দোঁহা

অগ্রিম দেবী কালীকা আগমন

 

মালবিকা মিত্র

জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী 
দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোস্তুতে, 
ওঁ ক্রীং কালিকয়ে নমো নমঃ। 
গায়ত্রীːওঁ কালিকায়ৈ বিদ্মহে শ্মশানবাসিন্যৈ ধীমহি। 
তন্নো ঘোরে প্রচোদয়াৎ ওঁ।

দেবী ভাগবতপুরাণ অনুযায়ী কালীই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। তিনিই আদি অন্ত। ঋগ্বেদে উল্লেখ করা আছে আদি পরাশক্তি তথা কালীই পরমব্রহ্ম। তিনি শক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ এবং সমস্ত জীবের জননী। সেই জননী তার গর্ভের লজ্জা, কু সন্তানকে শাস্তি দিতে, নির্দোষকে রক্ষা করার জন্য, তিনি মন্দকে ধ্বংস করেন। তিনিই দেবী মা, মহাবিশ্বের মা, আদিশক্তি বা পার্বতী হিসাবে পূজিত হন। ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ তমসায় বরাভয় দিতে, শাশ্বত শুভকে রক্ষা করতে মা আদিশক্তি তিথি লগ্ন ব্যতিরেকেই আজ সমুপস্থিত। এই পূণ্য ভারতভূমিতে আজ প্রতি দিন শত শত সন্তান যৌন লাঞ্ছনা ও ধর্ষণের শিকার। তিমিরবিদারি বরাভয়দাত্রীর তাই অগ্রেই আগমন। 
 
প্রায় এক বছর আগে থেকে এক মৃত সন্তানের স্মৃতি বুকে চেপে ধরে সন্তানহারা জননী এখনো অন্ধকারে লুকিয়ে কাঁদে। একাকী সন্তানের সাথে কথা বলে। সহসা ১৪ই আগস্ট ২০২৪ বুঝি কি হলো! হঠাৎই মা দেখে যাদবপুর সহ সারা কলকাতা শহরতলিতে জেলায় জেলায় রাজ্যে রাজ্যে ভয় শঙ্কা দূরে ঠেলে মাঝরাতে মানুষ বুঝি জেগে উঠেছে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস গর্জনে। সন্তানহারা মা আশ্বাস পায়, এতদিনে বুঝি জাস্টিসের সময় এসেছে। মাঝরাতে তার বুকে মুখ রেখে ঘুমিয়ে থাকা সন্তান স্বপ্নদীপ কে জাগিয়ে তোলে, আশার আলো দেখতে পায়। জাস্টিসের আশায় নতুন করে বুক বাঁধে-

বাবা ওঠ, সোনা আমার। ওঠ, চোখ মেলে তাকিয়ে দেখ, কত মানুষ, কতো দীপালোক আশার আলো জ্বেলেছে। সবাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে। দেখ বাবা, চোখ খোল, ঘুমিয়ে থাকিস না। 

-মাগো, তুমি অমন করে কেবলই আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ো না। আমাকে ডেকো না, আমি চির ঘুমের মধ্যেই থাকতে চাই। মোবাইল ফোনের আলোক বিন্দু চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। জাস্টিস জাস্টিস গর্জন বুকে কাঁপুনি ধরায়। তার চাইতে অনেক বেশি ভালো ঘুমের দেশ, মেঘের কোলে জ্যোছনা, শান্ত নীরবতা। ওরা কারা কেন বেরিয়েছে? 

অত্যাচার - পীড়ন - ধর্ষণ - খুন - আত্মহত্যা এসবের বিরুদ্ধে, মানুষের নিরাপত্তার জন্য ওরা বেরিয়েছে বাবা। 

-মাগো, ওরা এত দেরিতে, এতদিন পরে কেন? ওরা যদি আরও আগে এই ভাবে পথে নামতো, তবে তো ডাক্তার দিদি টাকে মরতে হতো না। এমন নৃশংস অত্যাচার হতো না ওর উপর। এত দেরিতে নামলো কেন? আচ্ছা মা, র‍্যাগিং কি অত্যাচার পীড়ন নয়?  যদি আরো আগে সমস্ত মানুষ পথে নামতো, তাহলে তো আমাকেও হয়তো ওভাবে মরতে হতো না। এত দেরি করল কেন? সেদিন উল্টে সবাই আমাকেই দোষ দিল। "পুরুষ মানুষের এত কম সহ্যশক্তি হলে চলে। একটু ধৈর্য ধরলেই ঠিক হয়ে যেত সব।" কতজনের কত কথা। "ভর্তি হবার পর প্রথম প্রথম দু চার দিন আমাদেরও একটু উপদ্রব সহ্য করতে হয়েছে।" কেউ আমার কষ্টটা বুঝতে চায়নি। সবার সহ্যশক্তি, আত্ম সম্মান বোধ একরকম না হতেই পারে। সেটা তো আমার ত্রুটি নয়। যখন রাত্রে সেদিন বাড়িতে ফোন করেছিলাম, তোমরাও মানতে চাও নি। কেন মা? 

দেখ বাবা, ওই সুদূর নদীয়ার বগুলা থেকে সেই রাতেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, পৌঁছনো সহজ ছিল না। তাই ভেবেছিলাম সকাল হতে না হতেই যাদবপুরে পৌঁছে যাবো। এখন ভাবি ওই রাতেই যেভাবেই হোক আমাদের চলে আসা উচিত ছিল। 

-কিন্তু রাতেই সব শেষ হয়ে যাবে বুঝতে পারোনি। আসলে তোমরা বুঝতে চাওনি। তাইনা? 

বাবা তোর এখনো এই দুঃখটা যায়নি জানি, তাই না? যাবার কথাও না। হয়তো সেই রাতে আমরা পৌঁছে গেলে তোর প্রাণ রক্ষা পেত। এই আফশোস আমাদের কোনদিন যাবে না। সারাজীবন দগ্ধ হবো। 

-কিন্তু মা শুনতে পাচ্ছি এই দিদিটার বাড়িতে তিনবার ফোন গিয়েছিল। প্রথমবারের ফোন ছিল "আপনাদের মেয়ে অসুস্থ (অজ্ঞান) হয়ে গেছে"। ওই ফোনটা পেয়েই ওর মা বাবা কেন গেল না? ওর মা বাবা তো অনেক দূরে থাকে না। নাটাগর থেকে আরজি কর মাত্র ১৭ কিলোমিটার। নিজেদের চার চাকার গাড়ি আছে, ড্রাইভার আছে। গাড়িটাও বাড়িতে ছিল। তবুও কেন গেল না ওরা? আসলে মা তোমরা ছেলেমেয়েদের ভালোবাসো। তাদের ভালো চাও। কিন্তু কখনোই তাদের বুঝতে চাওনি, বুঝতে চাও না। তোমাদের চোখে তাদের উন্নতি, সমৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠা, এটাই প্রধান। 

না বাবা, অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়, সন্তানকে মা বাবা এসব মানদন্ডে কখনোই পরিমাপ করে না। এটা তোর ভুল ভাবনা। 

-ভুল ভাবনা বোলো না মা। তুমি না ভাবলেও সমাজ একজনকে এই মাপকাঠি দিয়েই পরিমাপ করে। জানো তো টলিউড পাড়ার এক অভিনেত্রী সেদিন টিভিতে বলছিল, "বিলো দ্যা পভার্টি লাইনের সমস্যা গুলো আমাদের সোসাইটিতে ঢুকে পড়েছে, প্রতিবাদ তো করতেই হবে।" কথাটা শুনে বুঝেছিলাম ঝুপড়ি বাসী, রেল প্ল্যাটফর্ম বাসী বা ফুটপাত বাসী ধর্ষিতা হলে এই প্রতিবাদীদের চোখে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ধর্ষণ এসে ঢুকে পড়েছে ডাক্তার অধ্যাপক আইনজীবী সেলিব্রিটির আঙিনায়। তাই সমাজের গেল গেল রব। একজন নার্স ধর্ষিতা হলেই, এত হইচই শোরগোল দেখতে পেতে না। জানো মা, এই দিদিটা যদি কলেজ ছাত্রী হত, এত প্রতিবাদ দেখতে পেতে না। যেমন দেখেছি কামদুনি তে। পিজি ট্রেনি ডাক্তার তো, তাই এত সোচ্চার প্রতিবাদ। তোমার ছেলে যদি ইঞ্জিনিয়ার হত, ডাক্তার হত, তাহলে একটা আখ্যান নির্মাণ করা যেত। কিন্তু আমি ছিলাম নেহাতই গ্রাম্য পরিবেশের থেকে আসা আন্ডার গ্রাজুয়েট ছাত্র, তাও আবার বাংলা ফাংলা বিভাগের ছাত্র। 

আর বলিস না বাবা। এই যন্ত্রণা নিয়ে তো আমি সারা জীবন কাটাবো। কেন আমি সেদিন রাতে বুঝিনি, বুঝতে পারিনি। মানুষও সেদিন অনেকেই বোঝেনি, আজ তো তবু বুঝছে। দেখছিস না নিরাপত্তার জন্য ৯ হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে হাসপাতাল গুলোতে। 

-শোনো মা, আরজি করে দিদিটা মারা যাওয়ার পর নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি লাগানোর দাবি হচ্ছে। আর আমার কলেজে যাদবপুরে প্রাইভেসি, "ব্যক্তির নিজস্ব পরিসর" নষ্ট হবে, এই যুক্তিতে সিসিটিভি বসাতে দেওয়া হয়নি আজও। অথচ ওই ব্যক্তিগত পরিসরের মধ্যেই কিন্তু আমার নিরাপত্তা বিনষ্ট হয়েছে। আমি মারা গেছি। নিরাপত্তা নাকি প্রাইভেসি, কোনটা প্রধান দাবি? দুটোই ফালতু যুক্তির অবতারণা। 

জানিস বাবা দিদিটার সাথে নাকি খুব শারীরিক অত্যাচার যৌন নির্যাতন হয়েছিল। তারপর তাকে খুন করা হয়েছে। মেয়ে জন্ম তো, তাই খুনের সাথে ধর্ষণ উপরি পাওনা।
 
-মাআ...মাআ, তুমি সবার মত একই ছকবদ্ধ হয়ো না। আমার সাথে যা হয়েছে সেটা কি ধর্ষণের চেয়ে কম কিছু? আমাকে নগ্ন করে, আমাকে দিয়ে যা যা করানো হয়েছে, আমাকে যা যা বলানো হয়েছে, এও তো ধর্ষণ। ধর্ষণ কে কেবল একমাত্রিক ভাবে দেখো না। এটা ঠিক, ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে একে ধর্ষণ বলে কখনো মান্যতা দেওয়া হবে না। কিন্তু একবার ভাবো, সিনিয়র দিদি ও দাদাদের উপস্থিতিতে আমাকে দিয়ে যৌন আচরণ ও কথাবার্তা বলতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমার জন্ম রহস্য উন্মোচন করে, বীজ রোপনের দিন (প্রতিষ্ঠা দিবস) নির্দিষ্ট করা হচ্ছে। এও কি ধর্ষণ নয়? কারো চোখে এটা ধর্ষণ বা যৌন পীড়নের স্বীকৃতি পায় না। বরং এক ঘর লোকের সামনে সেটা হাসির খোরাক হয়, বিনোদন হয়। এমনকি একজন ধর্ষিতার ছবি প্রকাশ, নাম প্রকাশে, যে আইনের বিধি নিষেধ আছে, আমার ক্ষেত্রে সেই মর্যাদাটুকুও প্রদর্শন হয়নি। আমি যে পুরুষ। যেন পুরুষ হলে তার আত্ম মর্যাদা থাকতে নেই। জানো মা কতো মানুষ নাকি আমার ছবি দেখে মন্তব্য করেছে, এ ছেলে তো ছাত্রদের সফট টার্গেট হবেই, চেহারায় পুরুষালি ভাবটাই নেই। তাই শুনলাম "জননী" সিনেমার মৃত ছাত্রের চরিত্রে একটা শক্তপোক্ত ম্যানলি চেহারার অভিনেতা নেওয়া হয়েছে। মাগো, মৃত্যুর পরেও এই অসম্মান, অসহ্য। 

জানিস বাবা, এখানে আর জি করে অনেক বিরাট দুর্নীতির চক্র প্রকাশ পাচ্ছে। ড্রাগ, মাদকদ্রব্য, নিষিদ্ধ ভিডিও তৈরি, কত কি! একটা বড় চক্র এসব পরিচালনা করে। তার ভেতরে ডাক্তার হাউস স্টাফ ইন্টার্নরাও নাকি কেউ কেউ যুক্ত। 

-মাগো, যাদবপুরেও হোস্টেলে, ইউনিভার্সিটিতে আনাচে-কানাচে মাদক ও নেশার সামগ্রীর রমরমা কারবার, সেদিনও ছিল এখনো আছে। সেসব তো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। যাদবপুরেও বহুদিনের পুরনো পাস আউট ছেলে মেয়েরা এখনো হোস্টেল দখল করে, সেখানে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে  আরজি করের সঞ্জয় রায়ের মতো। চক্রের কথাই যদি বল, সেখানেও তো দুষ্টচক্র কম সক্রিয় ছিল না। কিন্তু কে আর তদন্ত চাইল, সত্য উদঘাটন করলো বলো? সবই একটা হাওয়া, তখন হাওয়া ওঠেনি। এখন হাওয়া উঠল, অথবা ওঠানো হলো। 

বাবা, বাছা আমার। দেরিতে হলেও তো  মানুষ এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন হচ্ছে। সরব মুখর হচ্ছে। এটুকুই তো আশার কথা। আমার সোনা ছেলেটার সময়ে যা হয়নি, আজ সেটা দেখে, আমি আর এক  সন্তানহারা মায়ের কথা ভেবে একটু ভরসা পাবো, আশ্বস্ত হবো, এটাই কি স্বাভাবিক না? তোর এই দিদিটা যদি সুবিচার পায়, তবেই তো তোর মুখেও হাসি ফুটবে, তাই না? 

-মাগো, তুমি বড়ই সহজ সরল ভাবে ভাবো। এখনো ডাক্তার দিদিটা সুবিচার পাবে ভাবছো?  তুমিও জানোনা, আমিও জানিনা। কিন্তু আমি এটা জেনেছি যে, যখন কোন ঘটনা ঘটে, সেই ঘটনাকে খন্ডিত করে, টুকরো করে, তার একটা অংশ নিয়ে যেকোনো একটা আখ্যান নির্মাণ করতে হবে। যদি সেই কাম্য আখ্যান বা ন্যারেটিভ তৈরি না করা যায়, তবে সেই ঘটনা মূল্যহীন। ফ্র্যাকচার্ড ফ্যাক্ট ...ম্যানুফ্যাকচার্ড ন্যারেটিভ। 

আমি তোর এত কঠিন কঠিন কথা বুঝতে পারি না বাবু। তুইতো কত সহজ করে বুঝিয়ে কথা বলতি বাবা। আমাকে একটু সহজ করে বুঝিয়ে বল তোর কষ্ট। 

-ধরো আমার হোস্টেলে আমার ওপর যে নির্যাতন হয়েছিল, আমি বলবো ধর্ষণ হয়েছিল ও পরিণতিতে মৃত্যু, সেই ধর্ষণকে তুমি কোন চেনা ছকে ফেলতে পারবে কি? মানে পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য বলতে পারবেনা, কারন আমিও পুরুষ। বলতে পারবে না সরকারি অবহেলা। কারণ এখানে সরাসরি ছাত্ররা যুক্ত ছিল। সরকার না। আমি খুবই সাদামাটা গ্রামের ছেলে, ডিগ্রী কোর্সে বাংলার ছাত্র। এরকম ছাত্র বা এর চেয়ে ঢের বেশি ভালো ভালো ছাত্র প্রায়ই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কোটায়, আত্মহত্যা করে, মারা যায়। মিডিওকার মাঝারি নিম্নমানের মেধা নিয়ে আখ্যান তৈরি হয় না। পুরুষ হলে তো কথাই নেই। কিন্তু ডাক্তার দিদির ধর্ষণ টাকে এবং হত্যাটাকে পুরুষতন্ত্র নারীবাদের ফ্রেমে ফেলে পরিমাপ করা যায়। আখ্যান রচনা করা যায়। আবার ডাক্তার দিদির মৃত্যুকে সরকারের উদাসীনতা বলা যাবে। কারণ ওটা সরকারি হাসপাতাল। পুলিশের গাফিলতি, এমন নানা খোপে ফ্রেমবন্দি করা যায় এবং ভিন্ন ভিন্ন আখ্যান বা ন্যারেটিভ তৈরি করা যায়। এমনকি উঁচু তলার মানুষের ঘরেও ধর্ষণ ঢুকে পড়েছে, এমন একটা আতঙ্ক তৈরি করা। ফলে এটা নিয়ে চারদিকে শোরগোল তৈরি হয়। যাকে বলতে পারো নানারকম আকৃতি দেওয়া যায়। ফলে প্রতিদিন কতনা আকৃতি দেওয়া চলছে আরজি কর কান্ড নিয়ে। এটাকে তুমি মানুষের সচেতন প্রয়াস বলতে পারো না। যে যেভাবে এক একটা আখ্যান নির্মাণ করছে, সেভাবেই মানুষকে নাচাচ্ছে। তোমার দুর্ভাগ্য, আমার দুর্ভাগ্য, যে আমার ওপর অত্যাচার পীড়ন এবং মৃত্যু নিয়ে, এমন ভিন্ন ভিন্ন আখ্যান রচনা, কোন নির্দিষ্ট মতবাদ বা তন্ত্রে সাজানো যায় না, মুখ্যমন্ত্রী বা পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করা যায় না। ফলে তোমার নীরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া অন্য কোন গতি নেই। জানো মা, রাজপথে যত মানুষকে দেখছ, আর জি কর ধর্ষণ ও খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার, তাদের ভেতরেই তো মিশে আছে আমার ধর্ষক ও খুনী। বল দেখি, পিতা মাতার ব্যক্তিগত জীবন ও যৌন জীবন নিয়ে সন্তানকে প্রশ্ন করাটা ধর্ষণ নয়? আজ যারা পথে মুখর, তাদের অনেকেই তো কথায় কথায় তেরি বহিনকো...তেরি মাইকো...বলে গালাগালি করে থাকে। এদের কোলাহল শুনতে আমার আর ভালো লাগেনা। এদের কন্ঠে "উই ওয়ান্ট জাস্টিস" শুনলে আমার বমি আসে। একটু ঘুমোতে দেবে মা। আমার চোখ বুঝে আসছে, এই কোলাহল আমি চাইনা, এ কোলাহল শ্মশান শবের ছাইয়ের গাদায় মাতালদের আনন্দ উৎসব। 

আমি তবু বলব আমি যে সুবিচার পাইনি মানুষের কাছ থেকে আমার সন্তান হারানোর দিন যাদের মধ্যে ছিল হিরণ্য নীরবতা, সেটা আজ মুছে গেছে। অন্তত কিছু মানুষ দিকে দিকে বিচারের দাবি করছে অন্যায় পীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলছে। 

-আমার কি মনে হয় জানো মা? এই মানব সভ্যতার গোড়ায় আছে এক ধরনের পীড়ন বঞ্চনার বীজ। র‍্যাগিং হলো স্যাডিস্টিক প্লেজার, মনোবিজ্ঞান বলে, ধর্ষণও একটা স্যাডিস্টিক প্লেজার, একই গোত্র ভুক্ত। অপরের মুখ মলিন করেই নিজের তৃপ্তি। বিবাহে কন্যাপক্ষ প্রস্তুত থাকে বরযাত্রীদের কিভাবে হয়রান করা যায়। পাল্টা বরপক্ষ তৈরি থাকে কনেযাত্রীদের ওপর প্রতিশোধ নেবার আকাঙ্ক্ষায়। বাচ্চা শিশুকে বলা হয়, এটা তোর মা নয়...তুই তো আসলে কুড়িয়ে পাওয়া...তোর মা তোর ভাইকে বেশি ভালোবাসে...এমন শব্দবন্ধ দিয়ে কাঁদিয়েই আনন্দ পায়। শিক্ষক ছাত্রের বিচিত্র নামকরণ করে। গোটা ক্লাস সেই নামে বন্ধুকে খ্যাপায়...স্কুলে কলেজে নবাগতদের আনুষ্ঠানিক বরণ করা হলেও, আসলে তাদের জন্য প্রতীক্ষা করে এক অবর্ণনীয় ভয়াবহ অত্যাচারের দুঃস্বপ্ন। অর্থাৎ এ সভ্যতার গোড়ায় আছে বিদ্বেষ। তাই বলছি কোন প্রতিবাদ নয়, কোন আবেগ নয়, কোন জাস্টিস নয়। আসলে এ মানব সভ্যতার, এ মাটির অশ্রুই সম্বল। 

ঘুমাও বাছা, ঘুমাও মানিক। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন পূরণ সহজ অতি। চাঁদ মামা তোর ব্যথার সাথী কোমল মায়ার হাত বুলিয়ে তারার দল খেলতে আসে। যে চিরনিদ্রায় শায়িত তাকে নীরবতা, নৈঃশব্দ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানান আপনারা। অতএব, সবাই একটু নীরবতা রক্ষা করুন। বোলো না কথা পাখি, আস্তে ঝরো ফুল। 

(২০২৩ সালের আগস্ট, তারিখটা সম্ভবত নয় বা দশ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ১৮ বছরের তরুণ ছাত্রটি যার গোঁফ - এর রেখাটিও স্পষ্ট হয়নি, সে হায়দারের শিকার হয়েছিল। বলা ভালো হোস্টেলে খুন হয়েছিল।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন