দোঁহা

দীপাবলী উৎসব ও কালীপুজো: উদযাপনের আঙ্গিকে

 


অত্রি মল্লিক

ভারতবর্ষের পার্বণ যজ্ঞের ইতিবৃত্তে খুব সাধারণভাবে বুঝতে হলে দীপাবলী‌ অথবা দেওয়ালি হল হেমন্তকালে পালিত একটি উৎসব যাপন যেখানে আলো হলো‌ উদযাপনের বৃহত্তম মাধ্যম। সেই উদযাপনে ধর্মাচরণ, পুজো-অর্চনা, উপবাস, উপহার বিনিময়, ভোগ-প্রসাদ বিতরণ ও নানান আঙ্গিক যেন ওতোপ্রোতভাবে সংযুক্ত হয়ে যায়। প্রত্যেক বছর আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ধনত্রয়োদশী যা আদতে ধনতেরাস নামে বহুল কথিত, সেই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপাবলী উৎসবের শুভ সূচনা হয়। আর কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে মোটামুটিভাবে এই উৎসবের পরিসমাপ্তি হয়। দীপাবলি শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রদীপের সমষ্টি। এই দিন মূলত ভারতীয় হিন্দু পরিবারে স্বগৃহে মাটির প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে আলোর সূচনা ও শুভ শক্তির আবাহন করা হয়। এই প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা অমঙ্গল বিতাড়নের সাংকেতিক সূচী হিসাবেই গণ্য হয়।

সমগ্র বিশ্বের কোণায় কোণায় সম্প্রদায় ও ধর্মীয় বিশ্বাসের বেড়াজাল অতিক্রম করে এখন এই দীপাবলী উৎসব পালন হলেও ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এই দীপাবলী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক উৎসব। ভারতবর্ষের অনেক প্রদেশেই এই দিনে লক্ষ্মী পুজো করা হয়ে থাকে ঘরোয়া পরিসরে।‌ মিষ্টি ও অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ হলো অন্যতম আবশ্যক পালনবস্তু। এই দেশের অনেক প্রান্তেই নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় যাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা-তে এই দিনটি কালীপূজা হিসেবেও উদযাপন করা হয়। সমাজ ব্যবস্থার সুদৃঢ় বিশ্বাস দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন অথবা ন্যায়ের কাছে অন্যায়ের পরাজয় এই বিশ্বাসে পুষ্ট‌ হয়ে এমন সব আয়োজন হয়ে থাকে।
নিজের বাড়িঘরের আবর্জনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাতব্যাপী প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলে ঘরে লক্ষ্মীর আনয়ন হয় এমনটাই ধারণা উত্তর ভারতীয়দের। ঠিক এই সময়েই পশ্চিমবঙ্গে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপুজো সাড়ম্বরে পালিত হয়। আলোকসজ্জা ও আলোর রোশনাই সহকারে পূজিত হন‌ মাতৃশক্তি।

আরও একটি‌ বিষয় হলো ভূত চতুর্দশী । এই দিনে বাঙালি সমাজে বাড়ির অন্তত চোদ্দোটা কোণায় চোদ্দোটা প্রদীপ জ্বালিয়ে অন্ধকার ঘুচিয়ে আলোময় করে তোলেন নিজেদের বাসস্থান, কখনো আবার কর্মস্থলকে। কথায় আছে যে এমনটা করলে ভূতপ্রেত পরিবার আর স্বজনদের ঘাড়ের কাছে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেনা। এমনও লোকমুখে শোনা যায় যে এই প্রদীপসজ্জার মাধ্যমেই পরিবারের পিতৃপুরুষদের অনুষ্ঠানে পদার্পণ করার জন্য নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়, যাতে তারা মায়ের বাৎসরিক আগমনে উপস্থিত হয়ে সবাইকে শুভাশীষ দিয়ে নিজেরা মায়ের আশীর্বাদে মোক্ষ বা পরিত্রাণ লাভ করবেন। কার্তিক অমাবস্যায় যেখানে উত্তর ভারতে লক্ষ্মীর পূজা চলছে, পশ্চিমবঙ্গে দারুণ জাঁকজমক ও ঘটা করে পালন করা হয় কালীপূজা।

দীপাবলীতে হরেক রঙের শব্দবাজিতে আকাশটাও রীতিমত ঝকমক করতে থাকে। এই দীপাবলী প্রদীপের আলোতে স্বর্গস্থিত দেবতাকে মর্তের কুটিরে বরণ করে নেওয়ার উৎসব। কার্তিক শুক্লা প্রতিপদের দিন বৈষ্ণবেরা গোবর্ধন পুজো করেন। যমদ্বিতীয়া বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা আরও সহজে ভাইফোঁটা পালিত হয় তারও একদিন পরে। এই দিন বোনেরা তাদের ভাই বা দাদাদের কপালে তিলক এঁকে মঙ্গল প্রার্থী হন।
এই দীপাবলী পালনের ক্ষেত্রে এমনটা বিশ্বাস করা হয় ১৪ বছর বনবাসে কাটানোর পর অযোধ্যায় ফিরেছিলেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র৷ তাই রামচন্দ্রের পথ আলোকিত করতেই অমাবস্যার রাত সেজে উঠেছিল আলোর ঝলকানিতে৷ এই দিন সুখ-সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে মেনে চলা হয়। জৈন মতে আনুমানিক ৫২৭ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে মহাবীর দীপাবলীর দিনেই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করেছিলেন। ১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ ও ৫২ জন রাজপুত্র দীপাবলীর দিনেই মুক্তি পেয়েছিলেন বলে শিখরাও এই উত্‍সব পালন করেন। আর্য সমাজ এই দিনে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুদিন পালন করে।
যদিও বাংলায় পালিত এই কালীপুজোর প্রচলন কিন্তু নিদারুণ প্রাচীন নয়। জানা যায় ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে কাশীনাথ রচিত হয় শ্যামাসপর্যা বিধিগ্রন্থে এবং সেখানেই এই পুজোর সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আছে, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে তাঁর সকল প্রজাকে শাস্তির ভীতিপ্রদর্শন করে কালীপুজো করতে বাধ্য করেন। আর সেই থেকে নদিয়ায় ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্রও কালীপুজোর আয়োজন করতেন। 

এভাবেই সার্বিক উদযাপনের সঙ্গে বিশ্বাস পালন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে ভারতের আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য প্রদানে দীপাবলী ও কালীপুজো অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে নিরন্তর।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন