হাল ধরবার মতো তোমাদের তো রেখে যাচ্ছি।