আশ্চর্য খেলাটি ফুরোলে মাঠ তার দিগন্তের চুমুকে রেখে যায় ঘোড়ার ক্ষুরের নির্জনতা। শুকনো উঠোনে যেভাবে শুকিয়ে যায় জলের খড়িদাগ সেভাবেই একটু একটু করে কমে আসে রোদের তেজ। বেতস বনের ফাঁক দিয়ে মাথা নাড়ে ফুরুশ ফুলের দল। নিমগাছের ডালে পাক খায় একটা অচেনা হাওয়া। এ হাওয়ায় দুপুর নিশ্চিহ্ন করে নির্জনতা লাফ দেয় সাবেকী গলির বুকে। পুরোনো চুড়িওয়ালার ডাক ফিকে হয়ে গেলে গমের দানার মতো পাশাপাশি শুয়ে থাকে শূন্য ও অমল বালক। শরীরের নিভৃত শরীর যাকে থেকে থেকে বিভ্রান্ত করে এইসব আচ্ছন্ন দুপুরের ভেতর। মরা রোদ পড়ে থাকে দীর্ঘ ছায়ায়।
হেমন্তে কেটে ফেলা ধান উঠোনের একপাশে রাখা থাকে। বিকেল ফুরিয়ে যায় এভাবেই রূপকথা গল্পের মতো।তারপর তুলসী তলায় মিটিমিটি প্রদীপের আলো। কুয়াশা জড়িয়ে ফেলে কুয়োতলা। গোয়াল ঘরের ভেতর থেকে উঠে আসে উনোনের ধোঁয়া। পোয়াতি গৌরী তার চোখদুটো অলস আঁধারে খুলে রাখে। ওপাশে ধবলী বসে মৃদু মৃদু জাবর কাটতে থাকে। বিচুলি কেটে হরমতী জড়ো করে রেখে গেছে একপাশ দিয়ে। গোয়ালের চালা ফুঁড়ে মিহি মিহি কুয়াশা ছড়িয়ে যায়। কুয়াশা ছড়িয়ে যায় বুকের ভেতর।
জানলার গরাদ ডিঙিয়ে যায় চোখ। সেই চোখে শীতের লাজুক পাতা পরিয়ে দেয় কৃষ্ণকাজল। শ্রীখোলের কলবর ছুটে যায় মেঠো পথ ভেঙে। ধানক্ষেত আড়াল করে আলপথের মেরুদন্ড। অথচ আশ্চর্য কুয়াশা ভেঙে আকাশের জেগে ওঠে ফটফটে চাঁদ। শেয়ালের বাসাগুলো দ্যাখা যায় খালপাড় দিয়ে গেলে। ফটফটে জ্যোৎস্না মেখে শেয়ালের দল ডেকে ওঠে। মুচিপাড়া ভেসে যায়, ভেসে যায় নিত্যচরণের ভিটে। ঘোড়ানিমের ডালে বসে রাতচরা পাখিগুলো একটানা ডেকে যেতে যেতে উড়ে যায় আসমানি চরের দিকে।
খালপাড় বাঁক নিয়ে নাক বরাবর চলে গেছে যে সরু পায়ে হাঁটা পথ, তার কিছু দূর হেঁটে গেলে শুরু হয় বালুপথ। তারপর আসমানি চর। কাছেপিঠে অনেক পুরোনো একটা জিন্দা পীরের মাজার জেগে আছে বহু বছর ধরে। সেটাকে ঘিরে বনচাঁড়ালের ঝোপ অলিখিত সীমানা ফেলেছে। চাঁদের আলো বান ডাকলে মাজারের চারপাশ ঝকঝক করে। এমনই কোনো এক শীতের সন্ধ্যায় বিকেলের আলো নিভে গেলে আসমানি চরের দিকে যেতে গিয়ে পোয়াতি খাদিজা বিবি নাকি কোনো এক জোব্বাপরা পীরকে দেখেছিল মেঘের মতো ভেসে যেতে এই মাজার থেকে সামান্য দূরে। ঐ ঘন কালো আকাশের দিকে কুয়াশার মতো। সেই থেকে লোকজন মাঝে মাঝে মাজার আসে। চাদর চড়ায়। মাটির ঘোড়া আর মোমবাতি জ্বেলে প্রার্থনা করে। দীর্ঘ অশ্বথের ডালে সুতো বেঁধে যায়।অন্ধ ফকির একতারা পাশে রেখে জিরিয়ে নেয়। চরের দিক থেকে হাওয়া ওঠে অন্ধকার হাওয়া, শনশন অস্থির হাওয়ায় মতি সেখের ডিঙি জ্যোৎস্নায় ভিজে গিয়ে ছটফট করে।
খুব ভোরে মাথার দিকের জানলা খুললে যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত সুপুরি বনের সারিকে জড়িয়ে রাখে কোনো এক প্রাচীন কুয়াশার আস্তরণ। সুপুরির পাতা চুঁইয়ে টুপটাপ শিশির পড়ার শব্দের ভেতর জড়িয়ে আসে ভোর রাতের ঘন হয়ে আসা ঘুমটুকু। কুঁয়োতলায় বালতি পড়বার ছলাৎ শব্দটা অন্ধকার কুয়োর পেটে জেগে উঠে কুয়োর ভেতরেই হারিয়ে যায়। যেভাবে শুশুক ঘোলা জলে মাথা তোলে কিংবা পানকৌড়ি। তারপর হারিয়ে যায় স্রোতের ভেতর। মৃদু কেঁপে ওঠে জল। জলজ বৃত্তগুলো ছোটো থেকে ক্রমে বড় হতে হতে একসময় মিশে যায় চোখের পলকে। পাঁচিলের ওপরে বীরদর্পে ডেকে ওঠে একটা মোরগ। কাছের বড় রাস্তা দিয়ে একটা দুটো করে গাড়ি আওয়াজ তুলে চলে যায় শহরের দিকে। রাস্তার ওপাশে সনাতন ঘরামীর বউ উনোনের পেটে আঁচ দ্যায়। সেই চোখ জ্বালা করা ধোঁয়া চারপাশের ফিকে কুয়াশাটাকে ভারী করে তোলে। হেমন্ত ফুরিয়ে এলেই জানলা ডিঙিয়ে গিয়ে এইসব অশরীরী কুয়াশার ঝাঁক খুব সন্তর্পণে ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতর। শীত করে খুব শীত করে!
সূর্যাভ বিশ্বাস! আপনি অলৌকিক এক জাদুকর! শব্দের অবরোহে কিভাবে নামিয়ে আনতে হয় শেষ বিকেলের আবছায়া, নিভন্ত দুপুর, কেউ-নেই সকাল, ছায়ার সঙ্গে দোস্তির রাত...আপনি জানেন। আর জানেন বলেই হৃদয়ের আনাচেকানাচে এমন সব পালক ফেলে রেখে যান, যে পাখিদের উড়ানের গল্পে ফেলে আসা সময় আজও বিশুদ্ধ বিষাদ রাগিণীর ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে চলে...চলতেই থাকে...বড় প্রিয় এই দুঃখবিলাস!
উত্তরমুছুন