দোঁহা

চর্চা, সংস্কৃতি ও বিবর্তন

 


 সুনির্মল বসু 


দেশ স্বাধীন হবার আগে ও পরে এই বঙ্গদেশে লোকায়ত সংস্কৃতির ধারা হিসেবে সারারাত ব্যাপী জলসার অনুষ্ঠান একসময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। প্রাক স্বাধীনতা যুগে মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করতে আসতেন রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কুন্দন লাল সায়গল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, রামকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীরা। মহিলাদের মধ্যে আঙ্গুরবালা দেবী, কমলা ঝরিয়া, সুপ্রীতি ঘোষ 
প্রমুখদের মঞ্চে দেখা যেত। অনুষ্ঠানে হাস্যরস পরিবেশন করতে আসতেন, নবদ্বীপ হালদার, তুলসী চক্রবর্তী, জীবেন বসু, শ্যাম লাহা প্রমূখ শিল্পীরা। 
দেশ স্বাধীন হবার পর আই পি টি এ গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে অনেকেই সংস্কৃতিক ভুবনকে প্রসারিত করেন। গণসঙ্গীতে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেশাত্মবোধক গানে সবিতাব্রত দত্ত যেমন এলেন, 
তেমনি এই সময়ের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলেন 
গীতিকার, সুরকার হলেন সলিল চৌধুরী। 
জলসার আসরে দেখা দিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা, তরুন বন্দোপাধ্যায়, সনৎ সিংহ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পিন্টু ভট্টাচার্য, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, সুদাম বন্দ্যোপাধ্যায়, অংশুমান রায়, নির্মলেন্দু চৌধুরী,
সুবীর সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, আরতি মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, সবিতা চৌধুরী, রুমা গুহ ঠাকুরতা এবং তাঁর ক্যালকাটা ইউথ কয়ারের শিল্পী বৃন্দ। 
এই সব অনুষ্ঠানের হাসির আসরে আসতেন প্যারোডি গানের শিল্পী মিন্টু দাশগুপ্ত এবং দুই বেচারা। কখনো কখনো জহর রায়, শীতল বন্দ্যোপাধ্যায় এই সব অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। 
সারারাত ধরে এই অনুষ্ঠান গুলি বিশাল শ্রোতাদের মনোরঞ্জনে সক্ষম হতো। কখনো কখনো অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে সবার শেষে মঞ্চে আসতেন
সুদর্শন অভিনেতা প্রদীপ কুমার, প্রদীপ কুমার বটব্যাল। 

এই অনুষ্ঠানগুলি সাধারণত মফস্বলের মানুষদের মনোরঞ্জন করবার জন্য আয়োজন করা হতো। 
নাগরিক আয়োজন ঘটেছিল কলকাতার ইনডোর স্টেডিয়ামে। এটি ১৯৮৬ সালের ঘটনা। অনুষ্ঠানের নাম ছিল, হোপ এইটিসিক্স। বোম্বে থেকে হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের প্রায় সকলেই এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। জিতেন্দ্র, অমরেশ পুরী, শক্তি কাপুর, অনিতা রাজ, পুনম ধীলন, লক্ষীকান্ত 
পেয়ারীলাল, শংকর জয় কিষন সবাই হাজির। গানে মঞ্চে দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন কিশোর কুমার। 
কমেডিয়ান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আসরানী।

মানুষ মানুষের জন্য, কিংবা, ও গঙ্গা বইছো কেন, গান শেষ করে ভূপেন হাজারিকা জনগণের মাঝখানে নেমে এসে, কোন দর্শকের কাছ থেকে খৈনি চেয়ে নিতেন। এমন দৃশ্য দেখা গেছে। 

শিল্পী অখিল বন্ধু ঘোষ ও দয়াল বিচার করো গানটি করে জনগণকে মাতিয়ে দিয়ে গেছেন। কিংবা যখন গেয়ে উঠেছেন, না হয় মন দিতে তুমি পারো না, তাই বলে কি মন পাবেনা, কেন এমন ধারণা? শিল্পী সুদাম বন্দ্যোপাধ্যায় যখন গেয়েছেন, তুমিই তো বলেছিলে, সেদিনের ঘন বরষায়, এমন ফাগুন এলে গান গেয়ে শোনাবে আমায়, এবার সে কথা রাখো। 
দর্শক বুক ভরে রোমান্টিকতার আনন্দ নিতে পেরেছেন। শৈলেন মুখোপাধ্যায় যখন গেয়েছেন,
কেটে গেছে অনেক সময়, এক পা একপা করে 
ফেরানো যাবে না তাকে আর। এইসব গান রাত জাগাকে সার্থক করে তুলতো, সে সময়ে। কিংবা, 
অনুষ্ঠানে শেষের দিকে মঞ্চে উঠে সুবীর সেন গাইতেন, সারাদিন তোমায় ভেবে হলো না আমার কোন কাজ, হলো না তোমাকে পাওয়া, দিন যে বৃথাই গেল হায়। তখন বুকের মধ্যে কী প্রবল কষ্ট হতো। অথচ, মনে জাগতো শৈল্পিক আনন্দবোধ। 
জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় গাইতেন, তোমার সঙ্গে দেখা না হলে, ভালোবাসার দেশটা আমার দেখা হতো না। অসাধারণ। সে এক তীব্র অনুভূতি। রাত জাগা সার্থক মনে হতো। 

জলসা আজকাল চেহারা বদল করেছে। জলসা এখন মূলত হিন্দী গান নির্ভর। এখন চালু হয়েছে, মাচা সংস্কৃতি। ঝলমলে পোশাকে শিল্পীরা মঞ্চে আবির্ভূত হচ্ছেন। সিরিয়াল আর্টিস্টরা মঞ্চে আসছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জলসার ও চেহারা পরিবর্তন হয়েছে। আগেকার শিল্পীদের গান মনে থেকে যেত। এখনকার শিল্পীদের মঞ্চের উপর চলাফেরা, বিভিন্ন ভঙ্গিমা, লক্ষ্য করতে হয়। আগেকার অনুষ্ঠান গুলি দীর্ঘদিন মনে থেকে যেত। 
এখনকার অনুষ্ঠানগুলি ইনস্ট্যান্ট স্ট্রীট ফুডের মতো।দ্যাখো, মজা নাও, ভুলে যাও।

তবে এর পাশাপাশি অরিজিৎ সিং, কবীর সুমন, নচিকেতা চক্রবর্তী, ইন্দ্রনীল সেন,
শুভমিতা, শ্রীকান্ত আচার্য, শ্রীরাধা বন্দোপাধ্যায়ের 
অসামান্য সঙ্গীত অনুষ্ঠান গুলির কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে।
সংস্কৃতি চর্চা এবং তার বিবর্তনের ধারা সেখান থেকে এ কাল পর্যন্ত জলসার গতিপ্রকৃতির দিকে লক্ষ্য করলে, পরিষ্কারভাবে চোখের সামনে একটা ছবি ফুটে ওঠে। সেটা হলো, সময় বদলায়। মানুষ বদলায়। মানুষের চিন্তা-ভাবনা বদলায়। আর শিল্প ভাবনা এবং শিল্পবোধ তো জীবনকে বাদ দিয়ে নয়। 
আগামীতে জলসা চর্চা কোনদিকে বাঁক নেবে, সেটা আগে থেকে বলা যায় না। একদিন সময় সেই কথা বলে দেবে।






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন