মিঠুন মুখার্জী
"বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল--
পুন্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, হে ভগবান ।।"
-বাংলা মাকে আপন হৃদয়ে ধারণ করে যিনি বাংলার প্রতিটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছিলেন সাহিত্যচর্চায়, তিনিই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তাঁর সাহিত্যে পল্লীবাংলার মাটি ও মানুষের কথা শুনিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের পরে যারা লিখতে শুরু করলেন, তাঁদের অধিকাংশই বিশ্বাসের ভাঙন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মধ্যবিত্তের সংকট নিয়ে ভেবেছেন। কিন্তু বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এসবের দিকে দৃষ্টিপাত না করে অতি সাধারন হাসি-কান্না, প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তির কথাকে তুলে আনলেন এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষকে মেশালেন এমনভাবে যে তাঁর সাহিত্য থেকে প্রকৃতিকে আলাদা করে দেখা যায় না। অর্থাৎ মাটি, মানুষ ও ঈশ্বর তাঁর গল্প-উপন্যাসে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। বাংলার আকাশ-বাতাস, ফুল-ফল, হাসি-কান্না তাঁর সাহিত্যের লেখনীতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
স্বভাবে লাজুক মিতভাষী বিভূতিভূষণ শৈশবেই নির্জন নিরালায় গ্রামবাংলার শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে নিসর্গ প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সংস্পর্শে আসেন। পরবর্তীকালে জীবনযাত্রা নির্বাহ- প্রয়োজনে কর্মজীবনেও নির্জন নিসর্গ প্রকৃতির গভীর অরণ্যের বিশাল বিস্তৃতিতে তিনি বিস্ময়, বিমুগ্ধ ও অভিভূত হন ; ইহজীবনের শেষদিন পর্যন্তও তিনি নির্জন অরণ্যানীর রুপ-সৌন্দর্যসুধা পানে বিভোর ছিলেন। তাই বিভূতিভূষণের সমগ্র জীবনই নিসর্গ প্রকৃতি ও আধ্যাত্মনির্ভর এবং তারই সুস্পষ্ট প্রতিরূপ তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে সর্বত্রই পরিদৃশ্যমান। নিসর্গ প্রকৃতি ছিল বিভূতিভূষণের বাল্যের ক্রীড়া সঙ্গিনী, যৌবনের প্রেয়সী এবং বার্ধক্যের সান্ত্বনাদাত্রী।
১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রকৃতিপ্রেমিক সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইহলোকে আবির্ভাব ঘটে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া- মুরাতিপুর গ্রামে নিজের মামার বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল এই জেলার বনগাঁর নিকটে বারাকপুর গ্রামে। তবে তাঁদের আদি নিবাস ছিল উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার অন্তর্গত পানিতর গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা ছিলেন মৃণালিনী দেবী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ ছিলেন। পিতার কাছেই তাঁর পড়াশুনা শুরু হয়। তারপর নিজের গ্রামের পাঠশালায় হাতে খড়ি। এরপর তিনি বনগাঁর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর পিতা মারা যান। এরপর কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
১৯১৯ সালে হুগলি জেলার জঙ্গিপারার 'দ্বারকানাথ হাইস্কুলে' তিনি শিক্ষকতা করেন। এখানে পড়ানোর সময় বসিরহাটের মোক্তার কালীভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা গৌরী দেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু বিয়ের এক বছরের মধ্যে গৌরিদেবী মারা যান। পরবর্তীতে ১৯৪০ সালে ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে রমাদেবীকে বিবাহ করেন। বিয়ের সাত বছর পর তাঁদের একমাত্র সন্তান জন্ম নেন। তাঁর নাম তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
'ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়'-এর মধ্যে অন্যতম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনায় তিনি পাঠক মন কেড়ে নিয়েছেন বারংবার। তবে তাঁর ছোটগল্পের থেকে উপন্যাসগুলি তাঁকে বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা দান করতে বেশি সহায়তা করেছিল। ১৮২৯ সালে 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ পাঠক হৃদয় অধিকার করে নেন। 'পথের পাঁচালী'র বিশেষত্ব প্রকৃতিপট নির্মাণে নয়, পাঁচালীকারের অধিকতর সানুপুঙ্খ তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে। 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের কাহিনী ও চরিত্র চিত্রণে (অপু, দুর্গা, ইন্দিরা ঠাকুরন, সর্বজয়া, হরিহর) বিভূতিভূষণ বিশেষ দক্ষতা ও সার্থক শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন। 'পথের পাঁচালী' সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছেন --- "বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।..... এই গল্পে গাছপালা, পথঘাট, মেয়ে-পুরুষ, সুখ-দুঃখ সমস্তকে আমাদের আধুনিক অভিজ্ঞতার প্রাত্যহিক পরিবেস্টনের থেকে দূরে প্রক্ষিপ্ত করে দেখানো হয়েছে। সাহিত্যে একটা নতুন জিনিস পাওয়া গেল অথচ পুরাতন পরিচিত জিনিসের মত সুস্পষ্ট।"
'পথের পাঁচালী' উপন্যাস ছাড়া বিভূতিভূষণের লেখা অন্যান্য উপন্যাসগুলো হল ---- 'অপরাজিত'(১৯৩২, দুটি খন্ডে বিভক্ত) 'দৃষ্টিপ্রদীপ'(১৯৩৫), 'আদর্শ হিন্দু হোটেল'(১৯৪০), 'বিপিনের সংসার'(১৯৪১),'দুইবাড়ি'(১৯৪১), 'অনুবর্তন'(১৯৪২),'দেবযান'( ১৯৪৪),'কেদাররাজা'(১৯৪৫), 'হীরা মানিক জ্বলে'(১৯৪৬), 'ইছামতি'(১৯৫০), 'অশনি সংকেত'(১৯৫৯) ইত্যাদি।
'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের পরবর্তী অংশ 'অপরাজিত' উপন্যাসটি। এটি দুটি খণ্ডে বিভক্ত। ছোট্ট অপু বড় হয়ে ওঠা ও সংসার জীবনের কাহিনী এই 'অপরাজিত' উপন্যাসের বিষয়। 'অপরাজিত' উপন্যাসকে নিয়ে 'পথের পাঁচালী'কে একটা মহাকাব্য উপন্যাস বলা হয়ে থাকে। এই দুই উপন্যাসে জীবনের ক্রমিক বিকাশের পরিক্রমা চিত্রিত হয়েছে।
অপুর জীবনের পথচলার কাহিনীই 'পথের পাঁচালী'। আসলে উপন্যাসটাই মুগ্ধ মনের যাত্রাপথের কাহিনী। এখানে দুর্গাকে লেখক প্রকৃতির সারল্য--মুক্তি ও আনন্দের প্রতিমা রূপে উপস্থাপন করেছেন। বিভূতিভূষণ ভাগলপুরে চাকরিসূত্রে থাকাকালীন একটি মেয়েকে দেখে দুর্গা চরিত্রের অবতারণা করেছিলেন। ইন্দিরা ঠাকুরন প্রাচীনকালের প্রতিনিধি। হরিহরের দিদি ও অপু দুর্গার পিসি। হরিহর স্বপ্ন-বিলাসী, বাস্তববিমুখ, সংসার উদাসীন, ভ্রাম্যমাণ কথক, এই চরিত্রটির সঙ্গে বিভূতিভূষনের 'পুঁইমাচা' গল্পের সহায়হরি চরিত্রের মিল লক্ষণীয়। মাতৃস্নেহে পূর্ণ সর্বজয়া চরিত্রটি। 'পথের পাঁচালী'র অপুর জীবনবৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে 'অপরাজিত'তে এসে। এখানে অপু উপলব্ধি করেছে প্রকৃতি বিমুক্ত জীবন কত ভয়ংকর, নির্মম ও বহুমুখী। এখানে অপু তার মায়ের প্রতীক রূপে অপর্ণাকে পেয়েছে আবার হারিয়েছে। তাই বহির্বিশ্বে বন্ধনমুক্ত জীবন পথিক অপু এবার চলল অজানা দেশের পথে। জীবনের চলমানতা,প্রবাহমানতা, অবিচ্ছিন্নতার প্রতিনিধি অপুর ছেলে কাজল রানুদির কাছে রয়ে গেল --- "চব্বিশ বৎসরের অনুপস্থিতির পর অবোধ বালক অপু আবার নিশ্চিন্দিপুরে ফিরিয়া আসিয়াছে।"
এরপর বিভূতিভূষণ রচনা করেন 'দৃষ্টিপ্রদীপ' উপন্যাসটি। এই উপন্যাসে সাংসারিক রূঢ়তায় তার হাতে রূঢ়তার তালিকা প্রনয়ন হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে অপ্রাকৃত দৃষ্টিশক্তির আলোকেও সে রুঢ়তা জনিত রসাভাসকে উত্তীর্ণ হতে পারেননি লেখক।
'আরণ্যক' উপন্যাসে সুদীর্ঘ কোন কাহিনী বা উপকাহিনী নেই। এখানে অরণ্য প্রকৃতিকে স্বয়ং চরিত্রের ভূমিকায় দেখা গেছে। কাহিনীর প্রধান ঘটনা হলো, সত্যচরণ নামে এক শিক্ষিত যুবক তার ধনী বন্ধুর এস্টেট ম্যানেজার হয়ে উত্তরবাংলা ও বিহারের সীমানায় গিয়ে জঙ্গলমহলের জমি বন্দোবস্ত করে, আর তার ফলে গাছপালা কেটে অরণ্য শেষ হয়। ব্যবসায়ী মহাজনের ছত্রছায়ায় ঘিঞ্জি জনপদ জীবন গড়ে ওঠে। নায়ক এইকাজে ব্যথিত হয়ে শেষে অরন্যের বিগত সৌন্দর্যের স্মৃতি চারণায় সান্ত্বনা খোঁজে। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু, বর্ণনা বৈশিষ্ট্য, ভাষারীতি এবং নিচুতলার মানুষের জীবনচিত্র অভিনব। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এমন সংযোগ আর কোন উপন্যাসে চোখে পড়ে না।
'আদর্শ হিন্দু হোটেল' আধুনিক যুগের সমস্যাক্ষুব্ধ জীবনযাত্রা থেকে বিপরীত বৃত্তের স্বরূপকে তুলে ধরেছে। এই উপন্যাসটি রচিত হয়েছে রাধুনী-বামুন হাজারী ঠাকুরকে নিয়ে। রানাঘাটের রেলবাজারে 'বেচু চকত্তির' হোটেলের কাজ চলে গেলে, তার সততায় ও রান্নার গুণে মুগ্ধ হয়ে শুভানুধ্যায়ীরা তাকে কিভাবে আদর্শ হিন্দু হোটেল খোলার কাজে সহযোগিতা করে, এখানে সেইসব ঘটনা স্থান পেয়েছে। হাজারী ঠাকুর ও পদ্ম চরিত্র দুটি এই উপন্যাসে বেশ জীবন্ত।
'বিপিনের সংসার' উপন্যাসে বিভূতিভূষণ পুরাতন জীবনবৃত্তের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করেও এক নতুন মনোরাজ্য নির্মাণ করেছেন। কাহিনী হিসেবে আছে পৈতৃক পেশা নায়েবের চাকরি ছেড়ে যুবক বিপিন ডাক্তারি করতে যায়। সে নানা সুযোগে রোগীদের লোকজনের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। 'দুই বাড়ি'তে আছে, রামনগর শহরের যুবক নিধিরাম মোক্তারের কলকাতা থেকে আসা লালবিহারী বাবুর মেয়ে সুশিক্ষিতা তরুণী মঞ্জুর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ও ভালোবাসার ট্রাজিক কাহিনী। 'অনুবর্তন' উপন্যাসে আছে, কলকাতার 'মর্ডান ইনস্টিটিউশন' নামে একটি স্কুলের শিক্ষকদের দৈনন্দিন জীবন ও পরিবেশের কাহিনী। বিভূতিভূষণ নিজে শিক্ষক ছিলেন বলেই এই উপন্যাস শিক্ষক জীবনের অভিজ্ঞতায় ভরা।
প্রকৃতির চেতনার সঙ্গে আধ্যাত্ম চেতনার অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে 'দেবযান' উপন্যাসে। এই উপন্যাসের কাহিনীটি কাল্পনিক হলেও, তা শিক্ষিত সংবেদনশীল পাঠক মনে রোমাঞ্চ বা শিহরণ জাগায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ জনিত মৃত্যু ও অবক্ষয়ের পটভূমিকায় 'দেবযান' উপন্যাসটি রচিত। বিষয় বুদ্ধিহীন, আত্মভোলা, সঙ্গীতপ্রেমী গড়শিবপুরের প্রাচীন রাজার বংশধর প্রৌঢ় কেদার রাজা ও তার মেয়ে শরতের কলকাতার ছেলে অরুন ও প্রভাসের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার ঘটনাসমূহ স্থান পেয়েছে 'কেদার রাজা' উপন্যাসে।
মহাকাব্যিক উপন্যাস 'ইছামতি' বিভূতিভূষণ- এর শেষ পর্বের রচনা। বিংশ শতকের প্রথমার্ধের নদীশাসিত গ্রামবাংলার এক সার্থক চিত্র এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে। ব্যারাকপুরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীর দুই তীরের লোকজন ও তাদের সমাজ জীবনের কাহিনী, নীলকুঠি ও নীল চাষ সংক্রান্ত নানা ঘটনার তরঙ্গভঙ্গে গড়ে উঠেছে উপন্যাসটি। 'ইছামতি' বস্তুনিষ্ঠ সামাজিক দলিল। এই উপন্যাসের জন্য তিনি মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। 'দম্পতি' উপন্যাসটি গ্রাম্য এক ছোট জমিদার ও ব্যবসায়ী গদাধর বসুর দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতা ও বিচ্ছেদের ইতিবৃত্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে গ্রামবাংলায় ১৩৫০ বঙ্গাব্দে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তার যথাযথ বিষাদান্ত ঐতিহাসিক চিত্র ধরা পড়েছে 'অশনি সংকেত' উপন্যাসে। দুর্ভিক্ষের সঙ্গে লড়াই করে মানুষের বেঁচে থাকা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, অশিক্ষার অন্ধকারে গ্রামীণ মানুষের বুদ্ধি হীনতা ইত্যাদি প্রসঙ্গ উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। দুর্ভিক্ষের ছায়া কিভাবে ভদ্র-মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে অন্ত্যজ মানুষের জীবন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, এই উপন্যাসে তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। অনঙ্গবৌ,মতি,সাধুচরণ প্রভৃতি চরিত্র সৃষ্টিতে একজন দক্ষ স্রষ্টার পরিচয় দিয়েছেন বিভূতিভূষণ।
উপন্যাসের পাশাপাশি বিভূতিভূষণ অনেক ছোট গল্প রচনা করেছেন। যেখানে গ্রাম বাংলার প্রকৃতি, নদী-নালা, ঘর-বাড়ি, সাধারণ মানুষের জীবন সুন্দর ভাবে ধরা দিয়েছে। তাঁর লেখা বিশেষ উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থগুলি হল---------- 'মেঘমল্লার'(১৯৩১), 'মৌরিফুল'(১৯৩২),'যাত্রাবদল'( ১৯৪৪),' কিন্নরদল'(১৯৩৮),'বেনীগীর ফুলবাড়ী'(১৯৪১), 'নবাগত'(১৯৪৪), 'উপলখন্ড'(১৯৪৪), 'বিধু মাস্টার'(১৯৪৫), 'ক্ষণভঙ্গুর'(১৯৪৫), 'অসাধারণ'(১৯৪৬), 'মুখোশ ও মুখশ্রী'(১৯৪৭),'নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব'(১৯৪৮), 'জ্যোতিরিঙ্গন'(১৯৪৯) ইত্যাদি।
বিভূতিভূষণের রচিত গল্পগুলি মানব জীবনের ছোট দুঃখ ছোট ব্যথার কথা। তিনি নিজে একটি লেখায় বলেছেন--- "যেসব জীবন অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে আছে, তাদের কথা বলতেই হবে। তাদের সে গোপন সুখ-দুঃখকে রূপ দিতে হবে।" তাঁর লেখা গল্পগুলির মধ্যে বিষয়বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প 'উপেক্ষিতা' প্রকাশিত হয় ১৩২৮ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় মাঘ সংখ্যায়, কল্লোলের আবির্ভাবের দু'বছর আগে। এই গল্পে বঞ্চিত নারী জীবনের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। বঞ্চিত নারী জীবনের কাহিনী 'মৌরিফুল', 'পুঁইমাচা', 'সংসার', 'ডাকগাড়ি', 'বিপদ' প্রভৃতি গল্পেও ফুটে উঠেছে। 'মৌরিফুল' গল্প এক কলহ নিপুনা গ্রাম্য বধুর করুন কাহিনী। এই গল্পে সুশীলা প্রধান চরিত্র। এই চরিত্রের মধ্যে রয়েছে দুটি বিপরীত ভাব --- একদিকে সে জেদি, একগুঁয়ে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ময়ী, অন্যদিকে সে কোমল প্রাণ ও মানব দরদী। সুশীলা শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের 'শাস্তি' গল্পের চন্দরার মত ব্যক্তিত্বময়ী রমণী।
কাহিনীনির্ভর গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'পুঁইমাচা' গল্পটি। এই গল্পের প্রধান চরিত্র ক্ষেন্তি সরল, স্বল্পবুদ্ধি, পেটুক ও নির্বোধ। এই মেয়েটির বিয়ে হয় প্রৌঢ়ের সঙ্গে। শ্বশুরবাড়িতে নিগ্রহ ও অকাল মৃত্যু --- এই হলো ঘটনাক্রম। ক্ষেন্তি গরিবের মেয়ে, খেতে ভালোবাসতো। ক্ষেন্তির সারল্য এই গল্পের সম্পদ। পুঁইশাককে কেন্দ্র করে গল্পের বিষয় আরম্ভ হয়েছে। পুঁইশাক খেতে খুব পছন্দ করত ক্ষেন্তি। সকলের বকুনি অগ্রাহ্য করে সে ফেলে দেওয়া পুঁইশাক কুড়িয় আনে। মা অন্নপূর্ণা, বাবা সহায়হরি, বোন মুখে যাই বলুক না কেন, ক্ষেন্তিকে সকলে মনেপ্রাণে খুব ভালোবাসতো। তার মৃত্যু তাদের সংসারে দুঃখের ছায়া নিয়ে আসে। কিন্তু গরিব মানুষের করারই বা কি থাকে! অন্নপূর্ণা চরিত্রের সঙ্গে সর্বজয়া, সহায়হরি চরিত্রের সঙ্গে হরিহর, ক্ষেন্তির সঙ্গে দুর্গার ও বোন পাচির সঙ্গে অপুর অনেকটাই মিল লক্ষ করা যায়।
অলৌকিক রসের গল্পে ঘটনার গুরুত্ব বেশি। এই ধরনের অতিপ্রাকৃত রসের গল্প হল 'খুঁটিদেবতা'। এই গল্পের জনশ্রুতি ও লোকবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে মনস্তাত্ত্বিক রূপকে মেলে ধরেছেন গল্পকার। 'তুচ্ছ' গল্পে কামারদের ছোট মেয়েটির মাথায় কয়েক ফোঁটা গন্ধ তেল ঢেলে দেওয়ায় আনন্দ ও চরিতার্থতা লেখক-নায়ক নিজের জবানিতে ব্যক্ত করেছে --- "কিন্তু কি আনন্দ আমার স্নান করতে নেমে নদী জলে। উদার নীল আকাশে কিসের যেন সুস্পষ্ট সৌন্দর্যময় বাণী। অন্তরে ও বাইরের রেখায় রেখায় মিল। চমৎকার দিনটা। সুন্দর দিনটা।" অনেক সময় দেখা যায়, বিভূতিভূষণের গল্পে মিস্টিক কল্পনা ও সৌন্দর্যের অনুভূতিতে রহস্যময় জগতের সংবাদ আছে। যেমন-- 'মেঘ মল্লার' গল্পে রয়েছে শাপভ্রষ্টা সরস্বতীকে উদ্ধারের জন্য এক তরুণ সংগীত সাধকের আত্মবিসর্জনের কাহিনী। 'নদীর ধারে বাড়ি', 'প্রত্যাবর্তন', 'শাবলতলার মাঠ', 'কনে দেখা' প্রভৃতি গল্পে প্রকৃতি পটভূমি রূপে বা প্রকৃতির মধ্যে বিচরণশীল মানুষের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। বিভূতিভূষনের অপার্থিব অনুভূতির কথা যে গল্প গুলির মধ্যে লক্ষ করা যায় সেগুলি হল---- 'অভিশপ্ত', 'বউ চণ্ডীর মাঠ', 'প্রত্নতত্ত্ব', 'খুঁটি দেবতা' প্রভৃতি গল্প। বিভূতিভূষণের ছোটগল্প সম্পর্কে অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন ----"বিভূতিভূষণের শিল্পসার্থক গল্পগুলির উৎসভূমি আধ্যাত্মিক উপলব্ধি, গভীর প্রকৃতিবোধ ও প্রবল মানবপ্রীতি। মানুষ ও নিসর্গ, মানুষের প্রাত্যহিক জীবন। কর্মব্যস্ত অগভীর একঘেয়ে জীবনের অন্তরালে লুকানো সৌম্য আনন্দময় আধ্যাত্মিক জীবন, প্রবল নিঃশব্দ উচ্ছ্বাসময় জীবন-মন্দাকিনীর শান্ত প্রবাহ বিভূতিভূষনের ছোটগল্পের মূল উপাদান। বিভূতিভূষণ কেবল মাটি ও মানুষের শিল্পী নন, আকাশ ভরা আনন্দলোক ও ঐশী মহিমারও রূপকার।"
বিভূতিভূষণ-এর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি গ্রন্থ, সেগুলি হল--- 'গল্প পঞ্চাশৎ', 'রুপ হলুদ', 'অনুসন্ধান', 'ছায়াছবি', 'সুলোচনা', 'প্রেমের গল্প', 'অলৌকিক' ইত্যাদি। তাঁর কিশোর সাহিত্য গুলি হল--- 'চাঁদের পাহাড়', 'মরণের ডঙ্কা বাজে', 'মিসমিদের কবচ' ইত্যাদি। এই রচনাগুলিও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। 'চাঁদের পাহাড়' উপন্যাসটি বাঙালির কাছে খুবই প্রিয়।
বিভূতিভূষণের সাহিত্যজগৎ সমকালের বা পূর্বকালের লেখকদের ভাবজগতের প্রতিবিম্ব নয়, তা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। সংক্ষেপে এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল -----
ক) হিংসা-দ্বেষ-কুটিলতায় ঘেড়া মানব সংসারের রুপচিত্র অঙ্কনের পরিবর্তে নিসর্গ জগতের সৌন্দর্য আবিষ্কার ও ধ্যান তন্ময়তা।
খ) প্রকৃতিচেতনা, আধ্যাত্মচেতনা এবং বর্তমান বিশ্বচেতনার স্বরূপ উপলব্ধি।
গ) অতীতের স্মৃতি চারণ এবং শিশু-কিশোর মনের ভাবনায় চেনা পরিত্যক্ত পল্লীগ্রামকে নতুন রূপে দেখা।
ঘ) সহজ- সরল ভাষায় লিরিকের ভাব- কল্পনায় কাহিনী পরিবেশন ইত্যাদি
পরিশেষে বলা যায়, বাংলা কথাসাহিত্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিক খুবই বিরল। পল্লী বাংলার সামগ্রিক চিত্র এত সহজ-সরলভাবে খুব কম সাহিত্যিকই তুলে ধরেছেন। গ্রাম বাংলার সমস্ত কিছুকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি, যেগুলি উঠে এসেছে তাঁর সাহিত্যের বিষয় হিসাবে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় 'পথের পাঁচালী' থেকে শুরু করে বিভূতিভূষণের অনেক গল্প- উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র বানিয়েছেন, যেগুলি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেছে।
ঋণস্বীকার ।।
১) "ঐচ্ছিক বাংলা শিক্ষক", ডঃ পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ছায়া প্রকাশনী।
২)"ঐচ্ছিক বাংলা পরিক্রমা", অধ্যাপক এন. চৌধুরী, জয় দুর্গা লাইব্রেরী।
৩)" আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত",ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মর্ডান বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড।
৪)"প্রবন্ধ বিচিত্রা", সম্পাদনা:ডঃ দেবেশ কুমার আচার্য, বামা পুস্তকালয়, গ্ৰন্থ বিকাশ।