দোঁহা

মাঝরাত, সিম‌্ফনি – হাত ছুঁয়ে দেখা

 



অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

[১]

সামনের ভদ্রলোক অনেকক্ষণ ধরেই উশখুশ করছিলেন। এদিকে মঞ্চে শিল্পী একাগ্র মনে গেয়ে চলেছেন। এক অদ্ভুৎ মিষ্টতা। এরপর ভদ্রলোক প্রায় উঠেই দাঁড়ালেন এবার। পাশ থেকে তাঁর স্ত্রী কড়া চোখে তাঁর দিকে তাকান।

-“উঠলে যে?”
-“নাহ! পারা যাচ্ছে না।”

আশেপাশের কয়েকজন ফিরে তাকিয়েছেন। গান চলছে। অধিকাংশেরই ভালো লাগছে। ভদ্রলোক ফিসফিস করে বলে ওঠেন এবার, “ঘড়িতে কটা বাজে দেখেছো?” ভদ্রমহিলা হাতঘড়ির দিকে তাকান। “সাতটা, কেন?”

-“সন্ধ্যে সাতটার সময় কিনা মালকৌঁষ গাইছে! একটা সিলেকশন নেই রাগের? মালকৌঁষ কখন গাইতে হয় জানে না?”

ভদ্রমহিলা ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। বেশ কয়েক মুহূর্ত যায়। তারপর,

-“চুপটি করে বসে গান শুনবে একদম। পাকামি করেছ কি সোজা উঠিয়ে নিয়ে গাড়ি করে বাড়ি চলে যাব!” তেহাইতে ছোট একটি তান পড়ল।

আশেপাশের কয়েকজন যাঁরা গানের বাইরেও আরও কিছু শুনছিলেন, মুখে তাঁদের মৃদু হাসির রোদ। ভদ্রলোক কাঁচুমাচু মুখে আবারও গান শোনায় মন দিলেন। জলসায় তো গানের বাইরেও আরও কিছুর সন্ধান মেলে। সঙ্গীতের সৃষ্টি যে মানুষে মানুষে মিলনের প্রয়োজনেই।

[২]

আদতে এই বর্ণনাগুলো চকচকে বার্ণিশ করা কাঠের পিয়ানোর মতো। গম্ভীর এক রঙ। অভিজাত এক অনুভূতি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জলসায় পাশাপাশি বসে থাকতে থাকতে কখন যে হাত নেড়ে তাল ঠুকতে ঠুকতে পাশের মানুষটির সঙ্গে নতুন আলাপের সমে এসে মিলবেন, আগে থাকতে ঠাহর করা চলে না। রাত জেগে কিছুদিন আগেই জলসা শুনেছিলাম। পাশের ভদ্রমহিলা তাঁর মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন। সঙ্গে মেয়েটির আরেক বন্ধু। সেদিন সারা রাতের অনুষ্ঠান ছিল। মাঝরাত পেরিয়ে শুভা মুদগলের গান। রাগ ছায়ানট। চারদিক ঢাকা শামিয়ানা। কাজেই রাত নামলেও বাতাসে হিমের ভাব বোঝা যাচ্ছে না। ভদ্রমহিলা একবার বাইরে উঠে গেলেন। ইঙ্গিতে বলে গেলেন, এখুনি ফিরে আসছি। পরের বার উঠে যাবার সময় নিজেই জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি গান করেন, নাকি বাজান?” বললাম, “কোনওটিই নয়। স্রেফ শোনার টানে আসা।” অল্প হাসলেন। বললেন, “আমার মেয়ে বেহালা শিখছে। আপনার জন্য চা বা কফি কিছু নিয়ে আসব কি?” আমি মাথা নেড়ে বারণ করলাম। কিন্তু আলাপ জমে গিয়েছে।

আমার মনে পড়ছিল স্কুলজীবনের চার বছর। তখন বেহালা শিখেছিলাম। তারপর গঙ্গা দিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক। বেহালাটা ঘরের এককোণে অবহেলায়। ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, “ছাড়লেন কেন? এ জিনিস কখনও ছাড়তে নেই।” একটু থেমে বললেন, “আবার শুরু করুন।” ঠিক সেসময়ই ওঁর মেয়েটি হঠাৎ তার বন্ধুর সঙ্গে হইহই করতে করতে আবারও কোথাও থেকে ফিরে এসে পৌঁছল। তন্দ্রা কাটাতে তারা একটু হেঁটে আসতে গিয়েছিল কোথাও। “সামনে অনেক জায়গা! সামনে অনেক জায়গা!” দুজনেই কলকল করে বলে ওঠে। “দূর! তোরা আবার তাতে লাফাচ্ছিস কেন। ওগুলো তো আলাদা। রিজার্ভড সিট!” ভদ্রমহিলা জবাব দেন।

-“আহ,” ছেলেটি বলে ওঠে এবার, “কাকিমা, এত রাতে ওগুলোতে আর কেউ আসবে না এখন। যে কেউ গিয়ে বসতে পারে। আমার চেনা দাদা-দিদিরাই রয়েছে। কোনও অসুবিধে নেই। প্রচুর সিট ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।” আমি এদিকে সবটাই শুনছিলাম। কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া দিইনি। অবশেষে নিমরাজি হয়ে ভদ্রমহিলা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান, “বড় জ্বালাস তোরা! আচ্ছা চল,” পরক্ষণেই তিনি আমার দিকে ঘুরে তাকান, “চলুন, আপনিও।” “আমি?” অবাক হয়ে আর কিছু বলার আগেই ভদ্রমহিলা বিষয়টা সহজ করে দেন, “বলছে তো অনেক সিট। চলুন তো!” এদিকে আর অল্প কিছু সময় পরেই মঞ্চে রাকেশ চৌরাসিয়ার অনুষ্ঠান। রাত বাড়ছে।

আমরা চকিত পায়ে সামনে এগিয়ে যাই।

[৩]

রাত কাটছে।

ঘড়িতে তখন পৌনে চারটে প্রায়। পাহাড়িতে ধুন বেজে চলেছে। হাতের বড় আড়বাঁশিটাকে নামিয়ে চৌরাসিয়া প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দৈর্ঘ্যের একটি ছোট বাঁশিকে ঠোঁটে তুলে নিলেন। তারপরেই সেই জাদুকরি সুরের মূর্ছনা। শামিয়ানা জুড়ে যেন অজস্র পাখির ডাক। এ সুর ভোরের আবাহনী সুর। পাখিরা জেগে উঠছে। স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। বাজনা শেষ হতে বাইরে এসে দেখলাম আকাশ ফরসা হয়ে আসতে শুরু করেছে। বাতাসে শীতভাব স্পষ্ট বোঝা যায়। শিশিরে ভেজা ঘাসজমি পেরিয়ে আমরা তখন চায়ের সন্ধানে গেলাম। শীতের জলসা আমাদের ভোর হতে দেখার সুযোগ করে দেয়।

[৪]

তাঁকে একেবারেই বৃদ্ধ বলা সাজে না। প্রৌঢ়ই বলি বরং। গানের প্রতি ভালোবাসা, আর সেই সঙ্গীতেরই প্রয়োজনে পরিশ্রমের ক্ষমতায় অনেক কিশোর-যুবক-তরুণকেও বোধকরি তিনি এই বয়সেও অনায়াসে পিছনে ফেলতে পারেন। তাই মঞ্চে গাইতে বসেই অকপট ঘোষণা তাঁর, “এই সম্মেলনে আমি আপনাদের সামনে মন খুলে গান গাইতে পারি। এখানে আমায় গড়পড়তা রাগের গণ্ডিতে বেঁধে রাখে না কেউ। আসুন মালগুঞ্জি দিয়ে শুরু করা যাক!” প্রাচীন এক বন্দিশ বেছে নিলেন। আলাপ থেকে বিলম্বিত। জোড়। একেকটিবার করে সমে ফিরে আসা। গতির রকমফের রয়েছে। ব্যস্ততা নেই কোথাও। তিনি যেন আক্ষরিক অর্থেই সুর বুনে চলেছেন। স্পষ্ট একেকটি স্বর। পাশে বসে থাকা লোকটিকে এই সময় লক্ষ্য করছিলাম।

মাঝবয়সী অফিসকর্মী ধরণের চেহারা। পায়ের উপরে একটা ভারী পিঠের ব্যাগ। তন্ময় হয়ে গান শুনে চলেছেন। এমন ছবি এর আগে দেখেছি। এক উস্তাদের ব্যবহৃত সেতারটি বাক্সবন্দি অবস্থায় যখন বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, গুণমুগ্ধ ভক্ত এক – উস্তাদজির পায়ের নাগাল না পেয়ে, শেষমেশ সেই সেতারের বাক্সটিকেই হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করে কপালে হাত ঠেকান। সরাসরি যেন উস্তাদ-সৃষ্ট সঙ্গীতের কাছ থেকেই চেয়ে নেওয়া ওইটুকু স্পর্শ-আশীর্বাদ। এদিকে মঞ্চে আমাদের পণ্ডিতজি মালগুঞ্জি গেয়ে চলেছেন। পাশের ভদ্রলোককে লক্ষ্য করতে থাকি। তিনি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন হঠাৎ। মাটির কাছাকাছি তাঁর হাত। তাঁর চেয়ারের ঠিক সামনেই শামিয়ানার একটি বাঁশ পোঁতা হয়েছে। মাটির ঝুরো অংশ সেখানটায়। লোকটি হাত মুঠি করে খানিকটা ঝুরো মাটি তুলে নিলেন। ছোট এক টুকরো কাগজে মুড়িয়ে সেই মাটিটুকুই তিনি সযত্নে বুক পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। আমি চোখ বুজে নিলাম। তখন তারানার উচ্চকিত স্বর।

[৫]

বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওপারে জন্ম তার। পরিবার-পরিজন এখনও ওদেশেই। সে নিজেও প্রতিবেশী দেশেরই নাগরিক। এদেশে ছুটে আসা কেবল গানের টান থেকেই। গান নিয়েই তার চর্চা, পড়াশোনা। শেষমেশ এদেশে থেকেই তার সঙ্গীত বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সিদ্ধান্ত। বহুকাল বাদে এই জলসায় দেখা হতেই উচ্ছসিত স্বরে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, “শুনলি ভাই অমুকের অনুষ্ঠান? গায়ে যেন কাঁটা দিচ্ছিল না? বল?” আমি জবাব দিতে পারি না। কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, “বাড়ির খবর?”

সে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। “এই দেশ দেখতে হবে কখনও ভাবিনি রে, নেহাত আমরা অনেকদিনের বাসিন্দা। নয়তো ওখানে আমাদের বাঁচা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশকে ফোন করলেও পুলিশ আসছে না। কোনওদিন আমাদেরও যে আলাদা করে ওই এলাকায়, সংখ্যালঘু পরিচয়ে বাঁচতে হবে …” সে আর কিছু বলতে পারে না।

“দেশে ফেরা?” আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
-“না রে। না আমি ফিরতে পারব এখন, না আমি আমার বাবা-মাকে নিয়ে আসতে পারব,” সে আমার হাতদুটো চেপে ধরে, “এই বাংলাদেশ আমরা দেখব ভেবেছিলাম?” তার গলা কাঁপছে। গান শুরু গেছে আবার।

শীতভাব কেবলই বেড়ে চলতে থাকে। কোন সঙ্গীতে এই বিভাজনের হানাহানি থামবে? আমাদের কাছে উত্তর নেই কোথাও। শিল্পী বেছে নিয়েছেন মারোয়ার সুর। সরোদের বোলে গভীর একেকটি স্বর। গাঢ় বিষাদ নেমে আসতে শুরু করেছে। অস্ফূটে উচ্চারণ করতে চেষ্টা করি, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।”

আর সুর শোনা যায় না। সহসা তার ছিঁড়ে গিয়েছে।
বাজনদার তাঁর বাজনা থামিয়েছেন। এ তার বেঁধে নিতে এখন, সময় লাগবে তাঁর . .

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন