অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
জল পড়ে।
জলের শব্দ হয়।
সবুজ সেই ঢিবঢাব শব্দের ভিতর মাথা গুঁজে শুয়ে থাকে। কিরণ তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সবুজ কখনই তার আসল নাম নয়। কেবল কিরণই তাকে এই নামে ডাকে। কিরণকেও সবুজই এই নাম দিয়েছে। বাইরের পৃথিবীতে তাকে কিরণ বলে জানে না কেউ।
আচ্ছা, এই সবুজ আর কিরণ, এরা কি সত্য নাকি কল্পনা? বাস্তব নাকি মিথ্যা? কখনও কি এদের নিজেদেরও সেই উপলব্ধি হয়? প্রশ্ন জাগে নিজেদের আস্তিত্বিক ব্যাপ্তির বিষয়? নাকি যুগ-যুগান্তের জঙ্গমতার রেশ মনে বইতে বইতে এরা ফুরিয়ে যায়? প্রবল বৃষ্টিতে রাত ফুরিয়ে যাচ্ছিল যেমন।
-“জল ঢুকছে, জানালাটা বন্ধ করে দিই এবার?” সবুজ জিজ্ঞেস করে।
-“থাক না,” কিরণ হাত বাড়িয়ে সবুজকে আবারও কাছে টেনে নেয়। বাইরে বাওড়ের জল উত্তাল হয়ে ওঠে।
জঙ্গমতা কেবল এক শব্দ নয়। যুগযুগান্ত ধরে মানুষ, মানুষেরই এই চলে আসার কথা, জঙ্গমতার কথা লিখেছে। এই জঙ্গমতাতেই সভ্যতার বিবর্তন। কিরণ সবুজের কাঁধে হাত রাখে। সারারাত বৃষ্টির পর দাওয়ায় চিকন রোদ। কিরণ সবুজের আঙুল হাতের ভিতরে নেয়।
-“যেতে হবে এবার,” দুখানি গভীর চোখ।
-“বৃষ্টি ধরেছে বোধহয়। তবুও সাবধানে,” সবুজ মাথা নামিয়ে নেয়।
-“আসবে তো ঠিক আবার?” প্রশ্ন তার।
জবাব আসে, “আসব তো!”
মনে মনে উচ্চারিত হয় “শপথ সাধিত হোক!”
কোথায় যেন সাইরেনের আওয়াজ শোনা যায়। দিগন্তে আবারও কালোর ছোপ। “মেঘ আসছে। এবারে যাই?” কিরণ জিজ্ঞেস করে। “খবরদার! যাই বলতে নেই, বলো আসি। এক্ষুণি!” তার হাত চেপে ধরে সবুজ ধমক দেয়। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কিরণ ছুটতে শুরু করে। বৃষ্টি শুরু হয়।
বুক সমান কাদাজল পেরিয়ে দলটা এগিয়ে যাচ্ছিল। পায়ের জুতোগুলো যেন আধমণ সমান ভারী হয়ে উঠেছে। তবুও তাদের জিরোবার উপায় নেই। যে করে হোক বিকেলের আগেই এই কাদাবন ছেড়ে বের হয়ে পড়তে হবে। রাত নেমে গেলে এই জল-জঙ্গলে থাকা অসম্ভব। কিরণের সবুজের কথা মনে হচ্ছিল। আর মনে হচ্ছিল এমন প্রত্যেক সংগ্রামেই বোধহয়, মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানুষ একে অপরের জন্য লড়াই করতে চায়। কিরণের মনে পড়ে স্পেনীয় ব্রিগেডের ইতিহাস। যদিও সেই আন্দালুসিয়-ভূমে এমন বর্ষার সংকট, জঙ্গলের উপদ্রব ছিল না বোধহয়। কেবল শীত ছিল। হয়তো বা জলেরও সংকট ছিল কোথাও। সবশেষে গুয়ের্নিকার সর্বধ্বংসী বিবরণ। কিরণের চোখ জ্বালা করে ওঠে হঠাৎ। দলের কমাণ্ডার ফিরে তাকান। “এগিয়ে চল ভাইসব, দিন ফুরিয়ে আসছে!” তিনি হুকুম দেন।
লোকগুলোকে দেখে সে স্তব্ধ হয়ে যায়। জঙ্গলের মধ্যে এক জনজাতি গ্রাম। এদেরই জন্য নাকি সংগ্রাম তাদের। কিন্তু আজ এতটুকুও সময় নেই। লোকগুলো তাদের পায়ে পড়ছিল। পাহাড় থেকে ঝর্ণা হয়ে নামতে নামতে, গ্রামের কূল ছুঁয়ে যাওয়া ছোট যে নদীটিকে তারা এতদিন বোনেরই মর্যাদায় ভালোবেসে এসেছে, শ্রাবণের পুষ্টি পেয়ে সেই রাক্ষুসীই আজ দুকূল ছাপাতে চায়! তিন থেকে চারজন লোক হলেও হয়ে যায় ওদের। গ্রামের অর্ধেক বাসিন্দাই জ্বরে-অপুষ্টিতে ধুঁকছে। কোদাল দিয়ে বাঁধ কাটবার মতো তেমন জোরদার মানুষ কই? ওরা তাই বিপ্লবীদেরই পথ আটকে দেয়। কিরণ অবাক হয়ে দেখে তাদের কমাণ্ডার কোনও ভাবেই আজ এখানে থামতে রাজি নন। ওঁর কাছে খবর রয়েছে কাছেই সরকারি সেনাদল অস্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে অবস্থান করছে। তাই কমাণ্ডার যত দ্রুত সম্ভব এই এলাকা ছেড়ে আরও গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়তে চান। কিরণ আর চুপ করে থাকতে পারে না। সে এক অদ্ভুৎ প্রস্তাব দিয়ে বসে হঠাৎ।
“আমরা সকলেই ভেবেছিলাম কিরণ বিশ্বাসঘাতকতার পথ বেছে নিয়েছে। অতীতে পুলিশি চর সন্দেহে এক গ্রামবাসীকে হত্যার বিরুদ্ধেও সে মতপ্রকাশ করেছিল। যদিও সেই লোকটির বিরুদ্ধে আমাদের হাতে যথেষ্টই তথ্যপ্রমাণ ছিল, তবু কিরণের আপত্তিতেই আমরা তাকে চরম শাস্তি দিতে পারিনি। তাই কিরণ যখন নিজে থেকেই সেই আদিবাসী গ্রামে রয়ে যাবার আবেদন জানাল আমাদেরও বুঝতে দেরী হয়নি, ও পালাতে চায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ও সরকারের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে চায়। তাই আমরাও আর বাধা দিইনি। কেবল মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকেও এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। শেষবারের জন্য হলেও ওকে মনে করিয়ে দিতে হবে, নতুন সমাজে বিশ্বাসঘাতকতার একমাত্র শাস্তি…” কমাণ্ডারের রোজনামচা থেকে আর কিছু উদ্ধারের উপায় নেই। খাতার বাকি অংশটুকু রক্তে-ময়লাতে ম্লান হয়ে গিয়ে অপাঠ্য হয়ে পড়েছে। সেই গ্রামেরই সন্নিকটে অবস্থান করা সরকারি সেনাদল রাত না কাটতেই অতর্কিত হামলা চালিয়েছিল বিপ্লবীদলের উপর। কেবল কিরণ বাদে তাই চলে যাওয়া বাকি সদস্যদের একজনও বাঁচেনি। অনেকদূর থেকে কিরণ সেদিন স্টেনগানের কড়া শব্দ শুনতে পেয়েছিল। ব্রাশফায়ারে গুলি চালানোর আওয়াজ। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তখন মাটি কোপাচ্ছিল কিরণ। সেই সময়ই সরকারি চর দুজন ওর পিছনে এসে দাঁড়ায়।
কেউ তার খবর জানে না।
আর তার খবর শোনেনি কেউ।
ক্রমে বৃষ্টি ধরে আসতে শুরু করে। ভরে ওঠা খালবিল। টলটলে জল বুকে নিয়ে এক অদ্ভুৎ শান্তির আমেজ স্নায়ু জুড়ে অনুভূত হয়। সবুজ জানালার দিকে চেয়ে থাকে। কেটে গিয়েছে প্রায় বছর দুই। ঘরের বাইরে থেকে তার বাবার গলার স্বর শোনা যায়। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। তদারকিতে তিনিই পাড়া মাথায় করে তোলেন। সবুজ আবারও বাইরের দিকে তাকায়। ঘন হয়ে মেঘ করে এসেছে।
দিগন্ত ফের গাঢ় হয়ে ওঠে।
সবুজ মনে মনে আবৃত্তি করে।
তার শরীর ও মন শিহরিয়ে ওঠে হঠাৎ।
-যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
-যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে
-বিষের টোপর নিয়ে।
-যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ পথ দিয়ে
-দিয়েছে পথ, গিয়ে।
-নিভন্ত এই চুল্লীতে বোন আগুন ফলেছে,
*নিভন্ত এই চুল্লীতে বোন আগুন ফলেছে…*
[কবি-পরিচিতিঃ শঙ্খ ঘোষ। প্রথম প্রকাশ – ১৯৫২, খাদ্য আন্দোলন]
…দক্ষিণী কমরেডদের অনেকেরই দেহ শেষ অবধি এমন মাটিতেই রাখা হয়ে থাকে। কাজেই, ঠিক এমনি ভাবে গ্রামের দু’চারখানি মহল্লা, করিডর, ছাওয়া যায় এমন – এবং পরবর্তীতে যা কিছু নিজেদেরই সামান্য ক্রিয়াকর্মের প্রয়োজনে, এমন সব গলি আর মহল্লাগুলিতেই দল গড়ে উঠতে শুরু করে। আলোচনা শুরু হয়। কিরণ তার্কিক নয় মোটেও। তবু সে কান পেতে শোনে। ফিজিতে, আফ্রিকাতে, দক্ষিণ আমেরিকায়। সেই সব স্বপ্নের মতো মনে হয়।
কে বা কারা কিরণের নাম রাষ্ট্রের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিল তার পরিচয় আজও জানা নেই কারোর। কেবল সবুজ আর সেই লোকটি পাশাপাশি শুয়েছিল। তাদের মাঝে রাখা ছিল অনেকগুলি বছর। সবুজ জানে কিরণের ধরা পড়ে যাওয়া, তার পাশে শুয়ে থাকা এই লোকটির কল্যাণেই। যদিও কিরণ খাতায়-কলমে নিখোঁজ। সরকারি কোনও সংশোধনাগার অথবা আদালতের নথিপত্রে আজ অবধি তার কোনও অস্তিত্ব নেই। সবুজের হাতে একখানি ছুরি উঠে আসে। বছরের পর বছর, মাসের পর মাস, কিভাবে সে কিরণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির অঙ্গীকার পালন করে এসেছে, তা কেবল তারই জানা আছে। সবুজের গর্ভে আজ অবধি সন্তানের সম্ভাবনা নেই। দূর-দূরান্তেও তেমন কোনও সম্ভাবনা দেখা যায় না আর। পাশে শুয়ে থাকা লোকটি রাগ করে, বিরক্ত হয়। শহরে নিয়ে গিয়ে সবুজকে সে বড় ডাক্তার দেখিয়ে আনতে চায়। কেবল সবুজের গভীর অসহায়তার অভিনয় বারে বারেই তার পৌরুষকে পরাজিত করে। সে সবুজকে বুঝে উঠতে পারে না। সবুজের প্রচণ্ড শারীরিক সেই ভালোবাসাটুকুর পিছনে যে নিছকই অভিনয়, নিছকই ঘৃণা, কেবলই অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যমিশ্রিত করুণারই যে উপাদান, সে ধরে উঠতে পারে না। মেরুদণ্ডহীন, ক্লীব এমন সব অদ্ভুৎ অস্তিত্বেরাই সমাজ অথবা রাষ্ট্রের গুপ্তচর হয়ে ওঠে। সবুজের ছুরিটা শূন্য থেকে ক্রমশ নিঃশব্দে নেমে আসতে চায়। অনেকগুলো বছর হারিয়েছে। বাইরে এখনও বৃষ্টির শব্দ। দাপট বাড়ছে তার।
শ্রাবণের বিপ্লব যখন বানভাসি হয়ে উঠে রাষ্ট্রের শেষ অস্তিত্বকেও অবশেষে পরাজিত, প্রতিরোধহীন করে তোলে, অরাজক এক পরিস্থিতি নেমে আসে রাজধানী শহরের উপর, ঠিক সেই মুহূর্তে কিরণও সেই অজ্ঞাত বন্দিশালার অন্ধকার থেকে আকস্মিক মুক্তির স্বাদ চেখে নিতে নিতে রাজপথে এসে দাঁড়ায়।
খোলা আকাশের মতো পথ চলে গিয়েছে। রাস্তায় কোনও মানুষ নেই। সকলেই শহরের কেন্দ্রের দিকে এগিয়েছে। কিরণ কেবল প্রান্তের অভিমুখে এগিয়ে যায়। এই যে রাস্তা, এর অন্তিমেই এক নদীঘাট রয়েছে। বিশাল সেই নদীঘাট, সবুজ আর কিরণেরও অনেক ভালোবাসার সাক্ষী। হয়তো বা অনেক শ্রাবণেরই দিন, বর্ষণমুখর শীতলতা।
সাধারণ বক্স-খাটের উপর সেই দুটি দেহ পাশাপাশি পড়ে থাকে। রক্তাক্ত, তবুও সুখ। মেয়েটির পেলব হাত জড়িয়ে থাকে পাশের সেই কুৎসিত অবয়বটাকে। জানালা বন্ধ নয়। বাইরে বৃষ্টির জল পড়ে। ঢিবঢাব শব্দ হয়। সবুজ সেই ঢিবঢাব শব্দের ভিতর মাথা গুঁজে শুয়ে থাকে। বাইরে থেকে কেউ কড়া নাড়ছে খুব।
কিরণ নদীর সুমুখে এসে দাঁড়ায়। বৃষ্টি পড়ছে। কেউ বা অববাহিকার আরও উপরে নদীবাঁধ খুলে দিয়েছে। জল আসছে তাই। কিরণের গায়ে-মুখে বৃষ্টির জল এসে লাগে। সে নদীবক্ষে নেমে যায়। আবারও শ্রাবণ। তার পা পিছলোতে থাকে। শানের উপরে শ্যাওলা খুব। সে পড়ে যাচ্ছে। অগাধ জলের সুখ। সমস্তই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিরণ আবৃত্তি করে,
-ফাটা গেলাসের শব্দে আমার মাতৃভূমি জন্মভূমি-নির্মীয়মাণ,
-যা-তোমার হাত থেকে খসে পড়ে তাই আমি সাগ্রহে ধরেছি
-শব্দময় মূর্ছায়, পতনে ও আত্মআবিষ্কারে পেতে আছি কান
-তোমাদের মাতৃভূমি-জন্মভূমি কী রকম – তার কিছু বর্ণনা দেবে…
[কাব্যঋণঃ শঙ্খ ঘোষ ও উৎপলকুমার বসু]