দোঁহা

‘গীত-হার’: উনিশ শতকের এক অনাদৃত গীতাঞ্জলি

 


মনস্বী চৌধুরী 

‘প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারি ধার’--- অভিধেয় অর্থে না হলেও, ব্যঞ্জিত ভাবনে উনিশ শতকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ও ব্রাহ্মসমাজের হাতে গঠিত সংস্কৃতায়িত সংগীত-বলয়ের সমান্তরালেই যে বহতা গীত-স্রোতের অস্তিত্ব ছিল, তার প্রতি পঙক্তিটিকে একটি উন্নাসিক উচ্চারণ বলে ধরা যেতে পারে। কেবল রবিকবি নন, সেকালের ‘এলিট’ স্রষ্টাদের একাংশ গীতসাহিত্যের ‘ঐকতান’সভায় ‘একতারা’ হাতে যে সব শিল্পীরা গান গেয়েছিলেন তাঁদের গান শুনেও শোনেননি, হিসেব রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি তাঁদের সৃজনকর্মের। উনিশ শতক, সাহিত্যের মতো সংগীতের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। সংগীতের বিচিত্রানুষ্ঠানে মগ্ন এক কাল। এই মগ্নতার একদিকে যেমন ছিল তান-তাল-লয় আবার অন্যদিকে ছিল আত্ম-ভাবের গীতিমূর্ছনা। তাই বাঙালির সংগীত-সংস্কৃতির ইতিহাসের পাতায় সৃষ্টি-স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল একটি অধ্যায় হল উনিশ শতকের বাংলা গান। আজ তার কতটুকুই বা জানি আমরা? ঐতিহাসিক সত্যের স্বীকরণে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের একাধিপত্য আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে একটা গোটা সময়ের সবকিছুই। ‘গীতবিতান’ ছাড়া আমাদের সংগীত-ভাবনা অবলম্বনহীন। অথচ রবীন্দ্র-পূর্ব যুগ থেকেই সংগীত সৃজনের সঙ্গে সংগীতকে তদ্‌গতভাবে বুঝবার একটি পরিসরও নির্মিত হয়েছিল। শতাব্দীর প্রথম পাদে প্রণীত রাধামোহন সেন দাসের “সঙ্গীত-তরঙ্গ” (১৮১৮) গ্রন্থের ‘অবতরণিকা’র ‘গ্রন্থের –পরিচয়’ অংশে মেলে সে-নির্মাণের স্পষ্ট সাক্ষ্য—‘… ইহার অভিধান “সঙ্গীত-তরঙ্গ” হইলেও, ইহার অভিধেয় সঙ্গীত-বিজ্ঞান।’  সে-সময়ের কিয়দংশ যে সাময়িকতার অভিশাপের হাত এড়াতে পেরেছে তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ থাকব সেই সকল কৃতবিদ্য সংগীত-ভাবুকদের প্রতি। তাঁদের বিপুল কর্মকাণ্ডকে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করে দেখতে পারি। প্রথমত, সংগীতশাস্ত্র-বিষয়ক আলোচনা-সমন্বিত গ্রন্থের প্রকাশ, দ্বিতীয়ত, বিশুদ্ধ গীত সংকলনের প্রকাশ, তৃতীয়ত, অজস্র স্বরলিপি গ্রন্থের প্রকাশ। রাধামোহন প্রণীত গ্রন্থ প্রকাশের ঠিক দশ বছর পর প্রকাশিত রাজা রামমোহন রায় প্রণীত ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ (১৮২৮) গ্রন্থটিকে আমরা সেই অর্থে প্রথম সম্পূর্ণ একটি গীত সংকলনের তক্‌মা দিতে পারি। যদিও সেখানে সংকলিত গীতগুলির চরিত্র ও ভাব-প্রকৃতি ভিন্ন রুচির। যেহেতু আমাদের আলোচ্য বিষয় একটি বিস্মৃত তথা অনাদৃত বিশুদ্ধ গীত-সংগ্রহ, তাই আমরা আমাদের আলোচনায় উক্ত সাংগীতিক-কর্মকাণ্ডের প্রথম ও তৃতীয় ধারা দুটি বাদ রাখছি। ভরা-যৌবনা উনিশের কলকাতায় বৈচিত্র্যপূর্ণ বইমহলে ধীরে ধীরে মাথা তুলছিল যে সুরেলা শ্রুতি ও স্মৃতির জগত, তাতে রামমোহনের ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ সংকলনের পর একেবারে ভিন্ন রসের গীত-সংগ্রহ, রামনিধি গুপ্তের ‘গীতরত্ন’ (১৮৬৮)-এর কথা মনে পড়ে যায়। এই বিশুদ্ধ গীত-সংকলন গ্রন্থ প্রকাশের ধারার দুটি রকম লক্ষ করবার, একটি হল ব্যক্তিগত গীতি-সংগ্রহ আর অপরটি হল বিভিন্ন রচয়িতার বিভিন্ন বিষয়ী গীত-সংকলন গ্রন্থ। আমরা সচেতনভাবে ‘সংগ্রহ’ ও ‘সংকলন’ দুটি শব্দ ভিন্ন দুই অর্থে ব্যবহার করেছি। প্রথম ধারাটির উদাহরণ পূর্বোক্ত আর দ্বিতীয় ধারাটির উদাহরণস্বরূপ বলা যায় নবকান্ত চট্টোপাধ্যায় সংগৃহীত ও সংকলিত ‘ভারতীয় সঙ্গীতমুক্তাবলী’ (১৮৮৪) অথবা অবিনাশচন্দ্র ঘোষ সংগৃহীত ও সংকলিত ‘প্রীতিগীতি’ (১৮৯৮) গ্রন্থ দুটির কথা। 
উনিশ শতকের সাতের দশক থেকে বহু প্রশ্ন-তাড়িত আত্মানুসন্ধানী বাঙালির বিবিধ বিষয় নিয়ে রচিত গীতের সংকলন প্রকাশ করবার তুঙ্গ মূহুর্তে, ১৮৭৪ সালে বহুবাজারের (আখ্যাপত্রের বানান অপরিবর্তিত) ৪ নং সেকরাপাড়া লেন থেকে ‘বেঙ্গল সুপীরিয়র যন্ত্রে’ মুদ্রিত ‘গীত-হার’ নামক একটি গীত-সংগ্রহ প্রকাশ পেল। গীত-প্রণেতা ও সংকলকের নাম শ্রী গঙ্গাধর চট্টোপাধ্যায়। নামটি আমাদের আজ একেবারেই অচেনা। কেবল আজ নয়, সেকালেও বেশ চেনা ছিল, তেমনটি বলা যায় না। ‘ভারতীয় সঙ্গীতমুক্তাবলী’-তে তাঁর গীতের সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সামান্য পরিচয়, তাছাড়া তাঁর সম্পর্কে আর কিছুই তেমন জানতে পারা যায় না। রাজনারায়ণ বসু কর্ত্তৃক প্রদত্ত ‘বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা’-য় গ্রন্থটি সম্পর্কে লক্ষিত হয় তাঁর যথাসাধ্য মনোজ্ঞ অবলোকন—“গঙ্গাধর মুখোপাধ্যায় (চট্টোপাধ্যায়?) “গীতহার” নামে ঐ প্রকার এক পুস্তক প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার গীতগুলি কিন্তু তত উৎকৃষ্ট ও মনোহর নহে।” ভেবে দেখবার বিষয়, এখানে যিনি গীত রচয়িতা তিনিই সংগ্রহ প্রস্তুতকারক। বিভিন্ন গীত রচয়িতা কর্ত্তৃক রচিত বিভিন্ন ভাব ও বিষয়ের গীত দু-মলাটের মধ্যে প্রকাশ পেতে দেখবার সময়ে একটি চলমান শতকের বিবিধ ক্রিয়া ও ভাব-দিগন্তের ফুলে গ্রথিত হল ‘গীত-হার’। গ্রন্থ সূচনায় ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারকে নিবেদিত উপহারপত্রে তিনি লিখেছেন—“কখন কখন স্বভাবের মনোহারিণী শোভা, কখন স্বদেশের যার পর নাই দুর্দ্দশা, আর কখন বা পরকালের  ভাবনা, মনের মধ্যে কীরকম ঝড় তোলে,--- সেই ঝড়ে কল্পনা-তরুর দুই একটা ফুল পাতা যা ছিঁড়ে উড়ে পড়ে তাই কুড়িয়ে কুড়িয়ে এই হার ছড়াটি গেঁথেছি—এ আমার ঝড়ো ফুলের হার! এতে গন্ধ নাই, বাহারও নাই!” ‘ঝড়ো ফুলের হার’ হলেও গ্রন্থটি পাঠ করলে দেখা যায় গীত যে সংগতির কথা বলে সেই সংগতিটি এখানে উপস্থিত আর সেখানেই ‘গীত-হার’ মনে হয় সার্থকনামা। সে প্রস্ফুটিত পুষ্প নয়, কেবল হার বা সূত্র, বিষয়টি ভেবে দেখবার মতো। রামনিধি গুপ্ত থেকে বিহারীলাল চক্রবর্তী পর্যন্ত উনিশ শতকের বাংলা গানের প্রথম চলনে যে ব্যক্তিগত গীত-সংগ্রহের ধারণা আমাদের ছিল তার থেকে এই সংকলনটি পৃথক চরিত্রের। একজন ব্যক্তির নানান বিষয়ে গীতরচনার প্রেক্ষিতে, সে-সময়ে প্যারীমোহন কবিরত্ন রচিত গীতধারার চরিত্রের সঙ্গে গঙ্গাধরের রচনার তুলনা কিছুটা চললেও পার্থক্য থাকবে সূক্ষ্মতা ও সৌকুমার্যে। গ্রন্থটির সূচীপত্রটি খেয়াল করলে বোঝা যাবে বিষয়-বৈচিত্র্য। ছয় ঋতু, দিন-ক্ষণ থেকে সমকালীন ঘটনা, ব্যক্তি সবই ধরা দিয়েছে তাঁর গীত রচনার বিষয় হিসেবে। আমরা জানি ‘গীত’ মূলত শোনবার জিনিস, পড়বার নয় কিন্তু গঙ্গাধরের রচিত গীত না শুনলেও, পাঠ করে আনন্দ পাওয়া যায়। সমকালীন আর কোনও ব্যক্তিগত বা সম্মিলিত গীত-সংকলন গ্রন্থে এই রসদ পাওয়া যাবে না, তবে সেগুলি স্বল্প হলেও আলোচিত। জনৈক সমালোচক তাঁর গীতের সঙ্গে বিহারীলালের ‘সঙ্গীত-শতক’ (১৮৬২)-এর গীতগুলির সঙ্গে তুলনা করেছেন, আমাদের ভাবনায় ও যুক্তিতে বিহারীলালের উক্ত গ্রন্থের গীতগুলিতে পাঠের আনন্দ নেই, গীত-চরিত্রের পারিপাট্য নেই, যা গঙ্গাধরের গীতে রয়েছে। বিষয়টি স্পষ্ট করবার জন্য বলি, তাঁর রচিত ‘সন্ধ্যা’ বিষয়ক একটি গীতে যেমন সময়ের গীতল বর্ণনা রয়েছে আবার তেমনই আধুনিক মনের সন্ধানও রয়েছে। একই সঙ্গে ‘মহারাণী স্বর্ণময়ী’, ‘হিন্দুমেলা’, ‘ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রস্তাবিত বিজ্ঞান সভা’, ইত্যাদি বিষয়গুলিতে নির্জলা ব্যক্তি-বন্দনার চেয়ে লক্ষ করা যায় ব্যক্তি ও কর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির সার্বিকতা। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মতো সাংবাদিকসুলভ দৃষ্টিভঙ্গিও যুক্ত হয়েছে তাঁর গীতরচনায়, বিশেষত ‘পিতৃমাতৃ সন্তোষার্থে শ্রীযুক্ত বাবু বিহারিলাল গুপ্তের হিন্দুপরিণয়’ নামক গীতটিতে। পরিশেষে বলি, যে গীত-গ্রন্থের ভিতর লুকিয়ে আছে একক ব্যক্তির তুলি নিঃসৃত একটি সময়ের বিভিন্ন রঙ, সেই গ্রন্থটি  আমাদের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠল না; আজ বিস্মৃতির পরমব্রতের যুগেও বাঙালি হিসেবে আমাদের এ এমন এক দুঃখ ‘যাকে ভোলার মতো দুঃখ আর নেই।’ 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন