শুভজিত চ্যাটার্জী
সালটা ২০০৪! দিনটা ১২ জানুয়ারি। স্থান গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের বিবেকানন্দ হল। তার আগের বছর মফস্বল থেকে কলকাতায় পড়তে আসা এক শাস্ত্রীয় সংগীতের পাগল শ্রোতার সেই প্রথম দক্ষিণী, SRA, ডোভার লেনে রাত জাগার প্রথম শীত।
১২ জানুয়ারি গোলপার্কের সান্ধ্য অধিবেশনে প্রথমে উস্তাদ রশিদ খান, সঙ্গে পণ্ডিত আনন্দগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় , জ্যোতি গোহ।
তাঁরা যখন শেষ করলেন, মন একেবারে সম্মোহিত!
কিন্তু তারপর যে মঞ্চে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া!! আর তাঁর সঙ্গে? মধ্য তিরিশের এক সুঠাম যুবক আর তার দু’টি জাদু হাত - পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
ক্লাস ইলেভেনে ভাইফোঁটায় প্রিয়তম মাসতুতো দিদি একটা ক্যাসেট উপহার দিয়েছিল - "Sound of Silence"!
না, এটা Simon and Garfunkel-এর সেই কালজয়ী গান নয়। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার তত্ত্বাবধানে তাঁরই শ্রেষ্ঠ ছাত্র, ভ্রাতুষ্পুত্র রাকেশজির এক অসামান্য অ্যালবাম রাগ মারওয়া আর কিরওয়ানির। কিন্তু ক্যাসেটটা বার বার শুনে আমার কানে রাকেশজির বাজনা ছাপিয়ে মনে গেঁথে গেল সঙ্গতের তবলা! ছোট থেকে অনেক রেকর্ড ক্যাসেটে অনেক দিকপালদের বাজনা শুনেছি, তাদের সঙ্গে অনেক মহারথীর সঙ্গত শুনেছি, কিন্তু এই অ্যালবামটায় এক অদ্ভুত তবলা সঙ্গত শুনলাম। কে বাজালেন? ক্যাসেটের পিছনে খুব ছোট অক্ষরে লেখা… পড়ে প্রথম জানলাম নামটি - পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর Walkman-এ ওই ক্যাসেটটা কত সহস্রবার শুনেছি, সেটা মনে করা দুষ্কর। প্রতিটা কঠিন অঙ্ক সমাধান করেছি ওই ক্যাসেটটা চালিয়ে, প্রতিটা রাতে সেই মিষ্টি মেয়েটার মুখ মনে করে ঘুমাতে গেছি - কানে বেজেছেন রাকেশজি আর শুভঙ্করজির Sound of Silence!
প্রতিবার তবলা নিয়ে বসে ভেবেছি আমারই মতো আরেকজন রক্ত মাংসের মানুষের হাত থেকে ওরকম ঠেকা কীভাবে বেরোয়…! ছোট থেকে ভগবান মেনে আসা জাকিরজিকে বললাম, ‘ক্ষমা করবেন - আমি এই জীবনের জন্য অন্য ঠাকুর বেছে নিলাম। এবার তিনিই পথ দেখাবেন।‘
তো স্বামীজির জন্মদিনের সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে, তাঁরই নামাঙ্কিত হলে, জীবনে প্রথমবার হলো আমার নতুন ভগবান দর্শন। আর তাঁকে সঙ্গে নিয়ে হরিজি বের হলেন এক পরম আধ্যাত্মিক আনন্দ সফরে, সে এক অজানা অচেনা কঠিন সফর! সফর সঙ্গী বাগেশ্রী, তারপর হংসধ্বনি, তারপর ভাটিয়ালি, তারপর পাহাড়ি, শেষে আমাদের বাংলার কীর্তন। সঙ্গে শুভঙ্করের সাড়ে ন-মাত্রা, তিনতাল, একতাল, দাদরা।
দুই অসম বয়সী বন্ধু - একজন কিংবদন্তী আর আরেকজন তাঁরই পুত্রসম, সেই সময় মহামানব হয়ে ওঠার পথে একদম প্রথম সারিতে- দু’জনে দেখালেন পারস্পরিক শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালবাসার সর্বোচ্চ নিদর্শন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সঠিক প্রথা মেনে প্রধান শিল্পী হরিজি, শুভঙ্করজিকে দিলেন সহচালকের ভূমিকা, সহযাত্রীর মর্যাদা।
সেই সফর দুর্গম, সেই সফর ভয়ঙ্কর সুন্দর। তুষারশৃঙ্গের খোঁজে উপরে উঠতে থাকা অভিযাত্রীর বাঁদিকের গভীর খাদের মতো কঠিন কঠিন কিছু আবর্তন; সমে পড়তে আধা মাত্রা এদিক ওদিক হলেই জীবন মৃত্যুর খেলা। সূর্য ডোবার পালা দেখতে সৈকতে বসে কোনও এক অজানা বিশাল ঢেউয়ে ভেসে যাওয়ার শঙ্কা। কিন্তু দুই বন্ধু, দুই সহযাত্রীর হাত তাদের টেনে নিয়ে গেল সেই তুষারশৃঙ্গের শীর্ষে। তাঁরা একসঙ্গে দেখলেন সেই গোধুলির কনে দেখার আলো। আর তাঁরা আলো দিলেন হলে বসা কয়েকশো মানুষকে। তাঁরা হাসলেন, কাঁদলেন, বিস্ময়ে জাগলো তাদের প্রাণ।
পিছনের সারিতে এক কোণায় বসে আমার নাড়িতে রক্তধারায় টান লাগলো।
সেই শুরু। তারপর প্রায় দুই দশক কলকাতা, ব্যাঙ্গালোর, মুম্বই, দিল্লিতে কতবার ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জির হাত ধরে বনের পথে যেতে যেতে। কখনও তিনি মঞ্চমধ্যে মধ্যমনি হয়ে তাঁর ফারুকাবাদী পেশকার, কায়দা, রেলা, টুকরা, চক্রধারে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন। আর কখনও তিনি আলো করেছেন দিকপালদের ডানদিক - আমজাদজি, শিবজি, বিরজু মহারাজজি, রাশিদজি, কৌশিকী আরও কত নাম।
কী ছিল তাঁর বাজনায়?
হাজার হাজার ঘণ্টার রেওয়াজ? স্বপন-শিবজির স্নেহের তালিম? হরিজি-শিবকুমারজি, আমজাদজি - অজয়বাবুর কাছে বছরের পর বছর সাথ সঙ্গতের তালিম? ভারতীয় রাগ সংগীতের সর্বোচ্চ উপলব্ধি? কোনওদিন বুঝতে পারিনি।
একবার ডোভার লেনে একই রাতে তিনি যে অসাধ্য সাধন করেছিলেন, এই প্রজন্মের যেকোনও শিল্পীর কাছে সেটা একটা কষ্ট কল্পনা। সম্ভবত ২০০৬ বা ২০০৭-এ ডোভার লেনের শেষ রাতে। তিনি একাই বাজালেন তিন মহারথীর সঙ্গে, প্রথমে কৌশিকী, তারপর কোনও বিশ্রাম ছাড়াই হরিজি, আর তারপর মাঝে আরেকজনের অনুষ্ঠানের পর শেষ শিল্পী আমজাদজির সঙ্গে। ঠেকায় সেই একই তিনতাল, একতাল, ঝাপতাল বা রূপক। কিন্তু তিন মহারথীর সাথে প্রতিবার ঠেকায় কত নতুনত্ব।
আরেকবার ২০১০ সালে, ব্যাঙ্গালোরে আবারও হরিজির সঙ্গে ওনার আরেকটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি। সেখানে তাদের সঙ্গে Harp বাজালেন হরিজির কাছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের রস বুঝতে, শিখতে আসা ইউরোপের এক অপ্সরী। নামটা ভুলে গেছি।
বাঁশির সঙ্গে Harp-এর সেই তিন ঘণ্টার স্বর্গীয় যুগলবন্দীর রাশ নিজের হাতে বেঁধে রাখলেন শুভঙ্কর।
একসময় হরিজি প্রায় ৩০ মিনিট বাঁশি নামিয়ে রেখে আমাদের সঙ্গে একইরকম তন্ময় হয়ে শুনলেন তাঁর বিদেশিনী অপ্সরী ছাত্রী আর শুভঙ্করের আদান-প্রদান। সেই বাজনা ফিউশন নয়, সেই বাজনা বিশুদ্ধ, সেই বাজনা অনবদ্য।
বছরের পর বছর বারবার প্রতিটা অনুষ্ঠানে শুধু ওনার অসামান্য ঠেকার প্রেমে পড়েছি। কতবার এমন হয়েছে, অনুষ্ঠানে বা সিডি-Youtube-Spotify-তে ওনার সঙ্গত শুনতে শুনতে, আমি শুধু ওনার ঠেকাই শুনে যাচ্ছি… হরিজি কী বাজাচ্ছেন, বা রাশিদজি কী গাইছেন সেটা কানে ঢুকলেও, মাথায় ঢুকছে না। এসব শুনলে শাস্ত্রীয় সংগীতের পণ্ডিতরা বলবেন, মূর্খ শ্রোতা। আমি বলি, আমি দুনিয়ার সবচেয়ে অপদার্থ শ্রোতা, তবলায় সবচেয়ে খারাপ ছাত্র হিসেবে সারাজীবন থেকে যাবো শুভঙ্করজির ঠেকা শুনে শুনে। প্রতিটা অনুষ্ঠানে দূর থেকে তাঁকে গুরু দ্রোণাচার্য ভেবে, নিজেকে একলব্য ভাবতে চেয়েছি। সাহস হয়নি। ওই আকাশটা অনেক বড়, ওই সাগর অনেক গভীর, ওই হাতদু’টিতে অনেক ভালবাসার সাধনা, ওই মাথায় তালের অনেক জটিল দুরূহ অঙ্ক। আর এভারেস্টের চূড়ায় সূর্যোদয়, মাসাইমারার জঙ্গলে ছুটে চলা জেব্রার দল, নরওয়ের আকাশে মাঝরাতে সবুজ মায়াবী আলো দেখে, একটা লম্বা সফর শেষে সমে ফিরে দুনিয়ার মিষ্টিতম ‘ধা’ লাগানোর এক অনন্য তাগিদ।
আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে আমরা এমন একটা সময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান দেখতে শুরু করেছি বা এখনও দেখছি, যে আমাদের মধ্যে এখনও পণ্ডিত কুমার বোস, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, সমর সাহা বাজাচ্ছেন স্বমহিমায়। আর আরও নিশ্চিন্ত হই যখন ওজাস, যশবন্ত, ঈশান, দেবজিতের বাজনা শুনি। রিলের বাটন ইতিমধ্যে তাঁরা হাতে তুলে নিয়েছেন আর এখনও তাঁদের সামনে থেকে পথ দেখাচ্ছেন পণ্ডিত তন্ময় বোস, আক্রম খান বা যোগেশ সামসি।
আর মাঝে মাঝে তো এখনও দেখা পাই রাজাধিরাজদের- উস্তাদ জাকির হোসেন, পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী। জীবন কত সুন্দর। কলকাতা বা দিল্লিতে কিছু শীতের সন্ধ্যে বা কুয়াশামাখা কিছু কিছু রাতগুলি কত মায়াবী।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে তবলা আছে। তবলায় বাঙালির সেই আবহমান আধিপত্য আছে।
শুধু তিনি আর নেই!
ফুলে ফুলে সাজানো ছবিগুলোতে আটকে গিয়েছে লম্বা, জটিল ফারুকাবাদি চক্রধার শেষ করে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন নেওয়া সেই লাজুক হাসি। থেমে গিয়েছে একজোড়া অন্যন্য মিষ্টি হাত, পরিমিতিবোধ আর দুঃসাহসিকতার চূড়ান্ত নিদর্শন।
Covid এর দুটি ভয়ঙ্কর বছর পেরিয়ে আমরা কাজে ফিরেছি, শিল্পীরা স্টেজে ফিরেছেন, শ্রোতারা হলে ফিরেছেন। কিন্তু পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জি আর ফেরেননি কলকাতা - ব্যাঙ্গালোর - দিল্লি- মুম্বই - আমেরিকা - দুবাই - লন্ডন, সিডনিতে তাঁর বিশ্বজনীন স্টেজে।
গত দু’বছর প্রতিটা অনুষ্ঠানে তাঁকে খুজতে থাকি বারবার। তিনি আসেননা।
কোথায় হারিয়ে গেলেন?
এই অসীম কালসাগরে কোনও মঞ্চে তিনি ৪৮ মাত্রায় আবার বেঁধে নিয়েছেন রাশিদজির সিংহনাদের বাগেশ্রী?
কোন পুরাতন প্রাণের টানে, কোন গ্রহ-তারায়, কোন সবুজ উপত্যকায় শিবজির সন্তুরের পাহাড়ি ধুন খেলে বেড়াচ্ছে তাঁর দাদরা - কাহারবার তালে তালে!