দোঁহা

১৮ নম্বর চুঁচুড়া-হরিপাল

 

 

অরিত্র দ্বিবেদী


"ঘ্যাঁচ" করে থামতেই, "টিং" করে একটা শব্দ হলো। 
   যেই জানলা দিয়ে ভোরের নরম আলো বা একটু বেলার রোদ ঢুকে আসে তার সামনে আড়াআড়ি শোয়ানো একটা হাওয়াইয়ান গিটারের ধুলো পড়া তিন নম্বর তারটায় টান পড়েছে। রোদকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, তারের গায়ে ঝরে পড়া মুহূর্তের অনুরণন তখনো লেগে, সেটা কাঁপছে। আর আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছে জমে থাকা ধুলো। তারা বিন্দু বিন্দু রোদ সেজেছে। একসাথে ধুলো বলে ছিল, এখন যেন কৌটো খোলা জোনাকি।
   বাসটা থামল। মনটা এখনো আগের চিন্তায় কাঁপছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার আগের চিন্তাটা আর গোটা নেই। টুকরো টুকরো মনখারাপ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের আর কোনো খোঁজ আমার চেতনে বা অবচেতনে কোথাও নেই। শূন্যতা এসে ঘিরেছে আমায়। 
  "আরে ধুত্। গরু এসে গেছে!"
  "গরু? তাড়িয়ে দে! (এখানে একটি কাঁচা খিস্তি ছিল)। যত্ত আপদ। এইজন্য এ সময়টা ভাল্লাগে না!"
   আমি এদিক ওদিক দেখলাম। বাসের সিটে আমি একা। ওই সামনে একেবারে কোণে একটা দাদু চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছে। নিঃস্পন্দ একেবারে। দুম করে দেখলে মনে হবে সিট কভার। দুদিকে মাঠ। গাঢ় অন্ধকার। বাসের হেডলাইটের আলো সামনের রাস্তায় পড়েছে। ধানের জমির সাদা সাদা না কাটা নাড়া গুলো চোখে পড়ে। আমার ডানদিকে জানলা। নীলচে, কালচে একটা কাচ তাতে লাগানো। তার গায়ে বিন্দু বিন্দু বাষ্প জমেছিল। 
     অ্যাক্সিডেন্ট হতে হতে হয়নি। মনে হল, জানলা বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের ফোঁটাগুলো আসলে সেই সম্ভাবনার ঘাম। বাষ্প'র মোড়ক ফাটিয়ে বেরিয়ে এসেছে।
     শব্দ করে আড়মোড়া ভাঙলাম। কন্ডাক্টর একবার পিছন ফিরে দেখল। ওনার (ঝকর ঝকর ঝকর) পুরো মুখেই মাফলার বাঁধা। গায়ে পুরোনো উইন্ডচিটার। চোখদুটো ঘোলাটে লাল।
       বাসটা আবার চলতে শুরু করেছে। গরুটা দেখল একবার। দরজার ফাঁক দিয়ে সেটা আমি দেখতে পেলাম। কন্ডাক্টর ড্রাইভারের কাছে গিয়ে বসল। আমি এতক্ষণ খেয়ালই করিনি কানে হেডফোনে আমার ভীষণ পছন্দের একটা গান বাজছে। দূরে, কারোর বাড়ির হলদে আলো মাঠের মাঝে জেগে আছে। লাস্ট বাস। রাত ৯.৫৬। ১৮ নং সড়কের ওপর দিয়ে একটা পুরোনো বাস "ঝকর ঝকর ঝকর" করতে করতে ছুটছে। গন্তব্য হরিপাল। চুঁচুড়া থেকে আসছে ওটা।  
"পিয়া তোরা ক্যায়সা অভিমান"

      কখনো কখনো একটা দমকা হাওয়া, বা ঘটে যাওয়া, ছুটে চলা এই জীবনে একটা কোনো স্থির দৃশ্য হুট করে চোখে পড়ে। তারপর সেই ছবিটা ভাসতে ভাসতে কিছুটা একসাথে যায়। তারপর উল্টোদিক থেকে আসা হাওয়ায় তার একটা একটা করে অংশ খুলে খুলে উড়ে যায় আমাদের পিছনে। একসময় পুরো ছবিটাই উড়ে যায়। শুধু বুকে লেগে থাকে কিছু সামান্য অংশ। হাওয়া যেটাকে হাত থেকে বুকে নিয়ে এসেছে, কিন্তু মনকে ভেদ করে পিছনে ছুটে যেতে পারেনি। এই গুলোকেই বোধহয় আমরা এক কথায় স্মৃতি বলে ডাকি।
     আহা গুলজার কী লিখেছেন! 

"আপনে নয়ন সে নীর বাহায়...আপনি য়ামুনা খুদদ আপ্ হি বানায়ে"

   মনে তো পড়ে। মনে তো সত্যিই পড়ে। কিছু ঘটনা আংশিক, কিছু পুরোটাই। আবার কিছু কিছু এমন ঘটনাও মনে পড়ে, যেগুলোর সত্যতা নিয়ে নিজেরই সন্দেহ হয়। যেন অতিলৌকিক যেন অবাস্তব। অথচ কী ভীষণরকম অনুভূত। 
"টিঁ টিঁ রি রি ইইঁ টিঁ টিঁ টিঁ"
   শীতের এমন রাতে শুনলে মনে হয় বাসের হর্ন নয় বরং কোনো অতীত যুগের প্যাঁচা, কাছেই কোনো ডালে বসে, আমার এই একান্ত গোপন সব চিন্তাগুলো দেখে ফেলেছে। তাই ব্যঙ্গের হাসি। তাই ডাকছে। ভয় লাগে। লজ্জা লাগে। বুঝি কেউ আমাকে নগ্ন দেখে ফেলেছে। আমার চিন্তার নগ্নতা তার দৃষ্টির গোচরে। এই নগ্নতার জানান দিতেই বাসটা একবার বেঁকে। একটা টার্ন। হু হু করে ঢুকে আসে হাওয়া। হুডিটা ভেদ করে আত্মা অবধি ছুঁয়ে যায়। লোকেশন আর নেটটা অন করাই আছে। পাওয়ার বটনটা চাপতেই ফুটে ওঠে: ১১° সেলসিয়াস।

"সুখে কেশশ রুখে ভেষ, মনওয়া বেজান, পিয়া তোরা......" 
    
     সেই ক্লাস ইলেভেন সায়েন্সের ঘর। একলা ঘর। আমি শুধু। ছোট্ট একটা নোকিয়া ১১৪, কালো দোমড়ানো মোচড়ানো হেডফোন। দরজা দিয়ে আড়চোখে দেখা। আর্টস বোধহয়। টুয়েলভ। ওইদিনই লাস্ট ক্লাস। বাইরেই জলের ট্যাপ। আর কিছুই মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে। দুটো মায়াবী, কাজল কালো চোখ। স্কুল ড্রেসের লাল ওড়নাটা একটা আঙুলে পাকিয়ে উঠে উঠে দমবন্ধ করে রেখেছে কিছু। 
স্থির। 
অপলক।
শূন্য।
পূর্ণ।
সময়।
যুগ। 
মাস। 
বছর।
কালখন্ড।
শীত।
হাওয়া।
ও দেখছে।
আর লাল রঙের জলের বোতলটার জল উপচে ভেসে যাচ্ছে চওড়া কালো বেসিন। ট্যাপটা জোরেই খোলা। পিছন থেকে একটা ডাক। আচমকা ডাক। 
আর কখনো দেখিনি। নামটাও জানিনা। 
   "এই যে ভাই তোমার চেঞ্জ। ষাট টাকা। কোথায় যেন নামবে?"
   "ঠিক আছে(টাকাটা ব্যাগের সামনের চেনেই রাখি, আবার কে উঠছে!)। অলিপুর।"
   "অ।"
   কোথায় ছিলাম? কোথায় ছিলাম? ও হ্যাঁ জল। উপচে পড়া আলো মুখে ফিরেছিলাম বাড়ি। 
   হুমমমমমমমম
   একটা চেনা পরিচিত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। বুকের সেই অচেনা জায়গাটা থেকে। অথচ আজব ব্যাপার! জায়গাটা আমাকে দিব্যি চেনে।

"তু কীসী রেল সি গুজর তী হ্যায়, ম্যায় কীসী পুল সা, থর থরাতা হুঁউ..."  

     আচ্ছা, চিন্তার কি কোনো ঘটনা পরম্পরা নেই? যখন খুশি যা খুশি চিন্তা চলে আসতে পারে মাথায়! এই ঘটনাটা কেন মনে পড়ল? রাস্তায় যেতে যেতে তবে কি প্রেম? না না। তাও বা হয় কীভাবে! তবে তো ওর কথাটা মনে পড়া উচিত ছিল। 
যার জন্য আকাশ নীল
যার জন্য শিরশির হাওয়া
যার জন্য কাঁপুনে আকাশমণি ডাল
যার জন্য একা একেলা শীতকাল....
     ক্লাস নাইন,উহুঁ টেন। শুরুর দিকেই। তারপর তো বছর তিনেক... 
     একজন থাকতেই অপরজনের উপস্থিতি। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও উপস্থিতি তো!
      একটা আলো ওয়ালা জায়গা পেরিয়ে গেল বাসটা। কোনো বিয়েবাড়ি মনে হল, বা কিছু পুজোটুজো হবে। এতদূর থেকে বোঝা সম্ভব নয়।
      একটা সকাল। গরমের। বাড়ি থেকে জোর করে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরিয়ে পাঠানো হয়েছিল। আর গায়ে একটা ছাপা বাটিকের জামা, এখনো মনে আছে। নতুন স্যারের কাছে পড়া। ইংরেজি। 
     একটা অদ্ভূত স্বভাব ছিল আমার, ছিলই বা বলব কেন, এখনো আছে। কে এল কে গেল! অর্থাৎ, নতুন কোথাও গিয়ে পড়লে, মানুষদের খুঁটিয়ে দেখা। হুম, লেখাতেও প্রভাব পড়ে বইকি, সুবিধাও হয়। রাত জাগা লেখার রাতে, কফির আলতো চুমুক যেভাবে মনে করায় লাইন, মনে করায় প্রেক্ষাপট মনে পড়তে লাগল....
     পাশেই একটা ট্রেনের লাইন, সিঁড়ি দিয়ে উঠে, দোতলার বারান্দায় পড়ানো হয়, আগের দিন কথা বলার সময় দেখে গেছি। সময়মত পৌঁছে যাই সব জায়গায়, কখনো কখনো আগেও। এক্ষেত্রে বোধহয় তাই। 
    আমি একাই বসে আছি। হঠাৎ ঝুকুর ঝুকুর শব্দে ছ'টার ট্রেন। (ঝকর ঝকর ঝকর)। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখটাতেই বসেছি আমি। আমার মুখ সোজাসুজি দেখছে সকালের সূর্য। হঠাৎ, 'ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি....'
                    একটা মুখ 
পিছনে অনেকটা আলো। ছাইচাপা আগুণ।
    চোখ সয়ে আসতেই দেখলাম, বিস্ময়। কিছুটা নরম রোদ, একটা হাত কানের পাশে গুছিয়ে রাখছে নীচে চলে আসা অবাধ্য চুলগুলো। 
     আমার মুখের দিকে তাকিয়েই...
লালচে গাল 
নামানো চোখ
সন্ত্রস্ত গতি
     ছুটে এসে বসে, মুখ গুঁজে দিল, বইয়ে...
আমার থেকে বেশ খানিকটা 

        দূরে।
     
"ম্যাঁয় হুঁ পানিকে বুলবুলে জ্যায়সা/তুঝে সোঁচু তো..ফুউট জাতা হুঁ"

    নদীর পাশ দিয়ে, বাড়ি ফেরার রাস্তাও একই। নোটস। হোমওয়ার্ক। মাঠে যাওয়া। বারবার মাঠে যাওয়া। স্কুলে লাস্ট ক্লাস বাঙ্ক।
    মাঠের পাশে, গার্লস স্কুল, বারবার ১৬টা জানলা খুঁজে ফেলা। লাল ওড়না। সাদা জামা। নাহ্। নাহ্। ওই তো! কাছে যেতেই নাহ্। হ্যাঁ। এইবার পেয়েছি। ওই তো! কাছে গিয়েই:
কাজের ভান। জোরে সাইকেল। স্মার্ট অ্যাকটিং করতে চাওয়া। না দেখেও এক্সপ্রেশন দেখা। খেলার বিকেলে, দেখতে পেলেই, শুধু শুধু ঝগড়া করে নিজের অস্তিত্ব জাহির করা। 
সন্ধ্যে হব হব: নদীর পাড়। একলা সাঁকো। একলা ছেলে। একলা নদী। ডুবছে একলা সূর্য। ওম্ আলো। উষ্ণ আলো। শীত শীত করে। কেন কেন কেন ?
    নাহ্। তিনবছর কেটেছে এভাবেই। বলেই উঠতে পারিনি কখনো। যদিও কী যে বলতে হত তাও জানিনা। কত রকম রিহার্সালই তো দিয়েছি, রাত জেগে জেগেও, পুরো প্লে লিস্ট শেষ করে ফেলেও। কোনো কিছুই তো বলতে পারিনি। শুধু হায়ার সেকেন্ডারির আগের সেই....সরস্বতী পুজো! ওটাই বা ভুলি কীভাবে!
     অঞ্জলি শেষ। একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছি। সাক্ষী তো একটা চাই। ছিল। সেই ছোট্ট কালচে সাইকেলটা। আমার, নিজের বলতে তখন তো এইদুটোই সম্বল। এক, স্বপ্নঘেরা চোখ আর দুই, সাইকেল।
      নদীর ধারে যাব বলে সবে বেরিয়েছি। রাস্তার ধারে ধারে লাগানো আকাশমণীর পাতাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠে জানান দিচ্ছে: শীতকাল; প্রথম ব্যর্থতা; প্রথম ভাঙা স্বপ্ন; প্রথম প্রেমের অনুভূতি। কাছেই কোথাও কোনো পুজোয় বাজছে কিশোর কুমারের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত:"আকাশভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ...."। সব পর্যায়ের গানগুলোই কেমন প্রেম পর্যায়ের হয়ে ওঠে যেন....। মাঠের কাছাকাছি এসেছি, নিজের নাম শুনে থামিয়েছি সাইকেল। লাল শাড়ি। কাজল চোখ। সে! হাতের তালু ঘেমে উঠেছে। 
     "কীরে! চিনতেই তো পারছিস না!"
     "ওহহ্..তু...তুইই! হ্যাঁ..অ্যাঁ...বল্..বল..."
     "কেমন লাগছে?"
     "......................"
     "হি হি হা হা হা হা"
     প্রশ্ন আর শূন্যতার পরিমাণ সমান হয়। সেইদিন জেনেছিলাম। আর জেনেছি, ভুল পড়েছি এতদিন, সময়ের যাপন সব সময় আপেক্ষিক। এক কী দেড় মিনিট বড়জোর। কিন্তু প্রতিটা মুহূর্ত আজও মনে আছে, আজও ভুল করে হলেও, অনুভূত হয়।
     তারপর, আমার হস্টেল, পাঁচ বছর পর ফিরে, কোনো খবর নেই। শুধু যাওয়ার দিন বিকেলে, ট্রেনটা যখন নদীর পাড় দিয়ে সামনের জঙ্গলে বেঁকে যাচ্ছিল, ওকে শেষবার দেখেছিলাম। আমি দরজায়। ওর সাইকেল রাখা, সাঁকোর পাশেই। সূর্যাস্তমুখী মেয়েটাকে ওইক্ষণেই শেষবার...। আচ্ছা, তবে কেনই পরিচয়, কেন এ উপন্যাসে ওই দুটো কী তিনটে অংশ?
      খেয়াল হল, হেডফোনে চাপ লেগে কখন না জানি গান বন্ধ হয়ে গেছে। আবার! যতখানি প্রশ্ন ঠিক ততদূরই শূন্যতা। আনকল করে দেখলাম, দশ সেকেন্ড বাকি আছে আগের গানটার। প্লে করে দিলাম....

"তু কীসী রেলল সি গুজর তী হ্যায়, ম্যায় কীসী পুলল সা, থর থরাতা হুঁউউ..."  
   
       "হ্যাঁ মা বলো। এই তো বাসে।"
       "কতদূর এলি?"
       "ওখান থেকে অনেকটাই(মনে)
        এইতো এইসবে সেনেট(মুখে)"
       "সাবধানে আয়, রাখছি।"
       "হুম"
       আজকে বারবার এইসব কথা কেন মনে পড়ছে কে জানে! জোর করে অন্যকিছু ভাবতে গেলাম। নাহ্। আর কিছু মাথাতেই আসছে না। জ্বরের ঘোরটা মাঝে মাঝে যেমন আবিষ্ট করে দেয়, আচ্ছন্ন করে দেয়, দুর্বল করে দেয় --- এও তেমনি। তবু এটাও ওই জ্বরের ঘোরের মতনই ভালোও লাগে। দুঃখ যাপন। ইংরেজিতে এইটাকেই বোধহয় বলে -- guilty pleasure, হবেওবা।
        আমার কাছে কী তবে, প্রেম আর বিচ্ছেদ সমার্থক ? মনে তো তাই হচ্ছে। যেমন দুঃখ আর শীত। যেমন journey আর স্মৃতি। যেমন melody আর melancholy......
       জ্বরটা আবার আসছে বলেই মনে হচ্ছে। ঝিম ধরে আসছে। রাস্তায় শরীর খারাপ খুব ভালো জিনিস নয়। তাও এই রাতে। কিন্তু যে আসছে তাকে আটকানোর সাধ্য যে আমার নেই। সত্যি বলতে কোনোদিন ছিলও না। নইলে যে ব্যাপারটা বন্ধুর বাড়ির পুজোয় শুরু হয়েছিল, তাকে বয়ে চলা যে ঠিক নয় তা বুঝেছিলাম তখনি। তাও, কখন কীভাবে যেন বয়ে গেলাম। নদীর মত বয়ে যাওয়া অপরাধ নয় জানতাম, তাই ভ্রূক্ষেপ করিনি। তবে, গন্তব্যের আপাত আঁচ পেয়েও ঝড়ের বেগে খরস্রোতায় ভাসা উচিত নয়...
    
"বহু মনোরথে সাঁচো অভিসারে পেহেলু সুনীল ভেষ...."

   খুব বর্ষা হচ্ছিল সেবার। আমি কলেজে লাস্ট ইয়ার। সাইক্লোন পূর্বাভাস, বাড়িতেই বন্দী। অগত্যা বই পড়া, লেখা লেখা খেলা আর ফোনে বকবক টকবক।
   নতুনদের সঙ্গে সহজেই সহজ হয়ে যাই আমি। কিন্তু সহজ হয়ে থাকা আর হয়না। তাই সেই ক্রিকেটের অমোঘ লাইন : "Excellent Start but can't get enough to mark...."
    তবে এ মেয়েটা অন্যরকম। 'এর কোনো বাঁধন নাই। এ ঘর ছাড়া কি তাই?' হবে হয়ত। পরের দিনগুলো মনে নেই বিশেষ। কী? ভাবছেন তো মিথ্যে বলছি! একেবারেই না। সত্যি মনে নেই। মনে রাখতেই চাইনি বোধহয়। কারণ বর্ষা আমার খুব প্রিয়। তাও:
ঘোর।
কথা।
আচ্ছন্নতা।
পূর্ণতা।
কথা।
বর্ষা।
গজল।
আরও কথা।
একটু টান।
কঠিন মেঘ।
   
"সখি চির অভাগিনী হম—
বৈঠে একাকিনী পোহানু রজনী তবু না আইল শ্যাম"

      ঋতুপর্ণ ঘোষের অভিনীত একটা ছবি ছিল। "Memories in March", খুব পছন্দের ছবি আমার। হলও তাই এক্ষেত্রে, memories in march; ভাবছেন আগের গুলো এত সুন্দর করে বললাম, এটা এত তাড়াহুড়োতে কেন? কারণ একটাই, নিছক ব্রজবুলির সঙ্গে পরিচয় ছাড়া, আর কিছুই ফিরে পাইনি আমি। এও মানছি যে শুধু তো পাওনা আদায় নয়, বোধহয় তার উল্টোটাই কর্তব্য। তবু, কত দিন বলতে পারেন? 
     আমাকে দেখে দারুণ লড়াকু, অদম্য জেদী বা দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকা কেউ বলে ভুল হবেনা কখনোই। তাও চেষ্টা করি, সাধ্যমত। 
     হোয়্যাটস অ্যাপে লাস্ট সিন কেন দেখতে হয়, কীভাবে দেখতে হয়, তার গুরুত্ব আমার বয়সীদের কাছে কতটা সব বুঝেছি এক ধাক্কায়...
     আমার বোধহয় ভাগ করে নেওয়া মানায় না। নিজের অংশের থেকেও অপরকে তুলে দিতে দিতে নিজেই কখন নিঃস্ব হয়ে যাই বোঝা যায় না....
      ধুস্! প্রবন্ধ লিখছি নাকি? কী সব ভাবছি! বয়স্কদের মত দুঃখ বিলাস! ওইদিক থেকে দেখলে হয়ত দোষ আমারও ছিল। কিন্তু....তবে তো বললেই হত, সরে আসতাম আমি। 
      "কী গো ভাই ঘুমোলে নাকি"
      (সখি হম কবহুঁ ন অভিসারে জাউঁ
       দুখ লাজ এতক সহ নাহি পাউঁ)
     "হ্যাঁ কী বলছেন?"
      (কান থেকে হেড ফোন খুলে)
     "বলছি ঘুমোলে নাকি!"
     "না না। কোথায় এল দাদা, আর কতক্ষণ? "
     "এই তো সবে ভাণ্ডারহাটি....এখনো বসো, রাস্তা তো ফাঁকা, চাপ নেই...."
 
      মাফলারটা ফাঁক করে মুখে খৈনি গুঁজে কন্ডাক্টর চলে গেল। দাদু এই সময় পাশ ফিরে শুল। যাক্, লোকটা বেঁচে আছে তবে! উফ্। প্রচণ্ড শীত করছে। যতটা না বাইরে তার চেয়ে শরীরের ভেতর থেকে যেন উঠে আসছে ঠাণ্ডা। হুডির হাতাটা নামিয়ে নিলাম। ব্যাগের চেনটা খুলে এক থোকা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল, হুমমম্, মা বলেছিল চাদরটা আনতে। আনলেই ভালো করতাম। আসলে শরীর সুস্থ থাকলে কিছুই পাত্তা দিই না, আর এদিকে অল্পেই কাবু...হমঃ হাঃ হাঃ কী যে হবে আমার।
   
    "ফির আজু মোহন অভিসারে জাউঁ
     সখি বোল এতক দুখ কহাঁ পাউঁ"
    (হেডফোনে শেষ লাইনগুলো শুনতে পেলাম)

    মনে পড়ছে! মনে পড়ছে! কিন্তু চাইছিনা। আপেক্ষিক বিশ্বাসভাঙার আশঙ্কায় যখন ছেড়ে এসেছি সেই পাহাড়ী নদী পাড়, শুনছি আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়, বরং অনেক অনেক দিন আগে থেকেই...যাক্। আর ভাবব না।
    পরের গানটা চালু হতে সময় নিচ্ছে। প্লে মিউজিকে এই একটা সমস্যা। কোনো কোনো গানের শেষে সাইলেন্ট একটা ফেজ থাকে। 
    মনে পড়ছে লাস্ট ইয়ার। ক্যাম্পাসিং, বন্ধুর মোবাইল আমার হাতে। সে গেছে ভেতরে ইন্টারভিউতে....হাত লেগে হোয়্যাটস অ্যাপ খুলে গিয়েছিল। একটা গ্রুপ। তিনজনের। কখনো আমি এসব করিনা। কিন্তু কৌতুহল বড় বালাই। একটা অদ্ভূত নাম, আমার ছবি দেওয়া ডিপি...
   চ্যাট বক্স খুলে দেখলাম। 
   উফফফ্। আর সহ্য হচ্ছেনা ঠাণ্ডা। বাসের বাঁকে বাঁকে শীতার্ত করে দিচ্ছে আমাকে। ব্যাগটা সামনে গলিয়ে জড়িয়ে বসলাম। গা গুলিয়ে উঠছে। কান থেকে খুললাম হেডফোনটা। জলের বোতল থেকে একটু ঠাণ্ডা জল, কোনটা বেশি শীতল জানিনা। জল, নাকি ওয়েদার না স্মৃতি....
   "আরে আজকে কী বলছে জানিস?"
    (তার নাম)
   "কে সেই মালটা ? বল বল....(চারটে হাসির ইমোজি)
    (সেই নাম। ওহহহ সেই নামমম্)
    আমাদের যত নিজস্ব ছিল, সবকে দেখলাম উন্মুক্ত, উলঙ্গ। আমার মনের ভাবের এরকম মানহানি কখনো দেখিনি। ঝাপসা হয়ে এল শুকনো চোখদুটো, নাহ্ হাওয়াটা একটু বেশিই ঢুকছে। সিট বদলালে আবার ঠাণ্ডায় বসতে হবে, আর একটু নীচু হয়ে বসলাম। কাঁটা দিয়ে উঠল গায়ে। অপমানে, অসম্মানে, রাগে, ঘেন্নায়(ঘৃণা কথাটা বড্ড পোলাইট)! আমাদের যতকিছু নিজের ছিল, সবকে আমার করে বিবস্ত্র করা হচ্ছে আমার সামনে....
    বরাবর আমি মনের ওপর দিয়েই চলি। একজন টিচারকে ডেকে মোবাইলটা তার জিম্মায় দিয়ে, শরীর খারাপের অজুহাতে বেরিয়ে গিয়েছিলাম কলেজ থেকে...সেদিনও এমনি শীত করেছিল। মনে হয়েছিল বারবার স্নান করে আসি। এ কাদা ধোবে না, বাড়ি ফিরেছিলাম অনেক ঘুরে, গায়ে জ্বর নিয়ে...বিশ্বাস জিনিসটা বড্ড কাচের, ছোঁয়াতেই ঝনঝন করে ওঠে, ভাঙা ভাঙা প্রতিচ্ছবি দেখা যায় নিজের। যেমন সকালের শিশির হাজার সূর্য লুকিয়ে রাখে তেমনি অজস্র আমি লুকিয়ে থাকে ওই কাচটার ভেতরে।
      উঠে পড়লাম। এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করলাম দুবার। ফাঁকা ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটছে বাস। কন্ডাক্টর ঝিমোচ্ছে। ঘুরেও দেখল না আমার দিকে। নাহ্। মাথাটা জোরে জোরে ঝাঁকিয়ে নিলাম বার তিনেক। কানে আবার হেডফোন দিয়ে বসলাম।
রবীন্দ্রনাথ।
হেমন্ত মুখার্জি।
সুর।
কথা।
ভাবনা।

     "এই করেছো ভালো নিঠুর হে 
      এই করেছ ভালো....."

    চোখ বুজে এল। আরামে। ক্লান্তিতে। শীতে। 

  একটা মাঠ। বিরাট। বিশাল। সবুজ চারিদিক। শুধু মাঝে হলদে একটু। খেলা হচ্ছে। একটু দূরে কতগুলো ছেলে মেয়ে একসাথে নাচছে হাত ধরাধরি করে। আমি বেশ দূরেই দাঁড়িয়েছি। খানিকটা ইচ্ছে করেই। ওদের জীবনের কোনো আঁচ যেন ছুঁয়ে না ফেলে আমাকে। আমি বোঝা নিতে, দায়িত্ব নিতে ভীতু। কঠিন বৃষ্টিহীনা মেঘ আর ভেঙে পড়ার ভয় সব সময় সব সময়। ভয় করে। শীত করে। কিন্তু কোথাও একফোঁটা অনিশ্চয়তার নীলচে নেই, সব উজ্জ্বল সবুজ, অগোছালো হলদে আভা আভা নিয়ে। 
    
"শোনো কোনো একদিন আকাশ বাতাস জুড়ে রিমঝিম বরষায়...."
  
   হঠাৎ আমার মাথায় কৃষ্ণকালো মেঘ। ঝরে পড়ছে অবিরাম বারিধারা। ওই ছেলেমেয়ে গুলো ছুটে এল, 
     আপনি রফা করে দিন, মিটিয়ে দিন ঝামেলা, please"
     "আমি?"
     হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি তো। আপনিই তো। ওই আপনার মাথার ওপর গুরু গুরু মেঘভাঙা জল....
     "ঠিকাছে, তবে, আমার একটা শর্ত আছে, ওই যে মেয়েটা, হরিণী চোখ, ওকে আমার সাথে দিতে হবে।"
     হইহই করে উঠল ঘাস, মেঘ, মাঠ, গাছপালা, ছেলেমেয়ের দল। শুধু তার চোখ দুটো নামানো নীচে। মুখে লেগে আছে হাল্কা ওম। হাল্কা উষ্ণতা। 
     দুম করে একটা রেল স্টেশন। তাকে খুঁজছি জানি। 
এদিক।
ওদিক।
ভিড়।
খুব লোক।
ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম।
গায়ে 'কনে দেখা আলো', মুখে ইষৎ প্রশান্তি। সে দেখেছে আমায়। আপাত চাঞ্চল্য ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে গভীর কালো চোখ। তার বিশ্বাস। হাল্কা মেঘ। দূরে সাদা সাদা ধূসর কিছু একতলা-তেতলা। আমায় দেখে হাসিচাপা মুখে মেঘ দেখছে...

"আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ"

    আমি টিকিট ঘরে দাঁড়িয়ে, ওর জন্য টিকিট কাটতে হবে। অদ্ভূত একটা দায়িত্ববোধ ফুটে ফুটে উঠছে যেন দূরে মনের কোনো গাছে। তার সঙ্গে একটা প্রশান্তি। নিশ্চিন্ততা। কোনো দায় নয়। অবিশ্বাস নয়। বোঝানয়।
    "এদিকে এসো, ট্রেন আসছে যে!"
     চুপ। দাঁড়িয়ে আছে। হাসি লেগে মুখে।
    "না না। দাঁড়াও। আমিই যাচ্ছি।"
 
     ট্রেন ঢুকে এল। রোদ ছিটকে পড়ল, লাইনে কেটে। কিছুটা আমার দিকে কিছুটা ওর দিকে। মাঝে ছুটে গেল ট্রেনটা।
     হালকা রোদ। দুটো মুখ আরও কাছাকাছি। বেশ কাছাকাছি। তবে কি এই সেই? 

    "আরে ও ভাই! ওঠো ওঠো!"
    কন্ডাক্টর ডাকছে ঝুঁকে পড়ে। চোখ খুলে দেখলাম ওর মাফলার ঘেরা মুখটা। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি দাদু কখন নেমে গেছে, জানিইনা। নেমে পড়লাম। নেমেই বুঝেছি বেশ দূরেই নামিয়েছে। 

"পুবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে,
ধানের খেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে
আমিই জানি আর জানে সে মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ"

   এইকটা কথা বাজতে বাজতেই বাস থেকে নেমে আসা। বাসের ছেড়ে চলে যাওয়া। মিলিয়ে গেল সামনের জঙ্গলের বাঁকে। গান বন্ধ।   
    ভাবতে লাগলাম, এটা কী দেখলাম আমি তবে কী.....।
    দুটো গানের মাঝের শূন্যতা এসে ঘিরেছে চারপাশ। সেই শূন্যতা। আবার। আমার আর আশা করা উচিত নয়! সামনে অনেকটা রাস্তা। মনে সদ্য স্বপ্নের আভাস, বুকের কাছে সেই অপেক্ষমান আকাশমণীর পাতা! জ্বরের ঘোর ছেড়ে এবার আবেশ এসেছে। এ ভালোও লাগে আবার কষ্টও দেয়। পা বাড়ালাম, পৌঁছব কতদূর জানিনা। কী হবে জানিনা। পরের গানটা বেজে উঠল খুব ভেতর থেকেই যেন.....

 "এই মণিহার আমার 
   নাহি সাজে......" ।।
    
                                    


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন