দোঁহা

হাসুন : কিন্তু গড়িয়ে পড়বেন না


মালবিকা মিত্র
ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তাঁর "ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা" গ্রন্থে ধনতন্ত্রে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন।ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা ছিল খুবই কঠিন এবং দুর্দশাপূর্ণ, বিশেষ করে শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী কালে। এই সময়ে শ্রমিকরা দীর্ঘ সময় ধরে কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হত, এবং তাদের জীবনযাত্রার মান ছিল খুবই নিম্নমানের। এই শ্রমিকদের মধ্যে শিশুশ্রমও প্রচলিত ছিল, এবং কাজের পরিবেশ ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক। তিনি ইংল্যান্ডের শিল্প শহরগুলোতে শ্রমিকদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখেছিলেন এবং এই বিষয়ে একটি বিস্তারিত গবেষণা চিত্রায়িত করেছিলেন। এই গ্রন্থে, এঙ্গেলস যে বিষয়গুলির উপর আলোকপাত করেছেন:
কাজের পরিবেশ: শ্রমিকরা কল-কারখানায় খুবই খারাপ পরিবেশে কাজ করত। দীর্ঘ কাজের সময়, কম মজুরি এবং বিপজ্জনক কাজের পরিবেশ, ছিল সাধারণ চিত্র। কর্মক্ষেত্রে কোনো নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ছিল না। দুর্ঘটনা ছিল নিত্যসঙ্গী। 
জীবনযাত্রার মান: শ্রমিকদের আবাসন ছিল খুবই খারাপ, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। কার্যতঃ দুই সারি কুঠুরির মধ্যে অপ্রশস্ত রাস্তাটি ছিল নর্দমা বা নিকাশি ব্যবস্থা। বিশুদ্ধ পানিয় জল ও সুসম খাবারের অভাব ছিল। তাদের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগও ছিল না। এরই অনুসারী হয়েছিল সাধারণ স্বাস্থ্যের মান, অসুখ বিসুখ, অপুষ্টি, টিউবারকুলোসিস, সিলিকোসিস, লেপ্রোসি, এসব ছিল নিত্য সঙ্গী। 
সামাজিক সমস্যা: শ্রমিকশ্রেণী প্রায়শই রাস্তায় বাস করত এবং তাদের প্রয়োজনীয় কাজ খুঁজে পেতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হত। সামাজিক বৈষম্য ছিল ব্যাপক। অসংখ্য ঠাঁইনাড়া ভবঘুরে, ভিখারি দেখা যেতো। প্রবল শীতে কর্মচ্যুত ও কর্মহীন ভবঘুরের দলের সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক আশ্রয় ছিল জেলখানা। 
বর্ণনার খুঁটিনাটি পাঠ করলে দম বন্ধ হয়ে আসে। তথ্য দিয়ে যথার্থতা সহ এক নির্মম অমানবিক চিত্র পরিবেশন। পাঠ করার পর গলার কাছে একটা দলা পাকানো কষ্ট অনুভূত হয়। এ হলো নির্মম বাস্তবতা। 
এবার দৃশ্যপট পাল্টানো যাক। চোখ রাখা যাক পর্দায়। কারখানার ভোঁ বাজার শব্দ, সমগ্র পর্দা জুড়ে কিলবিল কিলবিল করছে কিছু বিন্দুবৎ পোকার মত জীব। ক্যামেরা আরেকটু ফোকাস করার পর সেগুলো হাজার হাজার ভেড়ার পাল বলে মনে হয়। তারপর আরো ক্লোজ শটে দেখা গেল তারা কারখানার মজুর। এই একটি শট বুঝিয়ে দেয় উন্নত ধনতন্ত্রে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থার চিত্রটি ( চার্লি চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমস )। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা সমগ্র উৎপাদনের একটি ক্ষুদ্র অংশ শ্রমিকরা সম্পাদন করে। সমগ্র উৎপাদনের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই, কোন ধারণাও নেই। সে যান্ত্রিকভাবে একটি ক্ষুদ্র অংশের কাজ পুনরাবৃত্তি করে চলে। ফলে সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে সে বিচ্ছিন্ন। বিরক্তিকর একঘেয়েমির শিকার। সেই বিচ্ছিন্নতা বশত ও একঘেয়েমি বশত আমরা দেখেছি সারাক্ষণ নাট টাইট দিতে দিতে মজুর নিজের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্মে রাস্তাঘাটে আচরণে তার দুটি হাত সর্বদাই শ্যাডো প্র্যাকটিস করে, নাট টাইট দিয়ে চলে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা যে এলিয়নেশান বা বিচ্ছিন্নতা জন্ম দেয়, সেই তথ্যটি অত্যন্ত সহজেই চার্লি চ্যাপলিন গলা দিয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছে দেন। চার্লির এই রস টিই হাস্যরস, নবরসের একটি। 
বিচ্ছিন্নতা বহুবিধ। ধরা যাক প্রাক ধনতান্ত্রিক উৎপাদনে উৎপাদনের উপকরণ, শ্রম, কলা কৌশল, কাঁচা মাল এসবের মালিক ছিল উৎপাদক। উৎপাদিত পণ্যের মালিকও ছিল সে নিজে। কিন্তু আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিক শুধুই শ্রম বা মেহনতের মালিক। কি উৎপাদন হবে, কোথায় উৎপাদন যাবে,  কে ভোগ করবে, কত দামে বিক্রি হবে, এসব কিছুই সে জানে না। সে শুধু একটি মজুরির বিনিময়ে নির্দিষ্ট একটি শ্রম দিয়ে চলে পৌনঃপুনিকভাবে। এও তো এক বিচ্ছিন্নতা। পুঁজিবাদ প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকার জন্য প্রতিনিয়তই যন্ত্রকে আধুনিক করে তোলে। নতুন নতুন যন্ত্রের আমদানি করে। একটু অনাধুনিক হলেই অন্য শিল্পপতি প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে। তারই এক নির্মম, অথচ হাস্যরসে সিক্ত দৃশ্য দেখতে পাই,  নতুন মেশিনে শ্রমিকদের খাওয়ানোর আয়োজনে। মেশিন সাপ্লায়ার চার্লিকে সিটিং স্পটে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে মেশিনে লাঞ্চ করানোর ডেমোনস্ট্রেশন দিচ্ছেন। সেই মেশিনের বিভ্রাটে কি বিপদজনক পরিস্থিতি হতে পারে তার রূঢ় সত্য আমরা প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু তা হাস্যরসে সিক্ত। 
মেশিনে কাজ করতে গিয়ে কত শত সহস্র শ্রমিকের হাত-পা অঙ্গহানি এমনকি জীবনহানি ঘটেছে। অথচ একটু খরচ করে শিল্প মালিক যদি কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়, তাহলে দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। প্রশ্ন হল নিরাপত্তার খরচ বাড়লে মুনাফা কমবে। মডার্ন টাইমস সিনেমা এমনই নির্মম দৃশ্য উপস্থাপন করেছে, হাস্যরসের মাধ্যমে। যেখানে চার্লি মেশিনের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে চলেছেন। আধমরা অবস্থায় বেরিয়ে আসছে। 
আবার ভাবুন যে সময় ইউরোপ ও আমেরিকা ভূত দেখছে, কমিউনিজমের ভূত যত্রতত্র কমিউনিস্ট সন্দেহ করে তাদের জেলে পুড়ছে। ফাঁসিতে চড়াচ্ছে সাক্কো ভাঞ্জেত্তি র কাহিনী, রোজেনবার্গ দম্পতির কাহিনী, সেই ম্যাকার্থি রেজিম, পড়তে গিয়ে আমাদের শিউরে উঠতে হয়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পড়া শেষ করতে পারিনা। কত নিরীহ সাদামাটা মানুষকে কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রকারী আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয়। ঠিক এমনই সময়টি আমরা দেখতে পাই  চার্লির ছবিতে : ভবঘুরে চার্লি পথে চলেছেন। সেই সময় একটি ট্রাকে করে বেশ কিছু লোহার রড জাতীয় সামগ্রী যাচ্ছে পথ দিয়ে। লোহার রডের বাড়তি, বেরিয়ে থাকা অংশে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, তাই একটি লাল কাপড়ের বিপদের নিশানা টাঙ্গানো আছে। হঠাৎই সে কাপড়টি রড থেকে খুলে রাস্তায় পড়ে যায়। এবার চার্লি সেই লাল কাপড়টি নিয়ে গাড়ির পেছন পেছন ছুটতে থাকে। ড্রাইভারকে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। আর সেই সময় একদল পুলিশ লাল ঝান্ডা হাতে দৌড়াতে থাকা একজন কমিউনিস্টকে প্রত্যক্ষ করে চার্লির মধ্যে। এর পরের কাহিনীতে আর ঢুকছি না। এই যে কমিউনিজমের ভূত, রজ্জুতে সর্পভ্রম বা সত্য, এটি জলবৎ সহজভাবে পরিবেশিত হয় হাস্যরসের মাধ্যমে। আমরাও সহজেই গলধঃকরন করি। 
আমরা তাত্ত্বিকভাবে বুঝি ও রাষ্ট্রের সিস্টেমের কথা বলে থাকি। লেনিন তার রাষ্ট্র ও বিপ্লবে এর বিশদ তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন। সিস্টেম মানে সরকার নয়, আইন আদালত প্রশাসন পুলিশ বিচার বিভাগ সেনাবাহিনী বিদ্যালয় পরিবার রাজনৈতিক সংস্কৃতি এসব কিছু একটা নির্দিষ্ট সুরে ও লয়ে বাঁধা। এই সুর তাল বা ছন্দ টি হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের পরিবর্তনের অর্থ এই সমগ্র ব্যবস্থার মূল সূত্র টিকে, সুর টিকে উৎপাটন করা। রাষ্ট্র ব্যবস্থা এক অদ্ভুত আপন ছন্দে চলতে থাকে। চলো সমান তালে, চলো নিয়ম মতে, ঘাড় বাঁকিও নাকো, দূরে তাকিও নাকো, এক তাসের দেশ। তারই এক কাহিনী "ছন্দ" গল্পে উপস্থিত করেছেন চার্লি চ্যাপলিন। 
একজন রাষ্ট্রদ্রোহী কবি ও বিপ্লবীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুদণ্ড রোধ করার দাবিতে সারা পৃথিবী উত্তাল। ওই বিপ্লবীর মৃত্যুদণ্ডকে বধ্যভূমিতে পরিচালনা ও সম্পাদনের দায়িত্ব পেয়েছেন যে সেনা অফিসার, সে ছিল ওই বিপ্লবীর বিদ্যালয় এর সহপাঠী। সেই অফিসারের বিশ্বাস ছিল শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রত্যাহার করবে। নির্দিষ্ট দিনে বধ্যভূমিতে দেয়ালের সাথে খুঁটিতে হাত পেছনে করে বাঁধা হলো বিপ্লবীর। অফিসারের তখনও আশা, যদি প্রত্যাহারের নির্দেশ এসে পৌঁছায়। তাই সে বিলম্বিত ও প্রলম্বিতভাবে কার্য পরিচালনা করছেন। পাঁচ জন বন্দুকধারী বিপ্লবীর সামনে দাঁড়িয়ে। অফিসার প্রথম আদেশ দিলেন "অ্যাটেনশন"। বন্দুকধারীরা জোড়া পায় সোজা হয়ে দাঁড়াল। অফিসারের নিঃশব্দ প্রতীক্ষা যদি সরকারি আদেশ এসে পৌঁছায়। অনেক বিলম্বে অফিসার দ্বিতীয় আদেশ দিলেন "শোল্ডার আর্মস"। বন্দুকধারীরা বন্দুক তুলে নিয়ে, কাঁধে ঠেকিয়ে, ট্রিগারে হাত রেখে, একটি পা সামনে এগিয়ে নিয়ে, নিশানায় স্থির করে চোখ লাগাল। আবারও অফিসারের প্রহর গণনা। ঠিক সেই সময় একটি সামরিক জিপ ধুলো উড়িয়ে পৌঁছাল বদ্ধভূমিতে। অফিসার নিজেই দৌড়ে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন সরকারি নির্দেশ এসেছে, মৃত্যুদণ্ড রদ করার। তিনি উল্লাসে উৎসাহে উত্তেজনায় বন্দুকধারীদের নির্দেশ দিলেন "স্টপ"। পাঁচ বন্দুকধারী এক সঙ্গে গুলি চালাল। কারণ সৈনিকরা একটি সিস্টেমের ছন্দে বাঁধা। এটেনশন, শোল্ডার আর্মসের পর তৃতীয় নির্দেশটি থাকে ফায়ার। অতএব স্টপ বা ফায়ার এ সবই তাদের কাছে সমার্থক। তারা ছন্দ চেনে, জানে, বোঝে। একটা সিস্টেমকে এমন ভাবে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ হাস্যরসে ভরিয়ে দেওয়া আবার একই সাথে করুণ রসে জারিয়ে নেওয়া, বাস্তবিকই দুর্লভ। 
ব্রেখটিয় স্টাইলের নাটকে দেখেছি, চাষীর ওপর পুলিশ জুলুম চালাচ্ছে। জুলুম করতে গিয়ে বেশ কিছু ডায়লগ আছে। নাটকের পরিচালক "ওস্তাদ" নাটক থামিয়ে পুলিশকে ভর্ৎসনা করছে, তুই কেন জমিদারের ডায়ালগ বলছিস। জবাবে পুলিশ বলছে ও ঠিক আছে, পুলিশ জমিদার সব একই। বলে মাথা থেকে পুলিশের টুপিটা খুলে জমিদারের ডায়ালগটি বলে দিল। কখনোবা আদালতের দৃশ্যে বিচারক অভিযুক্তকে ও সাক্ষী কে এমন সব প্রশ্ন করতে লাগলো, উকিল বলল, স্যার এগুলো আমার ডায়ালগ। এভাবে লোক দেখানো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ যে আসলে সম্পূর্ণ ঠাঁট সর্বস্ব, তা তুলে ধরা হয় নাটকে। কোথাও তাত্ত্বিক কচকচি নেই, হাস্যরসে সিক্ত, অতি সহজেই পাকস্থলীতে পৌঁছে যায়।
সুকুমার রায় বর্ণিত আদালতের সেই দৃশ্যটি একবার কল্পনা করুন।  বিচারের নামে প্রহসনকে এমন ভাবে কেউ কখনো হাজির করতে পেরেছেন কিনা জানি না। 
ছাগল বলল, “আমার সেজোমামার আধখানা কুমিরে খেয়েছিল, তাই বাকি আধখানা মরে গেল।”
আমি বললাম, “গেল তো গেল, আপদ গেল। তুমি এখন চুপ কর।”

শেয়াল জিজ্ঞাসা করল, “তুমি মোকদ্দমার কিছূ জানো?”

হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “তা আর জানি নে? একজন নালিশ করে তার একজন উকিল থাকে, আর একজনকে আসাম থেকে ধরে নিয়ে আসে, তাকে বলে আসামী। তারও একজন উকিল থাকে। এক-একদিকে দশজন করে সাক্ষী থাকে! আর একজন জজ থাকে, সে বসে-বসে ঘুমোয়।”

প্যাঁচা বলল, “কক্ষনো আমি ঘুমোচ্ছি না, আমার চোখে ব্যারাম আছে তাই চোখ বুজে আছি।”

হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “আরো অনেক জজ দেখেছি, তাদের সক্কলেরই চোখে ব্যারাম।” বলেই সে ফ্যাক্‌ফ্যাক্ করে ভয়ানক হাসতে লাগল। 

বিচার বিভাগের প্রহসনকে এমন ভাবে কশাঘাত কজন করতে পারে ! 

কিন্তু হাস্যরস গুরুপাচ্য কে লঘুপাচ্য করলেও এর বিপদের দিকটি স্মরণযোগ্য। মনে আছে আমার এলাকায় শহীদ কানাইলাল দত্তের শতবর্ষ উপলক্ষে বর্ষ ব্যাপী কিছু অনুষ্ঠানের উদ্যোগ হয়েছিল। বিভিন্ন স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের দু টাকার কুপনে অনুদান চাওয়া হয়েছিল। ক্লাসে ছাত্রীদের শহীদ কানাইলাল দত্ত সম্পর্কে কিছু কথা বলে, কুপন সংগ্রহের আবেদন করেছিলাম। সঙ্গে একটি অতিরিক্ত কথা বলেছিলাম, জানো তো কানাইলাল দত্ত ছিলেন সম্পর্কে আমাদের বড়দিমনির মামা। এরপর সন্ধ্যায় এক অভিভাবকের মুখোমুখি হতেই তার প্রশ্ন, আচ্ছা দিদিমণি আপনাদের স্কুলে বড়দিদিমনি র মামা মারা গেছে বলে দু টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে কেন? সেদিন বুঝেছিলাম সরলিকরণ বা লঘুকরণের সমস্যা, যা কিছু কঠিন ছাঁকুনিতে সব আটকে যায়। শুধু থেকে যায় লঘু রসটুকু। 

আমার বন্ধুর স্ত্রীকে বলতে শুনেছি, সে "বিটলে বামন" চার্লি চ্যাপলিনের খুবই ভক্ত। "কেমন হাসায়, আর জোকার জোকার চালচলন"। ওর চোখে মিস্টার বিন, লরেল হার্ডি আর চার্লি চ্যাপলিন সব একাকার। বুঝেছি হাস্যরসের রসটি এতই সুস্বাদু ও মুখরোচক যে, বহু দর্শক রসটুকুই আত্মস্থ করে তৃপ্ত। তখন মনে হয়, বোধ হয় করুণ রস, হাস্য রস বা আদি রস এসব কিছুর মধ্যে একটা আনুপাতিক ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। তা না থাকলে বহু ক্ষেত্রেই চ্যাপলিন হয়ে যাবেন জোকার, আর কানাইলাল হবেন বড় দিদির মামা। এখানেই লঘুরসের সমস্যা। 

মনে আছে এক বিয়ে বাড়িতে জামাই এসেছে। সকলে বরণডালা নিয়ে উপস্থিত। জামাই সারা দিন উপবাসে আছে। বরণ ডালায় নানাবিধ উপকরণের সাথে সাজানো আছে অনেক মিষ্টি। প্রথা মত শাশুড়ি মা একটি জলভরা সন্দেশ জামাইয়ের মুখে ঠেকিয়ে, সরিয়ে আনলেন। ক্ষুধার্ত জামাই বললো - মা, আমাকে পুরোটাই দিন, সবটাই খাবো। শাশুড়িও আনন্দের আতিশয্যে জল ভরা সন্দেশটি জামাইয়ের মুখে গুঁজে দিলেন। এর পরের ঘটনা ভয়ংকর। শুকনো স্পেশাল অর্ডারের অত বড় সন্দেশ, জামাইয়ের মুখে গিয়ে আটকে গেল। বিশেষত সারাদিন উপবাসের পর জামাইয়ের খাদ্যনালী শুকিয়ে কাঠ। চোখ উল্টে শ্বাস বন্ধ হয়ে জামাই প্রায় মরে মরে। এক বয়স্ক মানুষ তাড়াতাড়ি মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে, কোনোমতে মুখ থেকে কিছুটা সন্দেশ বের করে, একটু জল ঢেলে দিল। মুহূূর্তে সন্দেশ জলে সিক্ত হয়ে নরম হয়ে গলা দিয়ে নেমে গেল। এখানেই রসের গুরুত্ব। 

তবে একই সাথে মনে রাখা দরকার, যদি জলভরা সন্দেশের বদলে স্পেশাল সাইজের স্পঞ্জ রসগোল্লা দেওয়া হতো, রসের আধিক্যে শ্বাস নালিতে একই বিভ্রাট ঘটতে পারত। বহু ক্ষেত্রেই আমার অভিজ্ঞতা হল, স্থূল বিষয়টিকে যখন হাস্যরসের মাধ্যম সহজভাবে পরিবেশন করা হয়, শেষ অবধি বুঝি ব্যক্তি মানুষের হাস্যরসটুকুই স্থায়ী হয়। স্থূল বিষয়টি তার বোধ থেকে অপসৃত হয়। কিছু মানুষ দারুন সুন্দর ভিন্ন ভিন্ন হালকা ঘন সবুজ রঙের পোশাক পরে অসাধারণ শরীরী বিভঙ্গে মঞ্চে বনানী সৃষ্টি করলো। তারপর অরণ্যের ভাষাকে, তার প্রয়োজনীয়তাকে, এক একজন গাছ দর্শকের সামনে উপস্থিত করলো। দেখেছি মানুষ কিন্তু গাছেরা কি বলল, সেটার চেয়ে মানুষ দিয়ে কেমন গাছ হয়ে গেল, সেই আলোচনাতেই মগ্ন। মানুষ চমক চায়। বাহ্যিক চাকচিক্য চায়। বাহ্যটাই তার কাছে প্রাথমিক গুরুত্ব পায়। কথায় বলে "পহেলে দর্শন ধারী"। এখানে হাস্যরস নিয়ে, বিশেষত তার লঘুতা নিয়ে, আশঙ্কা থেকেই যায়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন