মিলি ঘোষ
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র। যদিও পরিচয় দেবার প্রয়োজন পড়ে না। একাধারে চিত্রশিল্পী, সহিত্যসাধক। রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালী সভার সভ্য ছিলেন। তখন নাটকও করেছেন। হয়তো ছবি আঁকাই তাঁর প্রথম ও প্রধান পরিচয়। কলকাতা আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষও ছিলেন। কিন্তু তাঁর সাহিত্য সাধনাকে অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। সঙ্গে ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণা। কবিতা, গল্প, স্মৃতিকথা, যাত্রাপালা কী না লিখেছেন! বিশেষ করে ছোটদের জন্য তাঁর লিখিত বই অনবদ্য। সহজ সরল ভাষায় শকুন্তলা পড়ে মন খারাপ হয়নি এমন বালক বালিকা ছিল না। ছিল না বলছি, কারণ এখন বাবা মায়েরা তাঁদের সন্তানদের ভুল করেও এই বই কিনে দেন না। এই কাহিনী নিয়েই মহাকবি কালিদাসের অমর সৃষ্টি। অসামান্য নাটক। এই বিষয়কেই ছোটদের উপযুক্ত করে ছবি দিয়ে সাজিয়ে দিলেন অবনীন্দ্রনাথ। তবু মানুষ মনে রাখল না।
'নালক' আর একটি অসামান্য বই। কী তার ভাষা!
"আকাশের কুয়াশা আলো হয়ে পৃথিবীর উপর এসে পড়েছে। সেই আলোয় বরফ গলে চলেছে -- পৃথিবীকে সবুজে সবুজে পাতায় পাতায় ফুলে ফলে ভরে দিয়ে।"
ছোট্ট নালোক ঋষির সেবা করত। পড়তে পড়তে আজও মনে হয় নালককে সামনে দেখছি। মিশে গেছি তার জীবনের সঙ্গে, ভাবনার সঙ্গে। গৌতম বুদ্ধের এই গল্প যে শিশুরা পড়ল না, তারা যে কতটা বঞ্ছিত হলো নিজেরাও বুঝল না। আজকের শিশু, আজকের কিশোর, জানানো হলো না এর কিছুই। কল্পনার প্রয়োজন আছে। বাস্তবের কাঁটা বিছানো পথে কল্পনা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।
কে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর? বড়জোর ঠাকুর যখন, নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের কেউ ছিলেন। বাবা মায়েরাই বা ক'জন ঠিকঠাক জানেন তাঁকে? সেই কোন ছোটোবেলায় পড়া, অত কি আর মনে থাকে? ব্যাস, এইটুকুতেই আটকে থাকলেন অবনীন্দ্রনাথ।
একটা সময় ছিল, যখন ছোটদের পুরস্কার বা উপহার হিসেবে দেওয়া হতো ক্ষীরের পুতুল। ছবি দেখলেই পড়তে ইচ্ছা করে। অসম্ভব জেনেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। না হলে বাঁদর কখনও কথা বলে? আর আমরা অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকি বাঁদর কী অসাধ্য সাধন করে সেদিকে। রূপকথার গল্পও লিখতে জানা চাই। সবার দ্বারা হয় না। সে এমন গল্প বড়রা পড়লেও মন উদাস হয়ে। মনে হয় সত্যিই হয়তো পৃথিবীর কোনও এক নাম না জানা দেশে এমন ঘটনা ঘটেছে। এমন দেশে, যেখানে সশরীরে যেতে মন চায় না। কিন্তু ভাবতে ভালো লাগে। এই যে কল্পনার রাজ্যে ডুবে যাওয়া, এখানেই তো স্বার্থকতা রূপকথার গল্পের। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে মন দিয়েছেন। সেই মন যদি কল্পনাই না করতে পারল, আকাশ দেখে বৃষ্টি দেখে উদাস না হতে পারল তবে মানুষের সঙ্গে অন্য জীবের পার্থক্য কোথায়?
অবনীন্দ্রনাথের বুড়ো আংলা বইটিতে ছবি কম। কিন্তু শব্দ ছন্দের অপূর্ব মেলবন্ধন রয়েছে এই বইতে। কখনও গদ্যে, কখনও পদ্যে। ছড়ায় ছড়ায় কথোপকথন। বারবার পড়তে ইচ্ছা করে, এমন সে লেখা।
"ছুঁচোয় গড়েছে মাটির ঢিপি
বিষ্টি পড়বে টিপিটিপি।
সাগরের পাখি ডাঙায় গেল,
ঝড় জল বুঝি এবার এল।
কাক যে বাসায় একলা বড়
গতিক খারাপ, নেমে পড় নেমে পড়।"
এই যে ছড়ার মধ্যে দিয়ে গল্প এগোল, প্রতিটি ছড়ায় যে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে ছোটদের উপযুক্ত। নাহলে বৃষ্টিকে তিনি বিষ্টি লিখবেন কেন?
এই বইয়ের শৃগাল গল্পের শুরুটাই মন কেমন করা বাক্য দিয়ে গঠিত।
"মেঘনার মোহনায় চর যে কখন কোথায় পড়ে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আজ যেখানে জল, কাল সেখানে দেখা গেল বালি ধূ-ধূ করছে। কাল সেখানে দেখছি চরে উলু-ঘাস, বালু-হাঁস। বছর ফিরতে দেখলেম চরও নেই, হাঁসও নেই -- অগাধ জল থৈ থৈ করছে।"
এসব লেখা পড়ে আজও হারিয়ে যেতে মন চায়। অথচ আমরাই ছোটদের এসব বই পড়তে দিচ্ছি না। দুই কী আড়াই বছরে স্কুলে ভর্তি করে দিচ্ছি। তার আগে মুখে বোল ফুটতে না ফুটতে এ বি সি ডি শেখাচ্ছি। ভুলেও কোনও বাংলা কবিতা নয়। বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবেই মানুষকে। জীবন ছেড়ে কথা বলবে না। কিন্তু বড়রা জীবনের শুরু থেকে এমন চাপ সৃষ্টি করে, যে শিশুরা কল্পনাপ্রবণ হতে শেখেই না। কঠিন কঠোর বাস্তব ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে এমনভাবে নাগপাশে জড়িয়ে ফেলে যে, কল্পনার, ভাবনার, উদাস হবার সময়ই ওরা পায় না। এ কেমন জীবন শিশুদের? ওরা অবনীন্দ্রনাথকে চিনবে না? ওরা হাসবে না? খেলবে না?
অনেক সময় স্রষ্টা হারিয়ে যান সৃষ্টির কাছে। কিন্তু যেখানে সৃষ্টিই হারিয়ে যায়, সেখানে স্রষ্টা কে? চিনি না। আমরা মনে রাখিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। চিনতে শেখাইনি বাচাদেরকে। শুধু ক্ষীণভাবে নামটা রয়ে গেছে এখনও। তাও এক শ্রেণীর মানুষের কাছে। বাকি বিশ্ব ভুলে গেছে তাঁকে, স্ব-ইচ্ছায়। তিনি বিস্মৃত। তাঁর সৃষ্টিও বিস্মৃত।