শুভাঙ্কুর মিত্র
[রাজীব নায়েকের মারাঠি নাটক 'সাঠেচা ক্যা করায়চা' র সংক্ষিপ্ত অনুবাদ]
এষা: সৌভিক, কিছু হয়েছে?
সৌভিক: সব কটা শুওরের বাচ্চা!
এষা: ওহ! এজ ইউসুয়াল!
সৌভিক: শয়তানগুলো একের পর এক কনফারেন্স করে যাবে...পয়সা যেন খোলামকুচি!
এষা: এক্সক্যাটলি কার ব্যাপারে বলছো, একটু বলবে?
সৌভিক: সব কটাই! ডিসুজা, সত্যব্রত। আমাকে স্পেশালি ইনভাইট করার কারণটা, আমি বুঝি না ভেবেছে? এতো জাঁকজমক করে, স্ক্রীনিং করা, সব যে আমাকেই দেখানোর জন্য, সেটা আমি বুঝি না?
এষা: আমাকে শোনাতে চাইলে, প্রথম থেকে বলো, প্লিজ!
সৌভিক: বেশ ম্যাম, তাহলে প্রথম থেকেই শুনুন! আজ সত্যব্রতর নতুন ডকুমেন্টারী ফিল্মের প্রথম স্ক্রীনিং হলো! আমি সেখানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলাম! ককটেল, ডিনার, ফোটোগ্রাফি, প্রেস...সব কিছুই ফাটাফাটি!
এষা: ও আচ্ছা! তা, কিসের ওপরে ফিল্মটা?
সৌভিক: ভগবান জানে! কেন যে এসব বানায়? আর আমাদের অ্যাডফিল্মগুলো সব ট্র্যাশ!
এষা: সত্য বলেছে? অ্যাডফিল্মগুলো ট্র্যাশ?
সৌভিক: ও দেখলে তো বলবে?
এষা: টেলিভিশন তো দেখে! তোমার অ্যাডও নিশ্চয়ই চোখে পড়বে!
সৌভিক: হাহ...প্রথমে এমন একটা ইস্যু খুঁজে বার করো, যেটা বাস্তব থেকে অনেক দূরে। তারপর এখান সেখান থেকে ফান্ড জোগাড় করো। ব্যাস, অন্ধ্রপ্রদেশের বন্ডেড লেবার ইস্যু নিয়ে ছবি বানিয়ে, বাংলার একজন প্রগ্রেসিভ ফিল্ম মেকার তৈরী হয়ে গেলো! আর আমরা? না, আমরা হলাম 'অ্যাডমেন'। যাদের কোনো প্রগ্রেসিভ চিন্তা ভাবনাই নেই ।
এষা: সে তো, তুমি নিজেই গর্ব করে সবাইকে বলো, যে ওই কফির অ্যাডটা তোমার বানানো।
সৌভিক: আরে, সেটা তো একটা! আর বাকি সবগুলোই তো কর্পোরেট ফিল্ম। তবুও আমরা হলাম গিয়ে "অ্যাডওয়ালা"।
এষা: সেই ফিল্মগুলোও তো আসলে অ্যাড ফিল্মই!
সৌভিক: আর ওই যেটা, ওয়ার্লি ট্রাইবালদের নিয়ে বানিয়েছিলাম? কোনো কমেন্টারি ছিল না! সেটাও “অ্যাডফিল্ম”?
এষা: না, কিন্তু সেটা তো মাত্র একটাই!
সৌভিক: সেটাও তো সাধারণ লোকের জন্যই করা হয়েছিল। কমেন্টারি করে স্পুন -ফিড করানোও হয়নি। আর এদের দেখো! দিনের পর দিন ওই একই জিনিস বানিয়ে যাচ্ছে। আর্টিস্টিক স্টাফ! কটেম্পোরারি ওয়ার্ল্ড থেকে হাজার মাইল দূরে!
এষা: করুক না!
সৌভিক: করুক না, মানে?
এষা: ওরা, ওদের মতো করুক না!
সৌভিক: শয়তানগুলো, যা খুশি করবে আর …
এষা: নিজেই তো বললে, এরা শয়তান । তাহলে, ওদের নিয়ে ভেবে লাভ আছে?
সৌভিক: তুমি কিন্তু একই কথা বার বার বলছো!
এষা: আমি বলছি? না তুমি? ওরা যদি শয়তান হয়, তাহলে ওদের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়াটা তোমার কাছে ইম্পরট্যান্ট হবে কেন?
সৌভিক: কারণ আমাদের ফিল্ডে, ওরা এক একটা বড়ো নাম।
এষা: কোথায়, ওরা তোমার ফিল্ডে? তুমি অ্যাডফিল্ম বানাও আর সত্য বানায় ডকুমেন্টারি।
সৌভিক: একই ফিল্ড, কারণ আমরা সবাই ফিল্ম বানাই। আর তুমিও আমায়, ওদের মতো শুধু “অ্যাডম্যান” ই ভাবো? মাঝে মাঝে মনে হয়, তুমিও আসলে ওদের দলেই..
এষা: একদমই নয়। আমি ওদের ইজিলি ইগনোর করতে পারি।
সৌভিক: কারণটা সিম্পল। তুমি একজন টিচার। তোমার প্রফেশন, ওদের প্রফেশন এর সাথে ক্ল্যাশ করে না। তুমি, কেমন করে বুঝবে আমার জ্বালাটা?
এষা: জ্বালাটা যে হচ্ছে, সেটা আমি বুঝি। শুধু, এইটুকু বলতে চাইছি, এটা হওয়াটা উচিত নয়।
সৌভিক: তুমি আবার উপদেশ দিতে শুরু করো না । ওনাদের কাছ থেকে, আজ অনেক উপদেশ শুনে ফেলেছি...তুমি যদি আজ ওদেরকে শুনতে! কত পান্ডিত্য ওদের! ফিল্ম এর ছন্দ, এডিটিং নিয়ে...
এষা: তুমি চুপ করবে? বেরিয়ে এসো, ওখান থেকে। কিছু ভালো জিনিস নিশ্চয়ই আছে ওদের মধ্যে। তুমি কি কখনো ওদের কাজকে অ্যাপ্রেসিয়েট করেছো? ক্রিটিসাইজ ছাড়া আর কি করেছো তুমি? তুমি কি আদৌ ওদের ফিল্ম ওপেন মাইন্ড নিয়ে দেখতে যাও? কোনো রকম বায়াসড না হয়ে? বিকেলে স্ক্রীনিং থাকলে, সকাল থেকে ফুঁসতে থাকো! খারাপ না লেগে উপায় আছে? তুমি তো দেখার আগেই ডিসাইড করে ফেলো যে ফিল্মটা খারাপই হবে।
সৌভিক: মোটেই না। ফিল্ম খারাপ লাগার কারণগুলোও তো আমি বলি।
এষা: খারাপ বলতে হলে, কিছু কারণ সব সময় খুঁজে পাওয়া যায়। তুমি তো হ্যামলেটেও খুঁত খুঁজে বার করেছিলে!
সৌভিক: তুমি টিচার বলেই হয়তো সবাইকে চুপ করিয়ে দেওয়ার এমন প্রবণতা আছে । কিন্তু, সত্যি করে বলো তো, সত্যব্রত এই ধরনের ডকুমেন্টারি বানায়, আর আমরা “আম জনতা” র জন্য অ্যাডফিল্ম বানাই, কোনটা ভালো?
এষা: এই দুটোই, ভালোও হতে পারে আবার খারাপও। তুমি বলছো, সাধারণ মানুষ মানে “আম জনতা”, তাদের জন্য তুমি ছবি বানাও। কখনও ভেবে দেখেছো, ওগুলো তাদের কাছে পৌঁছয় কিনা? সত্যি কথা বলতে, ওই ওয়ার্লিদের নিয়ে যে ছবিটা তুমি করেছিলে, সেটা আমার মাথাতেই ঢোকেনি।
সৌভিক: প্রথম কথা হচ্ছে, আমার কাজকে তুমি খুব বেশি পাত্তা দাও না। দ্বিতীয়তঃ, তোমার কিছু ভালো লাগলেও, তুমি মুখ ফুটে কিছু বলবে না। আর, সব চেয়ে বড়ো কথা, তোমাকে সাধারণ মানুষ বা “আম জনতা” র দলে ফেলাও যায় না।
এষা: আমি সাধারণ মানুষ নই? তোমার ওই এডিটিং প্যাটার্ন এর আমি কিছু বুঝি? আমি অবশ্যই একজন সাধারণ মানুষ। সো কলড “আম জনতা”।
সৌভিক: ইংলিশ এর লেকচারার তুমি! তুমি “আম জনতা”? ভারত আর ইন্ডিয়া, দুটো আলাদা জিনিস, ম্যাডাম!
এষা: অদ্ভুত তুমি! আমাদের সবার মধ্যেই কিছু ভালো গুন থাকতে পারে। কেউ ভালো গান করতে পারে, কেউ ভালো নাচ করতে পারে, কেউ ভালো লেকচারার হতে পারে। তাই বলে তারা সাধারণ মানুষ নয়? বেশির ভাগ আর্ট ফিল্মেই তো আমি মাঝপথে ঘুমিয়ে পড়ি, আমি “আম জনতা” ছাড়া আর কি?
সৌভিক: যাই হোক, প্রশ্নটা হচ্ছে, প্রত্যেকবার ক্রিমটা ওরাই নিয়ে যাবে কেন? হাততালি, রিকগনিশন, অ্যাওয়ার্ড সব ওরাই নিয়ে যায়। যেন, ওরাই হচ্ছে এই ইন্ডাস্ট্রির একমাত্র প্রতিনিধি। দিল্লীতে গিয়ে দেখো, সবাই ওদেরকেই চেনে। আমরাও তো এখানে জান লড়িয়ে দিচ্ছি, নাকি? অথচ...
এষা: হতে পারে যে, তুমি অতটা ট্যালেন্টেড নও।
সৌভিক: সেটা কে ডিসাইড করবে? তুমি?
এষা: ঠিক আছে, আমি করলাম না। ওরাই করুক । কিন্তু তাতেও তো তোমার আপত্তি।
সৌভিক: ওরা কি ট্যালেন্টের ঠেকা নিয়ে রেখেছে নাকি? সব কটাই তো, সেলফ ডিক্লেয়ারড ট্যালেন্টেড। ছাড়ো এসব! অনেক রাত হলো। কাল সকালে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।
এষা: আর সবজিগুলো কে কিনবে শুনি? কালও যাওনি। যাও, আগে চটপট ওগুলো নিয়ে এসো। আমি একটা কুইক শাওয়ার নিয়ে আসি। তুমি নিশ্চয়ই বিকেলে স্নান করোনি?
সৌভিক: দিনের মধ্যে দশ বার ভিজতে পারবো না আমি।
এষা: নোংরা একটা!
সৌভিক: তুমি স্নান করে এসো। আমি একটু টি ভি দেখে, বেরোচ্ছি।
এষা: আজকাল টিভিতে, কফি অ্যাডটা কিন্তু আর দেখায় না।
***
এষা: কিভাবে, তুমি এমন করতে পারলে সৌভিক?
সৌভিক: আর কতবার একই কথা জিজ্ঞেস করবে?
এষা: যতক্ষন না উত্তর দিচ্ছ।
সৌভিক: আমি শুধু, আমার ইনভিটেশন কার্ডটা আমার অফিসের কলিগ, সুরেশ আর বিকাশকে দিয়ে দিয়েছিলাম। ব্যাস, এইটুকুই।
এষা: ব্যাস, এইটুকুই?
সৌভিক: বলছি তো, আর কিছু নয়।
এষা: তাহলে আমিই বলি! সুরেশ, এক হাজার টাকার বাজি জিতেছে।
সৌভিক: হ্যাঁ, জিতেছে। আমিই বাজি ধরেছিলাম, যে ওদের ওই ফিল্মটা, ও বসে দেখতে পারবে না। ও বললো, তুমি কি করে জানলে? আমি বললাম আমি সিওর, যে তুমি মাঝপথেই চিৎকার করে আওয়াজ দেবে। ও বললো, মোটেই নয়।
এষা: তখন তুমি বললে, ওর যদি সাহস থাকে, স্ক্রীনিং চলাকালীন আওয়াজ দেওয়ার, তাহলে তুমি ওকে, এক হাজার টাকা দেবে। আর সুরেশও তেমনি । চিৎকার করলো, আর বাজিটা জিতে নিলো। এটা কিরকম বাজি, সৌভিক? বেসিকালি, তুমি ওকে স্ক্রীনিং চলাকালীন আওয়াজ দেওয়ার জন্য “সুপারি” দিয়েছিলে।
সৌভিক: হ্যাঁ, দিয়েছিলাম! ওই ব্লাডি বাস্টার্ড আর ওর ওই নিকৃষ্ট মানের ফিল্মকে আমি ঘেন্না করি।
এষা: নাকি, তুমি ওকে হিংসে করো?
সৌভিক: কিসের হিংসে?
এষা: ওর সাফল্যকে হিংসে করো তুমি।
সৌভিক: কিসের সাফল্য? ওই বাজে-নিকৃষ্ট মানের ফিল্ম বানানোটা, সাফল্য?
এষা: তা নাহলে, এই রকম ভাবে ফুঁসতে না! এই রকম হিস্টিরিয়া রোগীর মতো “সুপারি” দিতে না!
সৌভিক: সরি!
এষা: পোড়া-পোড়া গন্ধ পাচ্ছি, সৌভিক! কিছু জ্বলছে তোমার মধ্যে।
সৌভিক: জ্বলছে, জ্বলছে । কিন্তু আমি করবোটা কি?
এষা: আমি বলি? যেটুকু ট্যালেন্ট, তোমার ভেতরে আছে, সেটাকে নিজের কাজের জন্য উজাড় করে দাও। হেলদি কম্পিটিশন থাকুক না?
সৌভিক: বলাটা খুব সহজ, এষা।
এষা: আমার কি মনে হচ্ছে, জানো? মনে হচ্ছে, দুই দুনিয়ার মাঝে তুমি ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে আছো। এক দুনিয়ায়, তোমার অ্যাড ফিল্ম, যেখানে প্রচুর টাকা। আর অন্য দুনিয়ায়, সত্যব্রতর ডকুমেন্টারী ফিল্ম, যেখানে মান-সম্মান। তুমি চাও, সত্যব্রতর মতো মান-সম্মান আর এডফিল্ম এর টাকা-পয়সা।
সৌভিক: আমি শুধু নিজেকে এক্সপ্রেস করতে চাই।
এষা: নিজেকে এক্সপ্রেস করলেই আর্টিস্ট হওয়া যায়?
সৌভিক: কিছুটা।
এষা: তাহলে তো হয়েই গেলো। নিজেকে এক্সপ্রেস করলেই যদি আর্টিস্ট হওয়া যায়, তাহলে তো ভালো আর্টিস্ট আর খারাপ আর্টিস্ট বলে কিছু হয় না।
সৌভিক: ভুল। ডিফারেন্স তো থেকেই যায়।
এষা: কেমন করে?
সৌভিক: ঋত্বিক ঘটক আর রাজ চক্রবর্তীর মধ্যে ডিফারেন্স নেই?
এষা: হা হা হা হা...
সৌভিক: আমি জানি, তোমার হাসিই, তোমার স্টেটমেন্ট। যদিও, সব সময়, ওই স্টেটমেন্টের মানে আমি বুঝি না। দাঁড়াও দাঁড়াও, বুঝেছি। আমি না হয়, ঋত্বিক ঘটক এর মতো গ্রেট নই, তাই বলে কি আমি কেউই নই? নো-বডি?
এষা: তা নয়। তবুও যে স্বীকার করলে, সেটা ভালো লাগলো।
সৌভিক: মানেটা কি? আমি গ্রেট না হলেই আমি নো-বডি?
এষা: নো-বডি নয়, তবে অর্ডিনারি।
সৌভিক: তুমি অর্ডিনারি হলেও হতে পারো। কিন্তু আমিও?
এষা: আমি তো আগেই বলেছি, যে আমি "আম জনতার" র একজন। কিন্তু আম জনতাও কি অর্ডিনারি? সীমিত ক্ষমতার অধিকারী, বলা যেতে পারে। অর্ডিনারি তারাই, যারা এক্সট্রাঅর্ডিনারি হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। এবার তুমি বলো, তুমি কি? সীমিত ক্ষমতার অধিকারী না অর্ডিনারি?
সৌভিক: আমি কিন্তু নিজেকে প্রমান করেছি। এই এজেন্সীটাকে শূন্য থেকে শুরু করেছিলাম। আজ, তার টার্ন ওভার ২ কোটি টাকা। আমার তিনটে ফিল্ম RAPA অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে।
এষা: সরি! আমার মনে হয়, এতো কিছু পাওয়ার পরেও, তুমি কিছু জিনিস বোঝোনি। কিছু জিনিস এর কোনো ক্ষমা হয় না। কিছু জিনিস করা যায় না। জাস্ট, করা যায় না। আর সেটা করে, ক্ষমা চাওয়ার কোনো জায়গাও থাকে না। তুমি আজ যেটা করলে, এটা এমনই একটা জিনিস।
সৌভিক: কে ঠিক করে দেবে, কোনটা করা যায় আর কোনটা করা যায় না?
এষা: বহুদিন আগেই মানুষ এগুলো ডিসাইড করে ফেলেছে। যেমন ধরো, কোনো মানুষকে তুমি মেরে ফেলতে পারো না। মার্ডার করে ক্ষমা চাওয়ার কোনো মানে হয় না।
সৌভিক: ওরকম কত কিছুই তো ঠিক করা হয়েছে। মিথ্যে কথা বলা যাবে না। তুমি মিথ্যে কথা বলোনি কোনোদিন? তুমি নিজেও তো কখনো কখনো অন্য কাউকে, এমন অবজ্ঞার চোখে দেখেছো। দেখোনি? যেমন ধরো, কাজের মেয়েটা যখন ঘর ঝাড়ু দিতে আসে, তখন তোমার মনে হয়নি যে তুমি ওর চেয়ে অনেক ভালো ঝাড়ু দিতে পারতে?
এষা: ভেবেছি হয়তো। যদি ভেবেও থাকি, আমি কখনো তাদের উপদেশ দিতে যাই নি।
সৌভিক: শুধু আমাকে উপদেশ দিতে ছাড়ো না!
এষা: তার কারণ, তুমি আমার নিজের। তুমি আমার ভালোবাসার।
সৌভিক: থ্যাঙ্কস।
এষা: সৌভিক...
সৌভিক: বলো!
এষা: কাউকে ঘৃণা না করে, নিজেকে ভালোবাসা যায় না?
সৌভিক: এষা, তুমি মানুষকে ভালোবাসতে জানো ল। কিছু লোক এটা পারে, কিছু লোক পারে না। এমন নয় যে, তাদের মধ্যে ভালোবাসার অনুভূতিটা নেই, তবুও তারা মন খুলে ভালোবাসতে পারে না।
এষা: যে প্রশ্নটা আমায় ভাবায়, সেটা হলো, আমরা অন্য লোকের সাথে অদ্ভুত ব্যবহার করছি জেনেও, আমরা এমন অদ্ভুত ব্যবহার করেই চলি। কিভাবে?
সৌভিক: আমরা আসলে, নিজেদেরকে কোনো প্রশ্ন করতে চাই না। আর, করলেও কোনো গ্যারান্টি নেই, যে আমরা উত্তরটা পাবো।
এষা: নিজেকে প্রশ্ন করাটা যে খুব দরকার, সৌভিক!
সৌভিক: তুমি যখন এসব বলতে শুরু করো, আমার মনে হয় আমি কোনো মন্দিরে বসে আছি, কোনো স্বপ্নের মধ্যে।
এষা: তোমার মুড আর খারাপ করতে চাই না।
সৌভিক: থ্যাঙ্কস।
এষা: আজ রাতে খিচুড়ি চলবে?
***
সৌভিক: কি পড়ছো, এতো মনোযোগ দিয়ে? দেখি! ওহ.. “ফাউস্ট”। সেই মানুষ যিনি কর্মক্ষেত্রে ভীষণ ভাবে সাকসেসফুল হওয়া সত্ত্বেও নিজের জীবন নিয়ে বড়োই অতৃপ্ত ছিলেন। মেফিস্টোফিলিস নামক শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বিক্রি করে দিলেন। কি অদ্ভুত সমাপতন আজ। এষা, তোমাকে কিছু বলতে চাই । জানি না, কেমন করে বলবো, কিন্তু বলতে আমাকে হবেই। প্লিজ, বইটা রাখো।
এষা: বলো।
সৌভিক: কাল দুপুর সাড়ে বারোটায়, আমি আমার আত্মাকে বিক্রি করতে যাচ্ছি। ঘুষ দিতে যাচ্ছি কাল। টাকা দিতে যাচ্ছি কোনো শয়তানকে। কথা বোলো না। শুধু শুনে যাও, প্লিজ। এন.এফ.ডি.সির মিঃ মেহরার সাথে আমার ডিল ফাইনাল হয়ে গেছে। আমি ওকে দশ লক্ষ টাকা দিচ্ছি। বদলে, ও আমার প্রজেক্টটাকে সিলেক্ট করবে, আর সত্যর প্রজেক্টকে রিজেক্ট করবে। আমি নিজের প্রতি বিরক্ত হয়ে গেছি, এষা তোমার সামনে ক্রমাগত ঘ্যানর ঘ্যানর করা থেকে, আমি মুক্তি পেতে চাই । একজন বিরক্তিকর মানুষ হওয়ার চেয়ে বরং ভিলেন হয়ে দেখি একবার। হারতে হারতে, আমি ক্লান্ত। যদি এই ফিল্মটা আমি বানাতে পারি তাহলে দেখবে, একটার পর একটা অফার আসতে থাকছে। প্যানোরামায় আর সত্যর ফিল্ম দেখানো হচ্ছে না, আমার ফিল্ম দেখানো হচ্ছে। আমিই হবো শেষ কথা। মেফিস্টোফিলিস নামের সেই শয়তান, আমাকে গ্যারান্টি দিয়েছে যে, আমার সব অনিশ্চয়তা, ও দূর করে দেবে। ওয়ানস এ্যান্ড ফর অল। কাল আমি যাবো। মিঃ মেহরা, আমার জন্য অপেক্ষা করবে একটা ফাইভ ষ্টার হোটেলে। ঝাঁ চকচকে হোটেল এর ঘরে ঢুকে, ভুলে যাবো বাইরের উত্তাপ। এয়ারকন্ডিশনারের গন্ধের মধ্যে আসবে ঠান্ডা বিয়ার। আমি একটা ব্রিফকেস এগিয়ে দেব ওর টেবিলে। টাকা ভর্তি ব্রিফকেস । তারপর? তারপর আমার আত্মাটা বিক্রি হয়ে যাবে। আমি বসে বসে দেখবো। দেখবো, কারণ, অনিশ্চয়তার ভয় আর আমার থাকবে না। শোনো এষা, এই সবকিছু বলতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি যদি শুধু এটা বলতে পারতাম, যে আমাদের ডিল ফাইনাল হয়ে গেছে, অনেক আরাম পেতাম আমি। কোনো কষ্ট হতো না। আমার কথা বলা শেষ। এবার তুমি বলতে পারো। এষা, বলো । কি হলো, বলো? কিছু বলবে না?
***
সৌভিক: সরি, সরি! তুমি যদি মনে করো যে, দিওয়ালি পার্টির কথা আমি ভুলে গেছি, তাহলে ভীষণ বড়ো ভুল করবে। তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টাও করেছিলাম। পারলাম না। দেখো, তোমার জন্য একটা বইও এনেছি। অমিতাভ ঘোষের “ফ্লাড অফ ফায়ার”। ট্রিলজির শেষ বইটা তুমি পড়োনি । ইয়ে, আরো একটা কথা।
এষা: কি?
সৌভিক: এন.এফ.ডি.সি, আমার ফিল্মটা রিজেক্ট করেছে। এক্সপেকটেড।
এষা: কেন চিন্তা করছো? স্ক্রিপ্টটা রাখো। এমনও তো হতে পারে, পরের বছর, এটা প্রডিউস করার জন্য, আমরা নিজেরাই টাকা জোগাড় করে ফেলতে পারবো।
সৌভিক: যেমন তুমি সব সময় বলো। আশা ছেড়ো না, লেগে থাকো...এটসেট্রা ...এটসেট্রা! এনি ওয়ে, নিশ্চয়ই ওরা একটা রদ্দি স্ক্রিপ্ট সিলেক্ট করেছে। তুমি এখনই প্রশ্ন করবে, আমি কেমন করে জানলাম। কোনো প্রমান না থাকলেও, জানি আমি।
এষা: আবার শুরু করলে!
সৌভিক: ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি এই নিয়ে, একটা কথাও আর বলবো না। খুশি?
এষা: তোমার হতাশা, রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক কিন্তু আমি খুশি।
সৌভিক: আমি যে এতটা নিচে নামতে পারবো না, সেটা তুমি জানতে। তাই না?
এষা: আমি সব সময় তোমাকে জ্ঞান দেই। তুমি বোধহয় আমাকে নিয়ে ফেড আপ হয়ে পড়ছো!
সৌভিক: হঠাৎ প্যান্টের মধ্যে একটা পিঁপড়ে ঢুকে গেলে যেমন অস্বস্তি বোধ হয়, আমার বিবেকের মধ্যে ঢুকে পরে তুমি ঐরকম একটা অস্বস্তি তৈরী করতে থাকো, সব সময়।
এষা: কি উপমা? এইরকম উপমা দিয়ে তুমি ফিল্মমেকার হবে?
সৌভিক: মুশকিলটা কি জানো? এর মধ্যে সত্য, আরো কয়েকটা ফিল্ম বানিয়ে ফেলবে। তার মধ্যে হয়তো একটা ভালোও হয়ে যেতে পারে। ব্যাস, তখন সব জায়গায় ওকে নিয়েই লেখা হতে থাকবে। আর আমি যেখানে ছিলাম, সেখানেই থেকে যাবো।
এষা: কতবার বলবো, ফরগেট সত্য!
সৌভিক: আমি সত্য বলতে কিন্তু শুধু সত্যকেই বোঝাচ্ছি না । সত্যর মতো যারা, তাদের সবার কথা বলছি।
এষা: ফরগেট অল সত্য’স।
সৌভিক: না এষা, তা নয়...
এষা: ছাড়ো এসব। এদিকে এসো। জানলা দিয়ে দেখো, দীপাবলির আলোর রোশনাই।
সৌভিক: এবারেও বাজি পোড়াবে না?
এষা: ভয় করে যে!
সৌভিক: কারণ, তুমি কখনো চেষ্টাই করোনি। একবার সাহস চলে এলে...
এষা: নিজেকে মধ্যমেধার মনে করে নিতে, খুব সাহসের প্রয়োজন, তাই না সৌভিক?
সৌভিক: হ্যাপি দিওয়ালি।
এষা: হ্যাপি দিওয়ালি।