রাজদীপ মজুমদার
দুর্গা পুজোর আগমন মানেই শরতের কোমল মেঘের তুলোর মতো স্বপ্নিল খেলা, কাশফুল ও শিউলি ফুল বলে দেয় মা আসছে, আর কলকাতার অলি-গলি মণ্ডপ সাজাতে ব্যস্ত। কেউ দেখে না তখন সেই মুহূর্তের কষ্ট আর হাসির গল্প। অথচ সেই সংগ্রামেই গড়ে উঠে পুজোর আলো। এই গল্প সেই কথা বলবে।
আমার নাম পাচু। ক্লাবের নাম "সূর্য উদয়"। দক্ষিণ কলকাতার ৮৪ নম্বর ব্লকের বড় পুজো আমাদের। আগে বস্তি ছিল এই পাড়া, এখন প্রোমোটারের দৌলতে বড় বড় বাড়ির ভিড়ে ছোট একটা পাড়া। আমার মুদির দোকানের পাশে খাবারের দোকান। দোকানটা বড় বড় বাড়ির আশীর্বাদের জন্য বেশ চলে।
একদিন হঠাৎ চোখ গেল ক্লাব প্রেসিডেন্ট বকুদার দিকে।
"বাঁশ এইভাবে কেউ রাখে। কেউ পাত্তা দেয় না। মনে হচ্ছে, একা আমাকে সামলাতে হবে। গাড়ি কোথায় পার্ক করবো?" – চিৎকার করছেন বকুদা। পুরো নাম তন্ময় ভট্টাচার্য। তিনি ক্লাব প্রেসিডেন্ট এবং পাড়ার কাউন্সিলর।
পুজোর বাঁশ প্রায় ১৫০টির বেশি এসেছে। রাস্তার দুই পাশে সাজানো। কেউ ভাবতেই পারেনি, বকুদা তার গাড়ি নিয়ে এসে বাঁশের মাঝখানে এমনভাবে পার্ক করবেন, যেন পুজোর সবচেয়ে বড় দৃশ্য! চারদিকে বাঁশ যেন বলে, "আমি পুজোর বীর!"
ক্লাব ঘরে জায়গা নেই, তাতে রয়েছে ত্রিপল, বড় বড় পাঁচটি মাইকের চোঙ, কাপড়, প্যান্ডেল সাজানোর জিনিসপত্র, আর আলোর সরঞ্জাম।
সেই দিন সমাপ্ত হলো, কিন্তু পরের দিন শুরুতেই গণ্ডগোল। বাঁশ সোজা করতে গিয়ে টিয়ারদের জানলার কাঁচ ভেঙে গেল। একদিকে টিয়ার মা'র চিৎকার, অন্যদিকে সিএসসির ইলেকট্রিক বিভাগ তদারকি করতে এসেছে।
সবাই পরস্পরের দিকে তাকিয়ে পারমিশনের কাগজটি খুঁজতে লাগল। বকুদার মনে পড়ল, “কাগজটা তো চেনুর কাছে!” আমি দৌড়ে গেলাম চেনুর বাড়িতে, কিন্তু চেনু নেই। চেনুর মা ফোন করে কাগজটি খুঁজে দিলেন।
কাগজ হাতে ফিরতেই সামনে আরেক কান্ড—পাড়ায় পুলিশের গাড়ি।
“কেন?”—সবাই বিস্ময় চোখে।
পুলিশের ছোট বাবু বললেন, “টিয়ার মায়ের নালিশ পেয়ে এসেছি।”
শেষে টিয়ার মাকে ধৈর্যের সঙ্গে বোঝানো হলো, “ক্লাবের খরচায় জানলার কাঁচ আবার লাগানো হবে।” টিয়ার মা শান্ত হলেন। অবশেষে কেস উইথড্রল হল। প্যান্ডেলের কাজ আবার শুরু হল।
চাঁদা তোলার মজা প্রায় ধীরগতিতে হারিয়ে যায়, যেমন গঙ্গার জোয়ারে হারিয়ে যায় অজানা কথা। তবু আমাদের ক্লাবে এখনো চাঁদা তোলার ব্যবস্থা অক্ষত।
চাঁদা তুলতে গিয়ে আবার ঝামেলা। বেশির ভাগ লোক বলে, “ক্লাবের স্ক্যানার দে, জিপে করে দিচ্ছি।” কিন্তু একাউন্ট কারো মোবাইলের সঙ্গে যুক্ত নেই। শেষে গিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে একাউন্টটা কেশুদার মোবাইল নম্বরের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হলো। কেশু দা ৬০-এর উর্ধ্বে। ট্যাক্সেশন বিভাগে রিটায়ার্ড। একদম মাটির মানুষ। শুনেছি, রঞ্জি ট্রফিতে খেলার সুযোগ ছিল, কিন্তু মায়ের প্রয়াণে স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
এবার স্ক্যানার বানিয়ে চাঁদা তুলতে যাওয়া হল। কেউ দেয় ২০০০ টাকা, কেউ ২০ টাকা। তবু এই সম্পর্কটাই সবচেয়ে বড় কথা – এখনো তারা ক্লাবের সঙ্গে আছেন।
ত্রিপল লাগানোর সময় বাবুন রেগে যায়, কারণ দড়ি তার বাড়ির গ্রিলের সঙ্গে লেগেছে। প্যান্ডেলের নকশাও এলোমেলো। বকুদা বলেন, “পুজো হবে না।” এরপর কাজ আবার শুরু। বিজ্ঞাপনের লোকেরা ভুল জায়গায় ব্যানার লাগায়, খুকুর বাড়ির লোকেরা মণ্ডপ দেখতে পায় না। তাই রাহুল কাকু রেগে। মহালয়ার সকালে মণ্ডপ অসমাপ্ত। আলোর বক্সে ভুল সুইচ, টিনুর ভুল—সব বাধা পেরিয়ে প্রথমার দিন মণ্ডপ তৈরি হয়। মা দূর্গা ষষ্ঠীর দিন প্রতিষ্ঠিত হন। শুরু হয় আপনার আমার আমাদের সকলের শ্রেষ্ঠ দুর্গাপূজা উৎসব।
