দোঁহা

শীতের জলসা: সেকাল, একাল




সুমনা ঘোষ দস্তিদার

হাতে খঞ্জনী, গলায় কাঠের মালা, কপালে রসকলি। কার্তিকের ভোরের হিম মেখে বড় রাস্তা পেরিয়ে গলিদিয়ে হেঁটে যান, গলায় হরি নাম, কৃষ্ণ নাম। ঘুম ঘুম ভোরে সে সুরে ভরে যায় সদ্য আলো ফোটা আকাশ, বাতাস।
ছেলেবেলায় পুজোর আনন্দ শেষ হলে, শূন্য মন্ডপ দেখে মন কেমনের শুরু হতে না হতেই আবার বাদ্যি বেজে উঠতে দেখেছি। রিক্সোয় রিক্সোয় জোর গলায় ঘোষণা চলত, চারদিন ব্যাপী জলসার। বেশির ভাগ ক্লাবই আয়োজন করত সে অনুষ্ঠানের। যে যত বড় ক্লাব, তার শিল্পী সংখ্যা তত বেশি। কে কত জনপ্রিয় শিল্পীকে আনবে তার সুস্থ প্রতিযোগিতাও চলত। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে প্রবেশ অবাধ। পাড়ার নাচ- গান জানা ছেলে মেয়েরাও সুযোগ পেত। তবে কিছু বেসুরো, কিছু ভুলে যাওয়া কথায় গান শেষ হলেও, করতালির কার্পণ্য কেউ করতেন না। আর কারণে অকারণে স্টেজে ওঠা বা স্টেজের পাশে কর্মকর্তাদের মুখ দেখানোর ইচ্ছে অল্পবিস্তর সবার মধ্যেই থাকত হয়তো, তাই এ ছবি বেশ পরিচিত।
কখনও এ ছবি পালটে গেছে। কোনো খেলার আয়োজন, ক্লাবের উন্নতি বা বিভিন্ন সাহায্যের জন্য আয়োজিত সারারাত ব্যাপী সঙ্গীতানুষ্ঠানও হত। সে অনুষ্ঠানের আলাদা শ্রেণীর শ্রোতা দর্শকদের চোখে পড়ত, কারণ তা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের।
শীতের রাতে ঘন কুয়াশা টুপটাপ শব্দে ঝরেছে, সে শব্দ বড্ড নরম, তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ওদের চোখের জল যারা আসেন অষ্টপ্রহরের লীলা দেখতে। সাধারণ মানুষেরা এলেও বৃদ্ধ -বৃদ্ধারাই আসেন বেশি। রাধার মানভঞ্জন, নিধুবনে কৃষ্ণ কালী, নৌকা বিলাসের রাধার হাহাকার, অভিমান ছড়িয়ে যাচ্ছে রাতের শিরশিরে হাওয়ায়, হাওয়ায়।আবেগে ভাসছেন তারা, একে অপরের গলা জড়িয়ে অঝোরে কাঁদেন সে সব গান শুনে। সেই সুর, লয় নিঁখুত হয়ত ছিল না কিন্তু সে আবেদন হৃদয় ছুঁয়ে থাকত।
শীতের পিঠেপুলির মতোই খুব স্বাভাবিক গ্রামাঞ্চলের যাত্রাপালা। বাঁশের মাচা আর রঙিন ফুলছাপ কাপড়ে বাঁধা হত মঞ্চ। শিল্পীদের অভিনয়ে বলার ধরণে এক বিশেষ সুর, ঢঙ ছিল।  মাটিতে বেছানো পোয়ালে বসে চাদরে শরীর ঢেকে যাত্রা দেখার আনন্দই আলাদা ছিল।  বহু আগে যাত্রায় গানই ছিল প্রধান, পরে ধরণ পাল্টেছে। বারবার বাঁক নিয়েও যাত্রা আজও বেঁচে আছে,  থিয়েটারের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েই।
আজও শহরে গ্রামে বিপুল সমারোহে শীত আসে। হিমে ভিজে যায় শরীর থেকে মন। বাইরে থেকে ঘর গৃহস্থালি।  পালটায়নি ঋতু, কেবল পালটে গেছে শীত মানেই গানের জলসার ধরন। ভোরের নগর সংকীর্তন বা অষ্টপ্রহরের সুরে আজ জনপ্রিয় আধুনিক বাংলা, হিন্দি গানের সুর। পাড়ার আয়োজিত গানের অনুষ্ঠানে এখন জাঁকজমকপূর্ণ। তাদের দৃষ্টি এই প্রজন্মের রুচি অনুসারী শিল্পী নির্বাচনে। যেখানে গানের সঙ্গে শরীরও ছন্দে ছন্দে দুলে উঠবে। বিভিন্ন রিয়্যালিটি শোতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরাই এই মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এখন। বহু হারিয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া গানকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন তারা।
সঙ্গীত মেলাও আর সব মেলাকে পাল্লা দিয়ে শীতের রাতকে ওম দিচ্ছে। এখনও বহু মানুষ শীতের অপেক্ষায় থাকেন ছাদ বাগান ফুলে ফুলে সেজে উঠবে, পিঠে পুলি আর  ফল,সবজির বং বাহারে থালা সাজবে বলেই নয়, সঙ্গীত সম্মেলন, গানের জলসা বা উইন্টার কার্নিভালের অপেক্ষায়। যেখানে হিমেল সন্ধ্যায় তার প্রিয় শিল্পীদের কাছ থেকে দেখবেন, শুনবেন রোমাঞ্চিত হবেন, আবেগে ভেসে যাবেন। যতই রূপ পাল্টে যাক, জুড়ুক যুগের অভিরুচি, শব্দ ছন্দে সুরেই কেবল নয় আয়োজনেও আধুনিকতার ছাপ পড়ুক এ সব জলসায়, আজও শীত মানেই কিন্তু  সাংস্কৃতিক মঞ্চ, শীত মানেই জলসার আয়োজন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন