রাধা দীপ্যমান গোস্বামী
কবির সুমন এর কাছ থেকে ভাষা ধার নিয়ে উপরোক্ত শিরোনাম। ইদানিং যা খুব যথাযত প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে আমার। আমাদের চারপাশ থেকে ক্রমশ অবলুপ্ত হচ্ছে সবুজ রং। যেদিকে তাকাই শুধু বড় বড় নানান সাইজের বাক্সের মতো ফ্ল্যাট বাড়ির রাজত্ব। দিগন্তরেখায় শুধু অট্টালিকার হাতছানি। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজের প্রান্তর, বনানী, পুকুর, জলাশয়। পাড়ার ছোট্ট পার্কেও এখন ধূসর ধুলো। কোথায় যেন পড়লাম পৃথিবীর ফুসফুস যাকে বলা হয় সেই আম্যাজন অরণ্য সাফ হয়ে যাচ্ছে মানুষ্য প্রজাতির সভ্যতা গড়ে উঠবে বলে। কোন সভ্যতার পথে আমরা চলেছি সে তো সময় বলবে তবে যার সূচনা বোধহয় শুরু হয়ে গেছে। যেটা বলছিলাম, পাখির কলতান এ আর ঘুম ভাঙে না এখন, শহরতলি থেকে প্রজাপতি হারিয়ে যেতে বসেছে। ওই সব ফ্ল্যাট বাড়ির জানলা থেকে কতটুকুই বা আকাশ দেখা যায়, শুধু কংক্রিটের দেওয়াল, গ্রিল জানালা, বারান্দায় ভাঙাচোরা মুখ। গগনে গগনে কখন যে দেয়া ডাক দেয় তা মাঝে মধ্যে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায় বৈকি তবে সেই উতল বারিধারার ঝাপ্টা এসে লাগে কাঁচের জানলার ফ্রেমে, একচিলতে বারান্দায়। এখন আর সেই মা-পিসিমাদের বৃষ্টি এলে ছাদ থেকে জামা-কাপড় তোলার হুড়োহুড়ি নেই, আঁচারের বয়াম তোলার ঝক্কি নেই, নববারিধারায় কোনো আনমনা কিশোরীর স্নান করার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশে সারি সারি সাদা বকের ঘরে ফেরার গান শোনা যায় না আর শহুরে জীবনে, এই সদা ব্যস্ত জীবনে কেউ খোঁজ রাখেকি আর ময়নাপাড়ার সেই মেয়েটির, কালো হরিণ চোখ-কৃষ্ণকলি যার নাম।
শহর ছেড়ে গ্রাম-গঞ্জের দিকে পা বাড়ালে ছবিটা হয়তো একটু অন্যরকম। সেখানে এখনো সবুজের সমারোহ আছে কিঞ্চিৎ। সেখানে এখনো কত রকমের সবুজ রং পেরিয়ে ধেয়ে আসে বারিধারা। কোনো বড় দীঘি বা বিস্তৃত মাঠের এক পারে দাঁড়ালে দেখা যায় ওই সুদূরে বৃষ্টি নেমেছে এগিয়ে আসছে মেঘমন্দ্রিত ছন্দে পিপাসার্ত ধরিনীকে সিক্ত করবে বলে। আর আকুল ধরণীও ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জলে স্নিগ্ধ হয়ে, ঋদ্ধ হয়ে ছড়িয়ে দেয় তার মিলনসুখের উচ্ছাস সোঁদা সোঁদা গন্ধে-সুবাসে।
বর্ষা এলে তাই আমাদের হৃদয়-মনেও দেয় দোলা, আমরা শিহরিত হই, আবেগে পরিপূর্ণ হই, সমস্ত চঞ্চলতা যেন নেচে ওঠে ময়ূরের মতো পেখম তুলে। পৃথিবীর সমস্ত কাব্য লিখিয়েরা তাই হয়তো বর্ষা কে আপন করেছেন নিজেদের মতো করে, নানান উপমায় ভূষিত করেছেন, উজাড় করে দিয়েছেন তাদের ভাষার ডালি তাদের প্রিয় ঋতুর জন্য। এমনি এক মেঘলা দিনে কবিগুরু লিখেছিলেন "আমার চিরদিনের সেই আর-একজনটি কোথায়, যে আমার হৃদয়ের শ্রাবণমেঘকে ফতুর করে তার সকল বৃষ্টি কেড়ে নেবে"। মেঘের পরে মেঘ জমলে কত ভিতর মহল না জানি বানভাসি হয় প্রিয় মানুষটি কে পাবার তীব্র আকাঙ্খ্যায়, নিজস্ব ব্যাকুলতায়। কত সহস্র কোটি প্রেমপত্র হয়তো লেখা হয়েছে বারিধারায় ভিজে সেই মনের মানুষটির জন্য আর মেঘপিওনদের কাঁধে দায়িত্ব বর্তেছে সেসব পেটমোটা খাম সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দেবার, আসলে সত্যি সত্যি "এমন দিনে তারে বলা যায়" মনের সমস্ত কিছু উজাড় করে।
প্রেমের বায়োসন্ধিকালে রোমাঞ্চ ছিল বৃষ্টি ভেজা দুপুরে প্রেমিকার হাতে হাত রেখে দিকশূণ্যপুর এর দিকে হেঁটে যাওয়ায়। যখন দূরে তখন প্রেমিকার জন্য সাড়ে-ষোলো পাতার চিঠি আর সাথে একখণ্ড মেঘ, যার প্রতিটি ফোঁটায় যেন তার একলা অধিকার। এইরকমই এক মন খারাপ করা বিকেল বেলায় লিখেছিলাম -
তুমি আমার হাতের পাতায় ঘুমোও দুপুর বেলা
আর অমনি মেঘ এসে -
এক পাড়াকে ভেজায় আর অন্য পাড়াকে
অপেক্ষায় রাখে শুধু,
তোমার মধ্যে ছিল অদ্ভুত এক ব্যাকুলতা।
মেঘ ও তাই রাজসাক্ষী দিতে রাজি
আমার চরিত্র ধুয়ে গেল মেঘের জলে...
শৈশবের আরেকটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। তখন হয়তো ক্লাস ফাইভ-সিক্স হবে। মাঝরাত থেকে আকাশ উপুড় করেছে তার ডালি, অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে অবিরত। ওয়াটারপ্রুফ পরে স্কুল গেছি, অধিকাংশই ভিজে সপসপে। খবর এলো, প্রতি ক্লাস এ গোনা হচ্ছে ক'জন ভিজেছে। তার ওপর ভিত্তি করে রেনি-ডে ঘোষণা করা হবে। আমাদের ক্লাস এর তখন ও যারা না-ভেজা বা আংশিক ভেজার দলে ছিল, তাদের উপর বর্ষিত হলো ক্লাস এর সমস্ত ওয়াটার বটল। গোটা ক্লাস রুম তখন বানভাসি, জলে থৈথৈ। গুণে দেখা গেলো এই ক্লাস এর একজনও না-ভেজার দলে নেই। যখন রেনি-ডে ঘোষণা হলো, আমরা নিজেদের বুদ্ধিমত্তার তারিফ না করে পারিনি। এই মরসুমে আমার মেয়ে একদিন এসে বললো তাদের ক্লাস এ সবাই প্রায় ভিজে গেছিলো আজকে, তবু রেনি-ডে দেয়নি। আমার তৎক্ষণাৎ মনে হলো এদের ক্লাস এর ওয়াটার বটল গুলো কি বাইরে থাকে? স্কুল সিলেবাস থেকে বোধহয় রেনি-ডে ও অবলুপ্তির পথে।
এরকম ঝড়-জলের দিনের অভিজ্ঞতা সকলের জীবনেই কম বেশি আছে। বৃষ্টি যেমন সমৃদ্ধ করে, তেমনি প্রকৃতির নির্মম পরিহাস বানভাসি করে অনেক কিছুই, যেমন দেশের নানা প্রান্তে ইদানিং হড়পা বানে সবকিছু ভেসে যাওয়ার খবর এখন প্রতি বর্ষায় নিয়মিত হেডলাইন হয়ে গেছে। সমস্ত ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ নিয়েই তবু বর্ষা আমাদের কাছে হাজির হয়। আমাদের অনেকের প্রিয় ঋতু সে। সে প্রেমের, সে মিলনের। পরিশেষে তাই সেই মনের মানুষটিকেই বলি :
"যেতে দাও যেতে দাও গেল যারা।
তুমি যেয়ো না, তুমি যেয়ো না,
আমার বাদলের গান হয়নি সারা।"
Tags:
প্রবন্ধ