দোঁহা

ব্যক্তিত্ব নিছক বিন্দু

 


শতাব্দী চক্রবর্তী
কখনো কখনো ব্যক্তিত্ব জলবিন্দুর মতো হয়ে যায়। এ জগতে আমরা নিজেদের যতই মুক্ত বলি না কেন আসলে প্রতিটি শরীর অদৃশ্য শিকলে বাঁধা, মিহি জালে বোনা পিঞ্জরে বন্দি। দায়িত্ব বড় বালাই। আবার দায়িত্বের ঘেরাটোপের বাইরে যখন নিম ফুল, পাহাড়ি ফুল, হলুদ বেগুনি ফুল জানালায় ফুরফুরে জন্মদিন উদযাপন করে আমরা ভেজা বারুদের মতো বসে থাকি। কোনো নিষেধাজ্ঞা বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে না। নিশ্ছিদ্র দুপুরে লম্বা উট বালির ওপর হাঁটে এক উচ্চ আভিজাত্য নিয়ে আমরা কয়েক জোড়া কমজোরী হলদে চোখ দিয়ে সেই হাঁটা দেখি, অনুকরণ করতে চাই কিন্তু ব্যর্থ হই। আমরা কেবল দৃশ্যের ভেতর দর্শন খুঁজি। এই যে দূরের হোগলাভর্তি জলাজমির ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কিছু বক তারা নিদারুণ আনন্দে কাদা খোঁচে, আমরা খুঁজি তাদের ব্যক্তিত্ব। 

আমরা জানি এ জীবনে আশা এবং নিরাশা দুটোই অর্থহীন। না মানলেই জীবন উৎকৃষ্ট হবে। আশা জন্মায় নিজের আত্মবিশ্বাসের অভাবে এবং নিরাশা জন্মায় নিজের নিরাপত্তাহীনতা থেকে। এই যে মন্দিরের ঘন্টাটি বেজে উঠলো হয় কেউ সাহায্য করেছে নয়তো হাওয়ার ধাক্কায়। বেজে ওঠার একটু আগে পর্যন্ত দেবতা বা ঘন্টা কেউ জানতো না ওটির শব্দ তরঙ্গের আবির্ভাব বিষয়ে। আশা নিরাশা কোনটিই আক্ষরিক অর্থে ছিল না।

কিন্তু তবুও আমরা আশা শব্দটিতে আলো দিই, জানালায় এসে হাত পাতি নরম ভোর ধরার জন্য। লক্ষ্য পূরণ না হলেই নৈরাশ্য। 
জন্ম ইস্তক সুখ দুঃখ দুই বয়ে বেড়াই আমরা। আশা নিরাশা দুটোকেই সমানভাবে আগলে রাখি হৃদয়ে। সব অর্থ মস্তিষ্ক দিয়ে বের করা যায় না। কিছু সময় নিজের থেকেই হারিয়ে যেতে হয়। আশা নিরাশা সুখ দুঃখ সমস্ত জাগানিয়া বিষয়গুলোকে বন্ধ করে রেখে বেরিয়ে পড়তে হয় ব্যক্তিত্বের ভাবগম্ভীর কাজটিকে ছুটি দিয়ে। ব্যক্তিগত জীবনকে খানিক জিরিয়ে নিজেকে জানতে। 

জায়গা বিশেষে মানুষের মনে দখলদারিত্ব করে আবহাওয়া, পরিবেশ। তখন তারাই হয়ে ওঠে আমাদের ভেতরকার নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বিশেষ। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো মনের আনাচ কানাচ বদলে দিতে থাকে পাহাড়ি মেঘ, ঝর্ণা, একাকী ঘোড়া, নিঃসঙ্গ কোনো হরিণ শাবক। যে পথের ধারে একলা দাঁড়িয়ে ছিল দলের থেকে হারিয়ে গেছে অথবা নিজেই একা একা পথ চিনবে বলে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশে সবুজ গাছের নিচে বড় গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

যখন গতির সাথে সাথে আমরা ছুটে চলছি অথচ কোথাও থেকে যেন হারিয়ে যাচ্ছি, কোনো গন্তব্য নেই কোনো প্রচ্ছন্ন ক্রোধ লোভ লালসা নেই কেবল দু-চোখ ভরে নৈসর্গিক দৃশ্য দেখছি তখন যেন আপনা হতেই নিজস্ব ভাবগম্ভীর ব্যক্তিত্ব মুছে গিয়ে আপনভোলা সরল শিশুর মতো হয়ে যাই। কোথাও পৌঁছাবো বলে তো ঘর থেকে বের হইনি! পাইন বনে, জংলি ফুলে, হরিণ, ময়ূরের শোভার ভেতর, বাইসন আর বাঘের ভয়ের মধ্যে, মন্দির আর ঘন্টার ধ্বনির মধ্যে, ভিন্ন মানুষের আক্ষরিক ভাষা না বোঝার মধ্যেই হারিয়ে যাব বলে বেরিয়ে পড়ি। 

মেঘের আড়ালে নাকি ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধ করেন। সেই যুদ্ধের ভেতর ক্রমশ ঢুকে পড়ি কিন্তু হতাহত হইনা। কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘের ভেতর একহাত দূরেও কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না যখন অথচ উঁচু নিচু পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে চলে চালক নির্বিঘ্নেই। তাদেরকেও মনে হয় ইন্দ্রজিতের মতোই যুদ্ধ কৌশলী। গোধূলি ছায়া নেমে আসে যখন ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘের সাহায্যে দোদাবেতা পিক কুয়াশা আর বৃষ্টি মেখে ঝাপসা হয়ে আছে। নীলগিরি পর্বতমালার উচ্চতম শৃঙ্গ ব্যক্তিত্ব সুঠাম দেহে ধরে রেখেছে আমরা পৌঁছাতে পারিনি এ আমাদের ব্যর্থতা। সাথে সাথে দুঃখ নেমে এলো। গোপন চোরাবালির ভেতর ঢুকে যেতে থাকলাম। পূর্বদিনের টয় ট্রেনে চাপার আনন্দ নৈরাশ্যে ভরে যায়। যে মন নিরাশা প্রদান করে সেই আশা দেয়। হরমোন নিঃসরণ আবেগ উচ্ছ্বাসে। আমরা কেবল পথের পথিক কোন্ পথে যাব তাও জানতে পারি না পদক্ষেপের পূর্ব মুহূর্তে। 

     



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন