সুমি দত্তগুপ্ত
আলোর রোশনাই, দীপান্বিতার অর্চনার পরিপ্রেক্ষিত, অনুষঙ্গ মনে করিয়ে দেয় আনন্দমঠ উপন্যাসের তরুণ সন্ন্যাসীদের দেশমাতৃকার বন্দনায়, আনন্দময়ী মাতা রূপে মা কালীর পূজা।
দীপাবলি আমাদের বাড়ির মেয়েটির নাম, সে মেয়ে বড় আত্মজন, সে মেয়ে অন্যায়কে মেনে নেয়না, যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করে জলপাইগুড়ির চা বাগানের মেয়েটি হয়ে ওঠে, আমাদের বড় আপনার।
ভ্রমরকেও অমল আলোয় দেখার কথা ভুলি কি করে? তাকেও যে খুব মনে পড়ে, দীপাবলির আতশ বাজির প্রদর্শনী সে দেখতে গিয়েছিল, চাঁদ মারির মাঠে, যেখানে “অন্ধকার আকাশের তলায় দেখতে দেখতে একটি আলোর ময়ূর ফুটে উঠল,অবিকল সেই রকম কন্ঠ,সেই পুচ্ছ। ...চারপাশে অফুরন্ত খুশীর গুঞ্জন ছিল, ক্রমশ: মাঠে রোল উঠলো। গলা ছেড়ে, হাততালি দিয়ে এই ময়ূরের বাজিকরকে সবাই বাহবা দিচ্ছিল। ততক্ষণে আকাশতলায় আবার অন্ধকারের যবনিকা ছড়িয়ে গেছে।” সেই অন্ধকারে ভ্রমরের হাত ধরেছিল অমল। যে স্পর্শে অপাপবিদ্ধ ভালোবাসা ছিল, ছিল ভরসা ও বিশ্বাসের আশ্বাস, যেখানে দুজন দুজনকে বলতে পারে, "আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা/ আমি যে পথ চিনি না।”
যদিও আমরা জানি আমাদের জীবনচক্রে সুখ, দুঃখের মতই অন্ধকার, আলো ও ক্রম পরিবর্তনশীল। তবুও আমাদের সচেষ্ট প্রয়াস থাকে, অন্ধকারের উৎস থেকে আলোর পথ অনুসন্ধান।
দীপাবলি আলোর উৎসব। দীপান্বিতার অর্চনায় তাই শুধুই আলোর সন্ধান। মন তাই গেয়ে ওঠে, "কালো মেয়ের পায়ের তলায়, দেখে যা আলোর নাচন।”
শরতের সবটুকু আলো নিভে গেলে, হেমন্তকে বড় উদাসীন, নিঃস্ব, রিক্ত লাগে। তাই আমরা আকাশ প্রদীপ জ্বালাই, পূর্বজদের আলো দেখাই। স্মরণ করি তাদের, All souls day, আর আকাশপ্রদীপ জ্বালানো সবকিছুই তো আসলে অতীতের আলোকিত পথে বর্তমানকে পথ দেখানো।
অসতো মা সতগময়,
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যর্মা অমৃতং গময়,
ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি।
অসত্য থেকে সত্যে, অন্ধকার থেকে জ্যোতিতে, মৃত্যু থেকে অমরত্বের এই যাত্রা উপনিষদ কাল থেকে বর্তমানে অব্যাহত।
দীপাবলির সাথে শুধু হিন্দুদের নয়, জৈন, বৌদ্ধ, শিখদের ও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
হিন্দুদের কাছে, কার্তিক অমাবস্যার যেদিন অযোধ্যাপতি শ্রী রামচন্দ্র চৌদ্দ বছরের বনবাস পর্ব শেষ করে, অযোধ্যায় ফিরে আসেন, সেদিন অযোধ্যবাসী ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে রামচন্দ্রের প্রত্যাবর্তনকে স্মরণীয় করে রাখতে দীপাবলি উৎসবের আয়োজন করেন।
জৈনদের বিশ্বাস, ৫২৭ খ্রি: পূ: এই কার্তিক অমাবস্যার দিনেই বর্ধমান মহাবীর নির্বাণ লাভ করেছিলেন।
বজ্রযানী বৌদ্ধরা এই দীপাবলিতে কার্তিক অমাবস্যার রাত আলো জ্বালিয়ে আলোকিত করে তোলেন চরাচর, পূজা করেন বসুধারার বা লক্ষ্মীর।
দীপাবলির রাতে অমৃতসর স্বর্ণ মন্দির চত্বরে অখণ্ড গ্রন্থসাহেব পাঠ, আতশবাজির প্রদর্শনেরও ইতিহাস আছে। বন্দী ছোড় দিবসের ইতিহাস। সম্রাট জাহাঙ্গীর দশম গুরু হরগোবিন্দ জী সহ ৫২ জন বন্দীকে কারাগার মুক্ত করেন এই দিনে এবং বন্দী ছোড় দিবসে মুক্ত বন্দীরা অমৃতসর শহরে এসে পৌঁছলেই শুরু হয় আলোর উৎসব, দেওয়ালি।
কিন্তু আজ আমাদের চারপাশটা নিকষ, কালো দুর্ভেদ্য অন্ধকার, মাঝে মাঝে নাগিনীরা নিঃশ্বাস ফেলছে, দম বন্ধ করা পরিবেশ। মুক্তি কোথায়? এই অজ্ঞানতার, অসত্যের, বিশ্বাসঘাতকতার, শোষণের, বঞ্চনার, ক্লীবতার অন্ধকার থেকে পরিত্রাণ কোন পথ ধরে আসবে, আমরা জানি না। তবুও বিশ্বাস রাখি, ”অন্ধকারের উৎস হতে, উৎসারিত আলোয়“ সেই আলোর উৎসরনেই বিশ্ব চরাচরের অন্ধকার মুক্তি ঘটবে, ঘুচবে মনের কালো।
প্রতিবেশী দেশে চলছে জুলাই মাস থেকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এক নিদারুণ নৈরাজ্যে, অস্থিরতায় বিপন্ন সেখানে জনসমাজ। আলোর দিশা দেখানোর জন্য নেই কোনও যোগ্য নেতা। চিন্তার দৈন্যতা, পরিকল্পনার অভাব, ধর্মান্ধতার উন্মত্ততা, অর্থনৈতিক বৈষম্যে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদে জনজীবন সেখানে বিপর্যস্ত।
অন্যদিকে শতাব্দী অতিক্রান্ত প্রায়, তবুও চলেছে গাজার লড়াই, যার শুরু ১৯৪৮ খ্রি: ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার জন্ম লগ্ন থেকে। একের পর এক আরব ইসরায়েল যুদ্ধ যার সমাধান সূত্র খুঁজে বার করতে অপারগ। মিশর, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডন, ইরাক সবাই এই রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব বহন করে চলেছে। গাজা এই সংঘাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যেখানে হামাসের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক,সামরিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে ইরান সামরিক,রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে গাজা, লেবানন এবং অন্যান্য অঞ্চলে, ইসরায়েল কে সামরিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন জুগিয়ে চলেছে। ভারতবর্ষ ইসরায়েল এর কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করলেও প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে কখনও অস্বীকার করেনি।
আজ মধ্যপ্রাচ্যের এই সমস্যা আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপান্তরিত। তার কারণ, মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর অবস্থানগত গুরুত্ব, এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মনৈতিক অবস্থান। যুদ্ধের ফলে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থার অভাব কারফিউ, অবিরত বোমারু বিমানের গোলা বর্ষণ,ধর পাকড়, বন্দী, হত্যা এই অঞ্চলের মানুষদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে, শান্তি নিরাপত্তা কে ধূলিস্যাৎ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই অচলাবস্থার স্থায়ী সমাধান সূত্র সন্ধানে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের এবং বৃহৎ শক্তিবর্গের অনীহা এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের শেষ কোথায়? অমানিশার অন্ধকার ভেদ করে কবে আসবে মুক্তির আলো,অন্তর্হিত হবে সকল কালো, এখনও এইসব প্রশ্নের উত্তর অধরা।
বিশ্ব সত্তা যখন এই ভাবে প্রতিদিন দলিত, মথিত, নিষ্পেষিত সেই বিশ্ব সত্তার ক্ষুদ্র অংশে আমরাও ভালো নেই। শরৎ আলোর কমলবনে আর উদ্ভাসিত হয় নি আমাদের মন। আমাদের শরীর, মন আজ ক্ষত বিক্ষত। নারী সত্তা সেখানে আজ বিপন্ন। আমাদের সারা বছরের অপেক্ষার আনন্দ আয়োজন সব বৃথা হয়ে গেছে তিলোত্তমার নির্মম, মরণ আলেখ্যে। আমরা ভাষাহীন, কিন্তু আমাদের দীর্ঘ জড়তা ক্লীব তার অবসান ঘটিয়ে, আমরা নেমে পড়েছি সিস্টেমের বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ে। অনেক না পাওয়া প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য,অনেক দুর্নীতি, অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য, অসুস্থ সমাজের প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করার জন্য, মানুষের ন্যূনতম চাহিদাগুলো পাওয়ার সোচ্চার দাবী তোলার জন্য। আমরা জানি আমাদের পথ বন্ধুর, লড়াই কঠিন। তবুও এই লড়াই আমাদের কাছে অস্তিত্ব রক্ষার, সম্মান পুনরুদ্ধারের লড়াই। আলোর পথ যাত্রীর আর থেমে থাকার উপায় নেই। আগুনকে জ্বালিয়ে রাখতে হবে, তবেই জ্বলবে আলো, সেই আলোয় হবে শুদ্ধিকরণ, আসবে মুক্তির পথ। ছুঁয়ে যাক আলো সব অন্ধকারকে।তাই আজ উচ্চারিত হোক,--
“আমার সময়, আমার স্বজন,
আমার স্বদেশ তোমায় খুঁজছে
ভীষণভাবে খুঁজছে,
ফিরে এসো আগুণ, ফিরে এসো, ফিরে এসো।”