দেবব্রত রায়
একটা ঠকাস-শব্দে একেবারে মুখোমুখি ধাক্কা। ভিড়ের মধ্যে সামনের লোকটাকে খেয়াল করেনি বঙ্কা। দু-জনেই, "বাবা-গো !" বলে রাস্তাতেই বসে পড়ল । ততক্ষণে পাশ থেকে একজন ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি নিজের খাবারজলের বোতল থেকেই ওদের মাথায় জলের থাবড়া দিতে শুরু করেছেন। কয়েকজন ভদ্রমহিলাকে, মোহ নয়, দ্রোহ, লেখা প্ল্যাকার্ড দিয়ে ওদের দুজনকে বাতাস করতে দেখা গেল। আর তারমধ্যে হটাৎ-ই, বঙ্কা চিৎকার করে উঠল , " আরে, মানকে তুই ! " মানিকও মাথায় হাত ঘষতে-ঘষতে বলল, " আইব্বাপ, বঙ্কা তুই ! " তারপর দু-জনেই তাদের ঘিরে থাকা মানুষজনদের দেখে যেন লজ্জায় একেবারেই ধুলোর সঙ্গে মিশে গেল। দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল," এহে-হে, কী করছেন স্যার! " এরপর বঙ্কা তার জামার ডানহাতা দিয়ে আর মানিক বাঁ-হাতা দিয়ে ভদ্রলোকের জুতোজোড়া মুছতে-মুছতে বলল, আমাদের জন্য আপনার জুতা-প্যান্ট কাদায় ভরে গেল স্যার !
যে-সব মহিলারা বঙ্কা আর মানিককে এতক্ষণ- ধরে বাতাস করছিলেন , ওরা তাঁদের দিকে তাকিয়ে একেবারে লজ্জা-লজ্জা মুখে হাতজোড় করে বলল, না, না, তেমন-কিছু লাগেনি দিদিভাইরা । আমরা ঠিক আছি !
ভীড়টা একটু সরে যেতেই, বঙ্কা বলল, কী গুরু, খুব দৌড়াতে-দৌড়াতে আসছিলে মনে হচ্ছে ! তা ওদিকের টিমের খবর কী !
মানিক বলল, " দিদিমণি দান্ডি-দান্ডি খেলচে ! সুচোন্দাদি দু-পা সামনে, দু-পা পিছে, ডাঁয়ে মোড়, বাঁয়ে মোড়-টুনির মা-নাচ্চে রেডরোডে ! ভীড় নেই তবে, জাঁকিয়ে মটন-বিরিয়ানির বেবস্তা হচ্চে ! " বলেই যেন মটন চিবানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে তার দাঁতের পাটিতে অর্গ্যান বাজানোর মতো বেশ একটা নোটেশন বাজিয়ে শোনাল বঙ্কাকে ! তারপর সামনের কয়েকটা পোকা-খাওয়া দাঁত বের করে বললো, ওদিককার গন্ধ নিয়ে এদিকের খবর নিতে আসচিলাম ! আর তার মধ্যে এই ঝামেলা ! তা রাসমণির খবর কী-রে ?
বঙ্কা একটু নরম আর স্যাঁতসেঁতে সুরে বলল, সেরকম কিছু-না ! স্রেফ শুকনো রুটি-আলুভাজা-বোঁদে আর এক-বোতল জল ! তাও কখন হবে, তার ঠিক নেই !
" সে-কি র্যা, এই খেয়ে সারারাত রাস্তা দখল করবে পাবলিক ! " মানিক হতাশ-সুরে কথাগুলো বলে, বঙ্কাকে নিজের ইচ্ছেটা পরিষ্কার জানিয়ে বলল, না ভাই, বিরিয়ানি ছেড়ে ওসব রুটি-আলুভাজা-বোঁদেতে আমি নেই ! অনেকদিন পর একটা দাঁও পেয়েচি ! আমি বিরিয়ানির দিকেই চল্লুম, এখন দ্যাক তুই কী করবি !
রাত তখন প্রায় সাড়ে-বারোটা। একটা থার্মোকলের থালায় দেওয়া সামান্য আলুভাজা, বোঁদে আর চারটা হাতে বানানো-আটার রুটি নিয়ে বঙ্কা সবে রুটির সামান্য-এক-টুকরো ছিঁড়ে মুখে পুরেছে আর অমনি তার মনে হলো, কে যেন বগলের তলা দিয়ে ওর থালার রুটিতে টান মারছে ! সঙ্গে-সঙ্গে বঙ্কাও খপ করে হাতটা ধরে পিছন ফিরতেই, চমকে উঠল। দেখল, মানিক ! সে কিছু বলার আগেই, মানিক কাচুমাচু মুখে বলল, খেতে দিল না, বুঝলি ! লাথ মেরে বের করে দিল ! বলল, শালা, শুয়োরের-বাচ্চার শাখআলু খাবার সখ হয়েচে !
মানিক ওর মুখের আধ-চিবানো শুকনো রুটি-আলুভাজার সঙ্গে যেন গলায় আটকে থাকা একটা ব্যথা গিলতে-গিলতে বলল , তবে লাথি খেয়ে একটা শিক্ষে হলো, বুঝলি ! বিরিয়ানি আর রুটির লড়াইয়ে, শেষমেশ রুটিরই জিত হল!