মিঠুন মুখার্জী
উৎসব প্রিয় বাঙালির বারমাসে তেরো পার্বণ। বাঙালির মতো উৎসব পাগল জাতি এজগতে বিরল। বাঙালিদের সমস্ত উৎসবের মধ্যে দুর্গা পুজো শ্রেষ্ঠ। এই উৎসবের আনন্দ শেষ হতে না হতেই বাঙালি শক্তি সাধনায় ব্রতী হন। আশ্বিন-কার্তিক মাস জুড়ে বাঙালির উৎসব আর উৎসব। দুর্গা পুজোর মতো চার-পাঁচ দিনের মহাযজ্ঞ না হলেও কালীপুজোয় তারা একেবারে কম আনন্দ করেন না। পাড়ার প্রত্যেক ক্লাবে, বাজার সমিতি, বিভিন্ন ছোট বড় মন্দিরে এই পুজো হয়ে থাকে। এছাড়াও সতী মায়ের একান্ন পিঠেও সতীমায়ের পুজো হয়ে থাকে এই দিন। এ জগতের সমস্ত অপশক্তিকে নাশ করার জন্য মহাশক্তি কালিকার আরাধনায় বাঙালি উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। দুর্গা পুজোর পরের মহাঅমাবস্যার গোনে এই পুজো হয়ে থাকে।
'কাল' শব্দ থেকে 'কালী' শব্দটি এসেছে। 'কাল' কথার অর্থ 'সময়'। অর্থাৎ যিনি ত্রিকালদর্শী তিনিই হলেন কালী। তিনি সৃষ্টি ও প্রলয়ের দেবী। এমন মহাশক্তিকে ধারন করার মতো কোনো উপাদান এই পৃথিবীর বা প্রকৃতির কাছে নেই, তাই তিনি বিবস্ত্র। কোনো বসন তিনি পড়েন না। তিন ভুবনের সমস্ত কিছু তার নখদর্পণে। তিনিই মহামায়া বা দুর্গার আরেক রূপ। তার ক্রোধে সমস্ত বিশ্ব মুহ্যমান। এই মহাশক্তির আরাধনায় সমস্ত বাঙালি তথা ভারতবাসী সারা বছর ব্যস্ত থাকেন।
নবদ্বীপের কৃষ্ণানন্দ নামে এক তান্ত্রিক বাংলায় প্রথম কালীমূর্তি বা প্রতিমা পূজার প্রচলন করেন। তার আগে মা কালীর উপাসকরা তাম্র পটে বা খোদাই করে কালীর মূর্তি এঁকে মা কালীর সাধনা করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালী পূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং এইভাবে মা কালীর প্রতিমা পূজার প্রচলন শুরু। উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বিভিন্ন ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপুজোর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়।
দেবী কালীর বিভিন্ন রূপ সমগ্ৰ জগতে পূজিত হয়। ছিন্নমস্তা কালী, দ্বীপান্বিতা কালী, ফলহারিনী কালী, শ্মশান কালী, ভদ্র কালী, চামুণ্ডা কালী, দক্ষিনা কালী, রক্ষা কালী, গ্ৰহকালী, রটন্তীকালী, কাল কালী, চিকা কালী, কঙ্কাল কালী, পৌষ কালী প্রভৃতি। মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে ফলহারিণী কালীপূজা করা হয়। পৌষ মাসের অমাবস্যাতে পৌষকালী ও কৌশিকী অমাবস্যাতে শ্মশান কালীর পুজো হয়ে থাকে। কার্তিক মাসের অমাবস্যাতে বাঙালির প্রিয় কালী পুজোকে মূলত দ্বীপান্বিতা কালী পুজো বলা হয়ে থাকে। এই দিন কালী ঘাটের কালী মাকে লক্ষ্মী রূপে পুজো করা হয়। হিন্দুদের দেবী রুপে ইনি সমগ্ৰ ভারতবর্ষে পূজিত হন। কালী পুজোর দিন ব্রাক্ষ্মণ উপোস থেকে সারা রাত জেগে পুজো করে থাকেন। প্রান প্রতিষ্ঠা, চক্ষুদান, হোমযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে পুজো সম্পন্ন করেন তিনি। একদা কালী পুজোতে পশুবলি দেওয়ার প্রচলন ছিল অনেক জায়গায়। আবার অতি প্রাচীন কালে ডাকাতেরা ও কাপালিকেরা নরবলির মধ্যে দিয়ে মায়ের পুজো করে থাকতেন। বতর্মানে অনেক জায়গায় নরবলি ও পশুবলি উঠে গিয়ে ফলমূল ও সব্জিবলি দেওয়া হয় মায়ের পুজোতে।
তন্ত্রসাধকেরা একসময় এই মহাশক্তি কালিকার আরাধনা করতেন। লাল বস্ত্র পরিধান করে মায়ের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে এই আরাধনায় তারা মত্ত হতেন। রামপ্রসাদ সেন, সাধক ব্যামাক্ষ্যাপা, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মা কালীর সাধনায় নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। কালী সাধক আরামবাগের দেখানো পথেই গৃহীসাধক রামপ্রসাদ সেন মাতৃসাধনা করেছেন। এরা সকলেই বাঙালির তন্ত্রসাধনাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
কালী পুজোর দিন সারারাত ধরে দক্ষিনেশ্বরে মহাড়ম্বরের সঙ্গে কালী পুজো হয়। হাজার হাজার পুন্যার্থির সমাগমে সারারাত গমগম করে ঐ চত্বরটি। প্রসাদ বিতরণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে ওই দিন। মন্ডপে মন্ডপে মা কালীর দর্শনে বাঙালির ভিড় উপচে পরে কালীপুজোর কয়েক দিন। সারা বাংলার অনেক জায়গা আছে যেখানে দুর্গা পুজোর মতো প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ঘন ঘন চোখ জুড়ানো মন্ডপ ও কালী প্রতিমা নির্মাণ করেন পুজো কমিটিরা। সারারাত জেগে মানুষ ঠাকুর দেখেন।
শুধু মা কালীর মন্ডপ ও প্রতিমা দর্শন নয় আলোকসজ্জা, বাজি প্রর্দশনী থাকে দেখার মতো। দেশি-বিদেশি নানান থিমের উপর মন্ডপ তৈরি করা হয়ে থাকে। পুজোর দুসপ্তাহ আগে থেকে আবার কোথাও দুর্গা পুজোর আগে থেকেই মন্ডপ তৈরির কাজ চলে। দূরদূরান্ত থেকে ভালো ভালো বাঙালি শিল্পীরা এই কাজ করতে আসেন। কোথাও চন্দননগরের আলোকসজ্জা অনেক অর্থ ব্যয় করে নিয়ে আসে পুজো কমিটির লোকেরা। কুমোরটুলি থেকে নিয়ে আসে মায়ের মূর্তি।
রাতজেগে বাঙালি মেয়ে-বউরা এই দিনে কালী পুজোর সমস্ত গোছানোর কাজ করেন। একশো আটটি প্রদীপের সলতে পাকানো, তেল দেওয়া, ফলমূল কাটা, মায়ের জন্য মালা গাঁথা, হোমের সরঞ্জাম জোগাড় করে দেওয়া, বিল্বপত্র-দূর্বা তোলা ও পুরোহিতের আদেশ অনুযায়ী সমস্ত কাজ করে থাকেন তারা। সারা দিন-রাত নির্জলা উপোস করে মা কালীর কাছে পুষ্পাঞ্জলী দিয়ে থাকেন তারা।
বাঙালিরা খেতে খুবই ভালোবাসেন। কালী ঠাকুর দেখার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া চলে কব্জিডুবিয়ে। ফাস্টফুড খেতে তারা খুবই পছন্দ করেন। চাউমিন, মোগলাই, বিরিয়ানি, চিকেনের আইটেম, কেক, আইসক্রিম এবং অবশ্যই ফুচকা তাদের খুবই প্রিয়। কালী পুজোর দুই-তিন দিন তারা ঠাকুর দেখতে গিয়ে এগুলি খেয়ে থাকেন। তাছাড়া নানান রকমের মিষ্টি তো আছেই। ভাই ফোঁটার খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে দিয়ে বাঙালির উৎসব মরশুমটা শেষ হয়।
কার্তিক মাসে কালী পুজোর আগের দিন বাঙালিদের মধ্যে চোদ্দ প্রদীপ দেওয়া ও চোদ্দ শাখ খাওয়ার রীতি প্রচলিত। তাছাড়া কালী পুজোর দিন রাত্রে প্রত্যেক বাড়িতে ও মন্দিরে মোমবাতি জ্বালিয়ে অশুভ শক্তির নাশ ঘটানো হয়। মোমের আলোয় বাড়িতে শুভ শক্তির প্রবেশ ঘটে।
এই পুজোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ক্লাবে ও সমিতিতে মোমবাতি ধরানো, শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। নরনারায়ণ সেবার আয়োজন করে প্রায় প্রত্যেক ক্লাব কমিটিরা। ঠাকুর নিয়ে শোভাযাত্রায় বেরয় গ্ৰামবাসীরা। বক্স বাজিয়ে, লাইট লাগিয়ে জেনারেটর নিয়ে নিজেদের এলাকায় নাচতে নাচতে প্রায় মাঝরাতে ঠাকুর বিসর্জন করেন তারা।
পরিশেষে বলাযায় বাঙালির জীবনে দুর্গা পুজোর মতো কালী পুজোরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। দুষ্টের দমনে মহাশক্তি কালিকার জুড়ি মেলা ভার। তিনি জগৎবাসির রক্ষার্থে সর্বদা তৎপর। তার সাধনায় বাঙালি তন্ত্র সাধকেরা সংসার পর্যন্ত ত্যাগ করে থাকেন। তার আশীর্বাদ লাভের আশায় বাঙালিরা দেবী কালীর বিভিন্ন রূপকে পুজো করে থাকেন। মহাকালীকে কেউ কেউ ভয়ের দৃষ্টি দিয়ে দেখলেও কেউ কেউ স্নেহময়ী মা হিসাবে দেখেন। প্রতিবছর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তারা মা কালীর পুজো করেন। মন থেকে সকলে একটি কথায় বারবার বলেন-"আসছে বছর আবার হবে। মা তুমি আবার এসো।"