হৃতম বিশ্বাস
আমি মাঝেমধ্যে রবীন্দ্রনাথ ওল্টাই। সচেতন ভাবেই ওল্টাই। নবজাতক-কাব্যগ্ৰন্থে হঠাৎ চোখে পড়লো,
"নবীন আগন্তুক,
নব যুগ তব যাত্রার পথ
চেয়ে আছে উৎসুক।
কী বার্তা নিয়ে মর্তে এসেছ তুমি;
জীবনরঙ্গভূমে
তোমার লাগিয়া পাতিয়াছে কী আসন।
নরদেবতার পূজায় এনেছ
কী নব সম্ভাষণ।"
আগন্তুক কে! তাকে চোখে দেখা যায়? আসলে আগন্তুক'কে খুঁজতে গিয়েই মানুষ আমি ভ্রষ্ট হন। যেমন রামপ্রসাদ। যেমন বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ কি নিজেকে ভুলেছিলেন কখনো!
ভুলেছিলেন। স্বামীজী প্রেমে ভুলেছিলেন নিজেকে। তা কি ওই পারস্পরিক প্রেম!
আমি খুব সচেতন ভাবেই বলবো-না। স্বামীজীর প্রেম একতরফা। স্বামীজী এক ত্রিভূজের কথা বলেছিলেন। তাকে দিয়েই আমার আলোচনা শুরু করি।
সেই ত্রিভুজের তিনটি বিন্দুই একটা নঞর্থক বিন্দু।
১.না জোরাজুরি।
২.না চাওয়া।
৩.না ভয়।
এই তিনটে বিন্দু মিললেই হয়, প্রেমের ত্রিভুজ। তবে হয় না সবসময়। 'তোমায় নতুন করেই পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ'-এর মতন ঘটনা ঘটতেই থাকে। সে নতুন হয়েই দেখা দেয়। কিন্তু নতুন টা কি? আর কেমনই বা তার রূপ?
সে সত্য। ইউনিভার্সাল ট্রুথ।
জন ডানের একটা কবিতা এ প্রসঙ্গে রাখা যায়,
"Death, be not proud, though some have called thee
Mighty and dreadful, for thou art not so;
For those whom thou think'st thou dost overthrow
Die not, poor Death, nor yet canst thou kill me.
From rest and sleep, which but thy pictures be,
Much pleasure; then from thee much more must flow,
And soonest our best men with thee do go,
Rest of their bones, and soul's delivery.
Thou art slave to fate, chance, kings, and desperate men,
And dost with poison, war, and sickness dwell,
And poppy or charms can make us sleep as well
And better than thy stroke; why swell'st thou then?
One short sleep past, we wake eternally
And death shall be no more; Death, thou shalt die."
এর পাশাপাশি আমি সচেতনভাবেই রাখছি স্বামীজীর ই এক লেখা--
"The stars are blotted out,
The clouds are covering clouds,
It is darkness vibrant, sonant.
In the roaring, whirling wind
Are the souls of a million lunatics
Just loose from the prison-house,
Wrenching trees by the roots,
Sweeping all from the path.
The sea has joined the fray,
And swirls up mountain-waves,
To reach the pitchy sky.
The flash of lurid light
Reveals on every side
A thousand, thousand shades
Of Death begrimed and black —
Scattering plagues and sorrows,
Dancing mad with joy,
Come, Mother, come!
For Terror is Thy name,
Death is in Thy breath,
And every shaking step
Destroys a world for e’er.
Thou “Time”, the All-Destroyer!
Come, O Mother, come!
Who dares misery love,
And hug the form of Death,
Dance in Destruction’s dance,
To him the Mother comes."
এটাও এক মৃত্যু রূপেরই কবিতা। জন ডানের যে কবি দিলাম, তাতে ডান বলছেন---মৃত্যুর মৃত্যুর কথা। আর স্বামীজীর এই কবিতায় এসেছে মৃত্যু আহ্বানের কথা। 'নাচুক তাহাতে শ্যামা'-বলে যে অনুরণন তুলেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। যাই হোক, স্বামীজীর কাছে মৃত্যু'ই ছিল প্রেম। তিনি মৃত্যুকেই একতরফা ভালোবাসতেন। আর তাতেই তার সর্বনাশ হলো।
আমি শুধু স্বামীজীর প্রেমের কথা বলবো বলেই, আলোচনা শুরু করেছি। কিন্তু দেখলাম স্বামীজীর প্রেম বলতে গিয়ে আসছেন অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারকেই ঢেকে আছেন আরেক অন্ধকার। আবার অন্ধকারেই আলো। ওই যে কালো নগ্ন মেয়ের পায়ের তলায়, সাদা শিব না থাকলে, কালীকে কালো হিসাবে বুঝতাম। যেমন ডান মৃত্যু আছে বলেই মৃত্যুকে বুঝেছেন। তাই মৃত্যুকেই বলছেন তার মৃত্যু হবে।
যেমন মহাত্মা কবীর বলেছেন,
"প্রেমের গলি খুব সরু গলি
তাতে দুজন চলতে পারে না
তুমি এলে আমি চলে যাই। "
এই সরু গলি ধরেই স্বামীজীর যাওয়া। তিনি আছেন ততক্ষণ, যতক্ষণ না কালী নেই। যেই কালী এলো, স্বামীজী নেই। তখন তিনি মিলিয়ে গেলেন। ওই যেমন নুনের পুতুল সমুদ্রে মিলিয়ে যায়। তেমনই। এতেই সর্ব নাশ। ন্যস্তি ন্যস্তি হতে হতে, অহম অহম ভাব জেগে ওঠে।
কালী নামক দিব্য সত্যের সাথে মিলে যায় সাধক মন।
তবে দিব্য সত্য কি আছে?
হিউম যে বলেছেন, অনেক ভিতরে ঢুকে দেখেছি, কেউ নেই। কেউ না।
আসলে সে আছেন বলেই তার অস্তিত্ব নেই। না থাকলেই তার অস্তিত্ব। আসলে আমরাও যে কেউ নেই। আমাদেরও যে অস্তিত্ব নেই। আমরা আধখানা আমি। আর আধখানা আমিকে খুঁজতে বেড়োই। যেমন স্বামীজী বলছেন-
"শোন বলি মরমের কথা, জেনেছি জীবনে সত্য সার—
তরঙ্গ-আকুল ভবঘোর, এক তরী করে পারাপার—
মন্ত্র-তন্ত্র, প্রাণ-নিয়মন, মতামত, দর্শন-বিজ্ঞান,
ত্যাগ-ভোগ—বুদ্ধির বিভ্রম;‘প্রেম’ ‘প্রেম’—এই মাত্র ধন।
জীব ব্রহ্ম, মানব ঈশ্বর, ভূত-প্রেত-আদি দেবগণ,
পশু-পক্ষী কীট-অণুকীট—এই প্রেম হৃদয়ে সবার।
‘দেব’ ‘দেব’—বল আর কেবা?কেবা বল সবারে চালায়?
পুত্র তরে মায়ে দেয় প্রাণ, দস্যু হরে—প্রেমের প্রেরণ!!
হয়ে বাক্য-মন-অগোচর, সুখ-দুঃখে তিনি অধিষ্ঠান,
মহাশক্তি কালী মৃত্যুরূপা, মাতৃভাবে তাঁরি আগমন।
রোগ-শোক, দারিদ্র্য-যাতনা, ধর্মাধর্ম, শুভাশুভ ফল,
সব ভাবে তাঁরি উপাসনা, জীবে বল কেবা কিবা করে?"
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, বিবেকমানসে একদিকে ওই প্রেমের ত্রিভুজ, মৃত্যু অন্যদিকে সখার প্রতি, প্রায় হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জন্ম-মৃত্যু, আলো-অন্ধকারের মতন।