দোঁহা

ঊর্ণনাভ তন্তু ঘোষের কবিতা

 


 তখন ছায়া সরে আসে

কোনও মানে নাই,  তবু ভালোবাসার ঝোঁকে 
অসুখে, নদীর ধার দিয়ে ঘোড়া চ'ড়ে ;
উঁচু জুতো পরে
লেবু-রঙা মাঠ পেরিয়ে চলে আসি ; শিমুলতলা পেরিয়ে 
অঙ্গের আসঙ্গলিপ্সু শরীর ; দোদুল্যমান ডাহুক — যূথী 
শিশিরে ঝাড়া ঝাড়া তিৎপল্লার মতন 
মার্জিত মুখে — পৃথিবীর দিকে হাই তুলে দেখি,
কোন দিনের কুশল বিনিময়ে 
শীতের এমন রাঙা অশ্রুপাত সঙ্গে নিয়ে পানকৌড়ি জলে যায় 
নবান্নের সারস উড়ে এসে নামে অব্যবহৃত ঘাটে? 

তুরানি নক্সা করা কার্পেটের ধূসর আতিথ্য 
এখনও সময়ের ভিতরে দূরে — দূর কোনো স্টেশনের ঝিনুকি সন্ধ্যায় 
অবিরাম বিস্মরণী ছেঁকে  
মায়ার অধর্ম জাগিয়ে রাখে কাহাদের বুকে? 
কাহাদের তরে অপ্রতিম ধারা নিবাত অচলায় 
এমন  নিঃশব্দে বয়ে চলে ; অনন্যতায় —  সেলাইকল চলে 
শূন্যে — শূন্যেতর — অনন্তকাল।
রু রু বাতাস বয় হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠে,  পাঁজরে
ঘুম নেই —  এক দ্বৈত শরীর 
বুকের অলি গলি ঘুরে বেড়ায়; হাত বোলায়। 
ফিসফাস করে লতার আঙুলে তন্তুতে জোড়া দেয় 
আরও এক শর্বরী  — আরও  এক নিগূঢ় মন্দাকিনী 
আরও একটা রিপোর্ট — স্ক্রাব টাইফাসের মাত্রা আরও কিছু কমলে 
আসবেন করুণার আলোয় আরোগ্য ভবনের নার্স 
খানিক এদিক ওদিক নেড়ে চেড়ে শ্যামল দেহখানা 
কাশ্মীরি শালে জড়িয়ে এগিয়ে দেবে 
— গোধূলিজাত আর্দ্রনয়ন যুবতীর দিকে   অথবা 
সংসার-চেতনার নির্বিত মর্ত্তস্য কোনো অমৃতার গৃহে।  

তখন হেমন্তের সরে যাওয়া  ছায়া  মেঘ হয়ে ছেয়ে আসে
শীতের নিঃশব্দবিলাসী নক্ষত্র সুষুপ্তির গূঢ় তলে পুনরায় 
ধুকধুকি নিয়ে ফিরে আসে — আরেক জীবন্ত বেলায় |



সুলাইমানিয়ার ঘর। 

১০.

রমেনণেরা ফেরে
তাদের প্রাচীন, অনালোকিত,  গ্রাম্য — সুলাইমানিয়ার ঘরে। 
জানি, তবু মধ্যের এই সভ্যতার উদ্বর্বর পথ
আজকের স্যোসাল ইকোনমির খোলা পচা শামুকে 
খানিকটা পা না কেটে — রক্ত না ঝরিয়ে
তাদের ঘরে ফেরা হয় না। 

এই দেশ — রমেণের
সে কথা সে জানে তবু,
যতবারই তাকে ঘরে ফিরতে হয়েছে
স্যোশিও-ইকোনমির পুঁজির নিপীড়ন ধর্ষণ ব্যতীত 
তা ফেরা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি | বুঝলে,  ভাই খশরু

আমাদের ভোগাচ্ছে কেবল জীবিতেরাই নয় | 
La mort saisit le vif!  মৃত ধরছে জীবিতকে

১১.

ইংল্যান্ডের মত আমাদের সরকারেরও পার্লামেন্টগুলি যদি মাঝে মাঝে 
অর্থনৈতিক অবস্থার তদন্তের জন্য কমিশন নিযুক্ত করত
এবং এই কমিশনগুলিকে যদি সত্যাসত্য নির্ধারণ জন্য 
সেই রকমই চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া হতো তবে — জনস্বাস্থ্য, 
নারী ও শিশুদের শোষণ ; খাদ্য এবং বাসস্থান জন্য দলীয় মনোবৃত্তি
থেকে মুক্ত  শ্রদ্ধাসম্পন্ন সদস্য পাওয়া যেত — তাহলে নিজের
দেশের অবস্থা দেখে আমরা আজ স্তম্ভিত হতাম। পারসিউস রাক্ষস মারবার জন্য
এমন একটি জাদ-টুপি পরতেন যাতে রাক্ষসরা তাকে দেখতে না পায়। 
আমরা সেই  জাদ-টুপিটা চোখ-কান অবধি এতটা নামিয়ে আনি যাতে 
আমাদের দেশে রাক্ষস নেই এই মিথ্যা বিশ্বাসে নিজেদের ছলনা করতে পারি।

অনিবার্য এবং স্পষ্ট কথা ভারত মহাসাগরের দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর পুঁজির 
এবং ভূসম্পত্তিঘটিত যে আমূল পরিবর্তন প্রত্যাসন্ন।
 এই গুলি হল যুগের লক্ষন,  লাল রাজপোষাক 
কিম্বা পুরোহিতের কৃষ্ণ উত্তরীয়, কোনকিছু দিয়েই তা ঢাকা যাবে না।
আর তথাকথিত জনমতের কুসংস্কার — যার প্রতি আমি কখনও
দেখাই নি — সে সম্বন্ধে তখন যেমন এখনো তেমনি ফ্লোরেন্স শহরের মহান অধিবাসীর
ইষ্টমন্ত্রটিই আমার স্লোগান। " segui il tuo corso. E lacia dir le genti!

নিজ পথে যাও, লোকের যা ইচ্ছে তাই বলুক। পথ চলা জারি থাকুক।



১২.

দূরে যা দেখি — সারস উড়ে যায় মাঠোত্তীর্ণ 
শ্যামতনু মাঠের পরে ডুবে যায় কচি ঘাসের রেখা
ভাষার বিনুনি — আদিতম ভাষা, আশব্দ ব্রজবুলি 
কতকাল ভুলে যাওয়া জন্মফল — প্রত্যেক ঘরের দুয়ারে ছড়ায় কে? 

রমেণেরও ইচ্ছে হয় ফিরে যেতে সুলাইমানিয়ার  তারা জ্বলা ছোট্ট জাদু-ঘরটিতে   |


লেখক — ঊর্ণনাভ তন্তু ঘোষ 
বোলপুর,  বিশ্বভারতী 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন