দোঁহা

পাপড়ি দাস সরকারের গুচ্ছ কবিতা

 


সভ্যতার জন্য

আরও একটা মিছিল এগিয়ে আসছে
মরণম্মুখে জিজীবিষার দিকে
সাহারার শুন্যতা বুকে নিয়ে।

একইভাবে মিলিয়ে যাবে
শুধু সাক্ষী থেকে যাবো আমি
পূর্বাপোর শূণ্যতার বোবা সাক্ষী।

যার বুকে একদিন ছিল নদী
সে রোজ মৃত সন্তানের জন্ম দেয় এখন
আমার আদিমতম বন্ধ্যা মা।

ছড়িয়ে পড়ছি বিষাক্ত শিকড়
তাই এবার চলে যেতে চাই

চিলেকোঠায় রেখে গেলাম
শেষ স্মৃতিচিহ্ন

সভ্যতার সুইসাইড নোট
এই প্রেত জন্মের শেষে একবার গাছ হয়ে জন্মাতে চাই।



মুনলাইট

নতুন দুঃখে নতুন ভয়ে এই নিশ্চিত এই সংশয়
কেমন আছো হে প্রিয় দুর্দিন?

পরিত্যক্তা বাড়ির  আলনা
মাকড়সা জাল ধুলো কঙ্কাল
সমস্ত ঠেলে ভেসে আসে এক
নুয়ে পড়া কাঁধে বেজে ওঠা ভায়োলিনে...


আয়ে না বালম 

একতলা বাড়ির ভাঙা চৌকাঠ
উলঙ্গ রডে ঘুড়ি খায় লাট
ছাদকে নিয়ে উড়ে পালানোর ইচ্ছে

বিকেলবেলায় জ্বরগুলো সব পালাচ্ছে,
তারা সামনেই

নীচ থেকে যারা ঘুড়ি  ও ছাদের
বেমালুম মজা নিচ্ছি...


গতজন্ম

হে দুর্দিন হে প্রিয় জখম
আমি তো ভীতু, আমি অক্ষম
সেই ঘর থেকে বহু বহু দূরে
নিথর বসত করি...

তবু কী অলীক সাহস আমার
ইহজন্মের দেহ ছারখার
শ্যাওলায় মোড়া মুখটি ভাসলে

চলন্ত ট্রেনে বারবার উঠে পড়ি।


বাড়ির পাশে আড়শিনগর

মনে মনে ছেড়ে আসা পুরোনো শহর
কাঁধে নুয়ে বাছতেই লীন প্রান্তর
কামরায় বাউলের আরশিনগর
মিলে যাচ্ছিল ঘর রুগ্ন দু হাতে
করাতের রাত আর শব্দে জখম
খাতা চিরে বের হওয়া আখরের যম
কবিতা খুঁটতে পাওয়া শোকানো মলম
আমি তো অধম, চলি তফাতে...


গোপনে

জিজ্ঞাসা থেকে আজও পাখি শব্দ ভেসে আসে
হুবহু সে ঝাপটানি
ডানা মুরতে শেখেনি কখনও
ফোকাসের ভুলে তবু বায়নাকুলার কেন
ইতিউতি চোখ  রাখে

নড়ে ওঠে সুদূর শাখাটি
দেখেছি, দেখেছি! তবু
সব নাম বলতে নেই...


ছুটি

প্রস্তুতি সারা তবে দুটি মিলে যাওয়া যাক -এই শীতে
কুয়াশা, হোটেলরুম, ফার্নসে পুরোনো প্রেমিক

ওদিকে তাকাতে নেই
বরং আকাশ দেখো, ছেঁড়া মেঘের দল

সামান্য হাওয়া দিলে
ওরকম প্রেম উড়ে যায় :সী বিচে...


মূর্তি

অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন আর ততটা লাগেনা
মনকে বোঝাতে পারি,
এমনটাই হওয়ার কথা ছিল
তবুও মনে পড়ে
প্রিয় দিন, প্রিয় বাক্যালাপ
পানপাতা। সংসার...


সৃষ্টির উৎস মূল

তারা পোড়ে নীল আকাশে, ধবধবে তারা,
তারা পোড়া সাদা ছাই মহাশুন্যে ভাসে।

ঋতুমতী পৃথ্বী দেবীর স্নান শেষে  অহল্যা যাপন,
ভস্মবীজ পাথর ছুঁলে ক্ষুদ্র এক ঘাসের জন্ম হয়।

ঘাস নয় গাছ নয়,
কবিবৃক্ষ  মরুভূমে একা জাদুকর
শরীরে মেঘ জমে, মেঘপাখি  বৃক্ষে বাঁধে ঘর।



পঞ্চমুন্ডি

মায়ার মধ্যবর্তী ছবিগুলি আরও কিছু  পরিষ্কার হলে
বোঝা যায় নিকটেই শ্মশান 'পল্লী বন্ধু'
নদীজলে খসে পড়ে মৃতকাঠ
যেন অনিঃশেষ  মন্ত্র থেকে ঝরে যায় ফুল
সফল সূর্যাস্তে লাগে চন্দনের ফোঁটা
আজীবন রুদ্ধ কিশোরী এক ফুলের সমারোহ ছেড়ে চলে যায় শালুকপাতার পথে...নিয়তি?
কিশোরীর পদ্মমধু  টলমল  করে
অশ্রু নির্মাণে আজও নই ততখানি সঠিক
যতখানি  ভেসে যায় পক্ষীশাবকের  হাড় লবণহ্রদের জলে।


হে সৃষ্টি আঁধার

আমাকে স্বপ্নের কাছে  একা রেখে  চলে  গেছ  দূরে...
সেতুর উপর থেকে যোগাযোগহীন, দেখি
নরম সব্জি - বাজার ভরে যায় কেরোসিন আলোর মালায় -
আরো কোন ব্যাকুল অগ্নির মতো
তোমার আঙ্গুলগুলি মনে পড়ে
হারমোনিয়ামে-
ডানার ওজন যেরকম  মিশে থাকে  উড়ন্ত পাখির  সঙ্গে
সেইভাবে মিশে আছো

তোমাকে বোঝার  ছলে
বনের  ভিতর-পোড়া-শিবমন্দিরে, হোমাগ্নি জ্বলে ওঠে


পুরাণ

পরস্পর  জড়িয়ে যাচ্ছে আয়ু ও আকার
যেই মাত্র পাত্রখানি  গড়িয়ে পড়বে
টুপটাপ জ্যোৎস্না মেখে  নেবে অন্ধকার
রকমারি  রঙ ও মেজাজের তানে
দরবাড়ী মিয়া-কি-মল্লার মিশ্র মাধ্যম
আয়ুজোড়া ঝংকার বেজে ওঠে  প্রহর ত্রিতাল
মুদ্রা বিভঙ্গ তাকে তুলে নেয় নিক্কনে
নৃত্য পরম্পরা ছন্দের তাণ বোলে
চিরায়ু জীবগাথা  স্তব্ধ মহিমাপুরাণ
বন্ধ দুয়ার ঘর  নিরেট পাথুরে রন্ধ্রহীন
নিরন্ধ্র  ঘরে  তবু  লখাইয়ের প্রাণ সংশয়
লৌহবাসরে  বুঝি  বেহুলার প্রণয় যাচনা
সর্পইন্ধন দেয় দংশন  শিবিরে
আয়ু  আকার মেপে বিষ ঢালে প্ররোচনা
বিষর্পিল পথ গুঞ্জন অন্ধ  লয়তালে


অলিখিত ভোর

এই যে অসুখ  বাসা বেঁধেছে  দেহে
খসে পড়ছে  রোজকার বাহুবন্ধন
যত্রতত্র  শুয়োপোকার উৎপাত
শরীর জানেনা সে গুপ্ত কথা
তার চেয়ে  অধিক  অসুস্থ মন।
আলোর নীচে যেখানে মৃত্যুর ন্যায়
মন  অন্ধকারের বসবাস দিন রাত
চলে দেহকে সুস্থ করে তোলার
প্লাজমা ফুসফুস ছেঁড়া আয়োজন
সবাই চায়  জন্মের প্রজাপতি ব্রহ্ম

কিন্ত মনের কোণে অদৃশ্য শুয়োটাকে
আটকে রাখে জিভের তলায়, লালসার আঠায়


মায়া

একলা রাতের মতো চাঁদহীন
জেগে আছে একলা পুরুষ
ডুবে আছে  কালের তরী নিস্তব্ধ অন্ধকারে
অথচ! পেঁচার আর্তনাদে গলেনি জ্যোৎস্নার জমাট
বিমর্ষ মুখ  লুকিয়ে রেখেছে  চাঁদ বাঁধা মেঘ।
ব্যাথাতুর হৃদয় কাঁদতে ভুলে
ভোলেনি মুখ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন