শতাব্দী চক্রবর্তী
রেখেছিলাম মেঘের ভেতর আস্তানা। মুখ ঢেকে যায় যেখানে কুয়াশা আর সবুজে সবুজে সেই কোটাগিরি কুন্নুর পেরিয়ে পেরিয়ে টয় ট্রেনের ভেতর থেকে দেখতে দেখতে রেখে এসে ছিলাম অনন্ত খোঁজাকে। দৃশ্যের ভেতরে গড়ে উঠেছিল একান্ত ব্যক্তিগত রাজপ্রাসাদ। রূপকথা লিখে চলে ছিলাম নিজের মতো করে। ঐ যে সবুজ বুনো গাছ ঐ তো সেই গাছের মাথায় জলসা বসিয়েছে পাতলা উড়ো মেঘ। সেই মেঘের ভেতর থেকে ছুটে আসছে পক্ষীরাজ আর তার ওপর টগবগে এক রাজপুত্র। কোমরবন্ধ নেই, তলোয়ার নেই, পালক শোভিত মুকুট নেই, হীরের অঙ্গুরীয় নেই, আছে শুধু স্নিগ্ধ দুটি চোখ। তার ঠোঁটের অন্তরে যেন অনেক গোপন কথা জমানো আছে। হাতে তার কবিতার বই। এ কি দেখলাম এমন এক চাতুর্যময় জগতে এক প্রেমিক এগিয়ে আসছে যার হাতে যুদ্ধাস্ত্রের বদলে কবিতার বই! প্রেম নিবেদন করতে যে কবিতার ভেতর বেড়ে উঠেছে। পলান্ন সে চায় না।, নারী মাংস সে তো খুবলে খেতে চায় না। অভিসারের আয়োজন করে চলেছে সেই কৈশোর থেকেই। এমন রাজকুমারকে দেখে ভয় হয় না, আড়ষ্ট লাগে না, লজ্জা আসে না। ফুলের মতো নরম আর আপন মনে হয়। এমনই এক রাজকুমারের হাতের মুঠোয় আমার সুডৌল শরীরখানি আপনা থেকেই যেন প্রবেশ করেই আছে সেই ছোটো বয়সেই গল্প কাহিনী শুনতে শুনতে।
আমি রূপকথার বই পড়িনি কখনো। কিনে দেয়নি কেউ। শুধু গণেশ নামক একটি বাচ্চা হাতির সাথে সাথে মাঝেমধ্যেই রাজপুত্তুর, কোটালপুত্তুর আর রাজকুমারীর গল্প বলতো পাশের বাড়ির বড় পিসি। পাশের কথাটা ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য বলা হলেও সে তো আসলে বুকের ভিতর বাস করতো আমার। তারপর সেই রাজপুত্রদের রাজকুমারীর সাথে পরিণয়ের গল্প, প্রেমের গল্প আর রাজকুমারীকে জয়ের জন্য কত যুদ্ধই না জিততে হতো রাজপুত্রকে। সেই কাহিনীর ভেতর থেকে স্বপ্ন দেখতে দেখতে বাস্তবেও খুঁজেছি অমন কোনো রাজার ছেলেকে। নাহ্ কেউ নদী পেরিয়ে আসেনি বীর বিক্রমে!
কতবার সাইকেল না জানা মেয়েটির হেঁটে হেঁটে স্কুল যাওয়ার পথে, দ্রুত চলনের জন্য পায়ের পেশিতে খিচ ধরে পড়ে যাওয়া অবস্থা থেকে কোনো রাজপুত্র তো ঘোড়া নিয়ে হাজির হয়নি। বলেনি আর কোনো কষ্ট হবে না তোমার এই তো এসেছি। চলো ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে দিয়ে আসি তোমার গন্তব্যে। আনমনা হাঁটতে হাঁটতে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ায় গায়ের ধুলো ঝেড়ে হাত ধরে উঠিয়ে দিতে তো কোনো রাজপুত্র আসেনি! একলাই লজ্জামাখা চোখে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ঝটপট উঠে পড়েছি ব্যথার শরীরে। হ্যাঁ পড়ে যাওয়া, হোঁচট খাওয়া, কনুই হাঁটুতে ক্ষত জমা করা আমার কিশোরীবেলার একটি সংকটের মতো উপস্থিত হতো যখন তখন। দুটো বাড়ানো হাতের অপেক্ষা করেছি বহুবার।
নাহ্ কখনো দুষ্টু চোখের ছেলে ছোকরাদের সিটি মারা বন্ধ করতে তো রাজপুত্র কোটালপুত্রকে পাঠিয়ে শায়েস্তা করে যায়নি। কেন আসেনা অমন কেউ এই ভাবতে ভাবতে তাকে মাধব ভেবেছি, তাকে মধুসূদন ভেবেছি তবুও রক্ষা হয়নি রক্ত ঝরেছে শুধু। কেনো কখনো আসোনি যখন নপুংসকগুলি ভিড়ের সুযোগ নিয়ে চলন্ত বাসে শক্ত পেশিটি নিয়ে অস্বস্তিকর একটি খেলা খেলত! যার বেদনায় লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠতো কান গাল, টপটপ করে জল আসতো অব্যক্ত দুটি চোখে। অনড় দুটি পায়ের নিদারুণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে অবস্থান এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু নিরূপায় হায়! রাজপুত্র, কেনো তখন তোমার তলোয়ার উঁচিয়ে বধ করোনি অসভ্য লিঙ্গটিকে। উদ্ধার চেয়েছি কত, বিষ্ণুকে ভাবিনি ভেবেছিলাম তোমাকেই। ভুল ঠাওরেছি এতদিন। বড় পিসির কথা মিথ্যা করে দিয়েছ তুমি হায়!
কিন্তু এই যে দুরন্ত যৌবনের অনেকখানি পেরিয়ে এসে মেঘের ভেতর থেকে যে এক রাজপুত্রকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম তা কি আমার ভুল। চারটি ফুটিয়ে খাওয়া আর জাগতিক কাজকর্মের চিন্তার বাইরে যাকে এতকাল ভুলে ছিলাম, সংসারের ভাত মাছ ডালের ভেতরে তাকে এতোদিন ভাবিনি কেন! উত্তর জানা নেই। হয়তো লজ্জায়, হয়তো দায়িত্বে, হয়তো বা উদাসীনতায়, হয়তো বা অলীক ভেবে এতোদিন তার উপর থেকে সমস্ত টান কেটে যাওয়া ঘুড়ির মতো গোত্তা খেতে খেতে স্বপ্নের সুতো থেকে ছিন্ন হয়ে গেছে। দোষের মধ্যে কেবল তাকে ডাকিনীবিদ্যাতেও কোনো দিন ডেকে আনিনি আমার জন্য আর। তবুও যেন মাঝে মাঝে তার মুকুটের চুনিটা জ্বলে উঠেছে কয়েকবার, যা দুঃস্বপ্ন ভেবে উড়িয়ে দিয়েছি প্রভাতের আলোয়।
আলেয়া তো কত আসে, সব তো সত্য হয় না। আগুনের লেলিহানের ভেতর সব স্বপ্নকে সব রূপকথাকে আহুতি দিয়ে প্রবেশ করতে হয় নতুন জীবনে। জুড়তে হয় একটা সংসার আর একটি সহচরের সাথে। আপেল খেতে খেতে কামনা মিটিয়ে সব ভুলে যেতে হয়। কোনো স্বপ্ন আসে না আর। ঘরে ভ্রমর খেলা করে। মেয়েদের সেই ভ্রমরের সাথেই গুঞ্জন, ভ্রমণ, রমণ করতে করতে বৈতরণী পার করতে হয়। এই বেশ সুখের জীবন যেই ভাবলাম অমনি সেখান থেকে রাজপুত্রদের প্রবেশপথ রুদ্ধ হয়ে যায়। আর অবোধ বালিকারা সেজে ওঠে পারদর্শী জননী ও জায়া স্বরূপ। বর্ণে ছন্দে এক ঘেঁয়ে জীবনের মাঝে কবিরা হঠাৎ কাব্যি করে ঢুকে পড়তেই আজ যেন আবার রূপোকথার আলোড়নে আলোকিত হয়ে উঠলো মন।
দীর্ঘদিন ধরে দীর্ঘ পথ চলার মধ্যে যাকে একটি দিনও অনুভব করিনি আজ ভ্রমণের ভেতর তার সাথে দু-দণ্ড বসবার সাধ হয়। যেমন জীবনানন্দ বসেছিলেন নাটোরের বনলতার সাথে। অন্ধকারে কুহকে মুড়ে দিতে চেয়েছিলেন শুধু একাকী নির্জনে বসে তার মুখের সমস্ত কারুকার্য দেখবেন বলে। তেমনটিই এই টয় ট্রেনের চেয়ারে মুখোমুখি বসবার সাধ জাগে রাজার কুমার। মুখোমুখি জীবনানন্দ, শক্তি, মণীন্দ্র গুপ্তকে পড়ব। পড়তে পড়তে ধোঁয়ার মধ্যে, ট্রেনের গুহার অন্ধকারের মধ্যে ভ্যানিস হয়ে যাব পি. সি সরকারের মন্ত্রে।
যাক এতদিন পরে তোমার দেখা পেলাম। তোমাকে লেখা চিঠিগুলো হারিয়ে ফেলেছি। ডাকবাক্স উঠে গেছে ব্যক্তিগত চিঠির জন্য। ঐ তো তুমি সাদা ঘোড়ায় চেপে কেমন কবিতা পড়তে পড়তে আসছো এই বেশ অনুপম। হাতে তোমার তলোয়ার নেই, মাথায় তোমার মুকুট নেই, গায়ে তোমার রাজবেশ নেই যে কেউ দেখে বলবে এ তো কোনো রাজার ছেলে হতেই পারে না কোনো এলোমেলো যুবক পরাহত হয়েছে কোনো বীরের কাছে। ছন্নছাড়া, ঘরছাড়াও হতে পারে।
কোথায় সেই ঐশ্বর্য কোথায় সেই পরাক্রমশালী মেজাজ শুধু ঋণ করে একটি শ্বেত অশ্বে চড়ে এসে বীর্য দেখাতে উন্মুখ। আমি বলবো না কিছুই, যারা বলছে তাদের বলতে দাও। সব প্রতিবাদ ভাষায় হয় না। আমি জানি আমার রাজপুত্র এই বাংলা ভাষার কাছে কতখানি লুটিয়ে পড়া বীর। আমি জানি ঐ যে দূরের চা বাগান থেকে, কুয়াশায় মোড়া জংলি সবুজের ভেতর থেকে কবিতার জন্য ছুটে আসছে যেই এলোমেলো যুবক তার বাগদত্তা আমি বসে আছি আংটি বদল করে। পাগল না হলে, এলোমেলো না হলে বাংলা ভাষায় কাব্য লেখা যায় না। হারিয়ে যায় যা কিছু হরিণের নাভির ভেতর আমরা তাকে তুলে আনব অমৃত কলসে ভরে ভরে। ঘোড়াটা কেবল আমার কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম মাত্র, সে আমি জানি রাজপুত্তুর। প্রেম নিবেদনের জন্য কবিতা ছেড়ে তলোয়ার উঁচিয়েছে কে কবে?
দৃশ্য বদলে যেতে থাকে, ধোঁয়ার রেণুগুলো আকাশে মিশে যেতে থাকে আর আমি দেখতে থাকি কুয়াশার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে মেঘের একটি ঘোড়া যার ওপর চড়ে আছে আড়ম্বরহীন বাংলা কবিতার রাজপুত্র। আমি তার চলে যাওয়া দেখি, আমি তার স্থাপত্য শৈলী দেখি বাংলা কবিতার পাতায় পাতায়। তাকে পড়ি ফিরে ফিরে। যে রেখে গেছে বাস্তবের যোনিপথে এক রূপকথার রাজকন্যাকে।