সৌরভ সান্যাল
পাপ আর পুণ্য অন্যতম বহুল প্রচলিত শব্দ প্রতিটি বাঙালি তথা ভারতবাসীর জীবনে। এই বহুল প্রচলিত শব্দ দুটি এত বার শোনার পরেও এখনো এর প্রকৃত মানদণ্ড জানা হলো না। পাপ আর পুণ্য জানা না থাকলেও ন্যায় ,অন্যায় আর উপকার এর সুষ্পষ্ট ধারণা রয়েছে, কিন্তু অন্যায় আর পাপ একে অপরের পরিপূরক কিনা সেটা জানা নেই। ইচ্ছা কৃত অথবা অনিচ্ছা কৃত দুই ভাবেই অন্যায় না করার চেষ্টা করেছি আর ভবিষ্যতেও সেই চেষ্টা বজায় থাকবে বলেও আমার বিশ্বাস নিজের প্রতি। রইলো বাকি পুণ্য, নিঃশর্ত ভাবে উপকার করা আর সৎ থাকার জন্য যে নিজের প্রতি ভালো লাগা সেটা কোনো পুণ্যের থেকে কম না মনে হয়। ছোট থেকেই পরিবারে পুজো পার্বণ এর চল থাকায় আধ্যাত্মিকতার সাথে প্রথম থেকেই এক নারির টান আছেই। আধ্যাত্মিকতার এক অনাবিল আনন্দ, সেটা উপলব্ধি করতে পারলে তার থেকে ভালো কিছু হয় না। অনেক ছোট থেকেই বাবার হাত ধরে বই মেলাতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা , তখন কলকাতা বই মেলা ময়দানে অনুষ্ঠিত হতো। একে একে তার সাথে মেলা, খাদ্য মেলা, বিজ্ঞান মেলা, হস্তশিল্প মেলা, ভ্রমণ মেলা এসব এর অভিজ্ঞতা ও আছে। কিন্তু ছোট থেকেই কুম্ভ মেলার নাম আর তাকে নিয়ে তৈরি হওয়া গল্পও শুনে তৈরি হওয়া আগ্রহ জন্মেলাও যাওয়ার সুযোগ হয়ে ছিল না। দৈনিক সংবাদ পত্রের সূত্রে কুম্ভ মেলা নিয়ে প্রতিবার পড়ি আর যাওয়ায় ইচ্ছা বেড়ে যায়। কুম্ভ মেলা প্রতি ৩, ৬, ১২ বছরে পালিত হয়। কুম্ভ মেলা ভারতের চারটি তীর্থস্থানে অনুষ্ঠিত হয়: প্রয়াগরাজ (যেখানে গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতী নদীর মিলন), হরিদ্বার (গঙ্গা নদী), নাসিক (গোদাবরী নদী) এবং উজ্জয়িনী (শিপ্রা নদী)। কথিত আছে কুম্ভ মেলার প্রচলন ঐতিহ্যগতভাবে ৮ম শতাব্দীর হিন্দু দার্শনিক ও সাধু শ্রী আদি শঙ্করাচার্যের সঙ্গে যুক্ত। তিনি ভারতজুড়ে বিভিন্ন মঠ ও ধর্মীয় সমাবেশে দার্শনিক আলোচনা ও বিতর্ক চালু করার প্রচেষ্টা করেছিলেন।প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও শিলালিপিতে বার্ষিক মাঘ মেলার উল্লেখ পাওয়া যায়,যেখানে প্রতি ৬ বা ১২ বছর পর বৃহৎ সমাবেশ হত এবং একটি পবিত্র নদী বা কুণ্ডে স্নান ছিল এর মূল আচার।কুম্ভ মেলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সমাবেশ হিসেবে পরিচিত এবং "বিশ্বের সবচেয়ে বড় তীর্থযাত্রীদের সমাবেশ" বলা হয়।ইউনেস্কো এটিকে পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এরকম এক আনুষ্ঠানিক সমাবেশ থেকে বঞ্চিত থাকতে মন চায়নি।প্রতি তিন বছর অন্তর (কুম্ভ মেলা), প্রতি ছয় বছর অন্তর (অর্ধ কুম্ভ মেলা),প্রতি বারো বছর (পূর্ণ কুম্ভ মেলা) আর প্রতি ১৪৪ বছর পর (মহা কুম্ভ মেলা)। বাকি সব কুম্ভ তে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও মহা কুম্ভের সুযোগ এই জীবনে আসবে না, কুম্ভ মেলা তে যদি যেতেই হয় তাহলে মহা কুম্ভ মেলা তে যাবো মনস্থির করে ফেলি। কিছু বন্ধুর সাথে কথা হয়, যেতে রাজি ও হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাদের হওয়া পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। অবশেষে এক বন্ধুর সাথে ঠিক হয় যাওয়ার। কিন্তু ট্রেনের টিকিট নেই, এক দাদার কাছে যাই যদি সে টিকিট করে দিতে পারে। কিন্তু ট্রেনের টিকিট পাওয়া নিয়ে সংশয়ে দেখা দেয়। কথায় কথায় জানতে পারি ওই দাদা আর ও জনা কয়েক পরিবার ছোট বাস নিয়ে যাওয়ার ঠিক করেছে। আমার সেই বন্ধুর ওই সময় যাওয়া হবে না, আর ও যখন যেতে পারবে আমার হবে না এই ধন্দে আমি একা বেরিয়ে পরি। একা এই কারনেই ওই বাস এর আমি কাউ কে চিনতাম না, এমনকি সেই দাদা কেও। শুধু মাত্র যাওয়ার তীব্র বাসনায় একা বেরিয়ে পরি। রবিবার ০৯.০২.২০২৫ রাত ১১.৩০ টাই আমরা রওনা হই, রাতে যাত্রা পথে ভালই যাওয়া হচ্ছিল। বাধ সাধলো ভোর থেকে যখন ঝাড়খণ্ড পৌছানো হলো। রাস্তায় তিল ধারণের জায়গা নেই, না কোনো গাড়ি আস্তে পারছে না যেতে পারছে। এদিক ওদিক করে এগিয়ে চলে আমরা দুপুরে এক ধাবাতে লাঞ্চ সারলাম ভেজ থালি দিয়ে ভাত , রুটি, ডাল,ভাজা, দুরকম সবজি আর আচার। যাত্রা পথে সব খানেই এই মেনু ই পেয়েছি আর না হয় পুরি। আমরা যানজট ঠেলে এগোতে লাগলাম, বিহার পৌঁছাতে রাস্তা অনেক টাই যানজট হিন পেয়েছি, টোল ছাড়া খুব যানজট ছিল না, উত্তর প্রদেশ ঢুকতে আবার যানজট এ পড়লাম। ১০.০২.২০২৫ সোমবার আমাদের রাস্তাতে কেটে গেলো, অবশেষে মঙ্গল বার ১১.০২.২০২৫ ভোর ৪ টে নাগাদ পৌছালাম মেলার অন্যতম পার্কিং হাইটেক সিটি তে। ভোরে ঠান্ডা ভালই ছিল, গাড়ির ভিতরে অনুভব হয়নি । নামতেই ঠান্ডা জাকিয়ে ধরেছে, আমরা অটো, মিনিডোর এসব করে এগিয়ে চললাম ভিতরের রাস্তা দিয়ে। গাড়ি কিছু দূর গিয়ে থামলো, তারপর নো এন্ট্রি জোন, মানুষ ছাড়া যানবাহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সেখান থেকে হেঁটে এগোতে লাগলাম ঘাটের দিকে, ঘাটে পৌঁছে ওখান থেকে টোটো করে নামলাম ২৮ নং গেট পিপা পুল, বাকি সব কাছাকাছি পিপা পুল বন্ধ ছিল। আমাদের সাথে একজন এর এক মহারাজ এর শিবির এ পরিচয় ছিল, সবাই ওনার সাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই শিবির চিনে পৌঁছাতে আমাদের মেলা ঘোরা হয়ে গেলো, এত টাই ঘুরে যেতে হয়েছে। যাওয়ার পথে নাবালক দুই বালক কে রাম, লক্ষণ স্বরুপ সেজে থাকতে দেখলাম, যাওয়ার পথে সোশ্যাল মিডিয়ার বিখ্যাত কাঁটা বাবা এর সাথে সাক্ষাৎ হলো, বহু সাধু, বাবা, মহারাজ এর দর্শন হলো, আমাদের এখানের মতো ওখানেও মেলা তে দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে খেলা দেখাচ্ছে চোখে পড়ল, কত মালার দোকান, এইরকম ই একটি মালা বিক্রি করতে করতে একজন সিনেমা তে সুযোগ পেয়ে গেলো। এসব দেখতে আর ভাবতে ভাবতে আমরা সেই শিবির এ এসে পৌছালাম। কিছু জনে ওই শিবিরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো আর আমরা অন্য শিবির খুঁজতে লাগলাম। এই শিবির টি ২০ নং সেক্টর । আমাদের ইচ্ছা ছিল এরিয়েল ঘাট এর কাছে থাকার, যাতে বোট করে সঙ্গম যাওয়া যায় ভিড় এড়িয়ে, কিন্তু কাছের সেই পিপাপুল তখন বন্ধ থাকায় আমরা মেলার মাঝেই অন্য শিবির খুঁজতে থাকি এবং পেয়েও যাই এক মহারাজের শিবির। আমাদের শিবির টি ছিল ১৯ নং. সেক্টরে, মাথা পিছু টাকার বিনিময়ে আমাদের একটি তাবু সাথে দুই বেলার প্রসাদ দেবে এই ঠিক হোলো, তাবু টি এত বড় তাতে ২৫-৩০ জন আরামসে থাকতে পারবে। বেশিরভাগ বড় শিবির গুলো যত টা যায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা, আমাদের কলকাতা তে একেকটা মেলা হয়ে যাবে। আমাদের শিবির এ অনেক গুলো তাবু, সাথে ভজন কীর্তন নাম করার সুবিশাল যায়গা, প্রসাদ বিতরণ এর যায়গা। শিবির এর চারপাশ অস্থায়ী বেরা দিয়ে ঘেরা, প্রধান ফটক এর সামনে পুলিশ, নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন ছিল। শিবিরে ঢুকে যখন স্নান করে প্রসাদ গ্রহণ করলাম দুপুর ২ টো বেজে গেছে। তাবুর সবাই হয় নিদ্রাচ্ছন্ন না হয় বিশ্রামে। আমি ১-১.৩০ ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে একা বেরিয়ে পড়লাম মেলা ঘুরতে। বেরোনোর সময়ে সহযাত্রী এক দাদা বললো, এটা কিন্তু সাধারণ মেলা না। মানুষ হারাতে না চাইলেও হারিয়ে যায়, তুমি তো একা ই যাচ্ছ, কিছু হলে তো বাড়িতেও জানাতে পারবো না কিছুই জানি না তোমার বাড়ীর ব্যাপারে। আমি শুধু এই টুকু ই বলি, আমি চলে যাবো ঠিক, শুধু আমায় রেখে গাড়ি ছেড়ো না। ওখানের এক পুলিশ আধিকারিক এর থেকে রাস্তা জেনে বেরিয়ে পরি। পড়নে ছিল গেরুয়া পাঞ্জবি আর গেরুয়া ধুতি, খুব সখ করে কেনা। ওটা পরে লজ্জার সম্মুখীন হব বুঝতে পারিনি। মহারাজ, সাধু,বাবা হওয়া এত সোজা না, অনেক ত্যাগ স্বীকার করলে একজন সেই পর্যায় পৌঁছায়, আর আমি শুধু মাত্র এক পোশাক পরে মানুষের থেকে মহারাজ শুনতে চায়নি। সারা রাস্তা লোকে মহারাজ ই ভেবেছে আর আমায় তিথি, সঙ্গম ঘাট, আরতি এসব নিয়ে প্রশ্ন করেছে আর হয় মহারাজ না হয় বাবা সম্বোধন করেছে আর আমার তাদের ভুল ভাঙাতে হয়েছে। মজার হয়েছে যখন আমি এক পুলিশ কে হিন্দি তে সঙ্গম ঘাট এর রাস্তা জানতে চেয়ে এগিয়ে যাই আর দুই বাঙালি ভদ্র লোক কে বলতে শুনি আমার পিছনে, " মহারাজের পিছনে পিছনে চল, এনারা ভুল জায়গায় স্নান করবে না, সঙ্গম ঘাট এই করবে" আমি তাদের ভুল শুধরে নিজের গন্তব্যে এগোই। প্রথমে মেলার মুল ফটক এ পৌঁছাই সাধু সন্যাসী দের শিবির, আঁখরা দর্শন করতে করতে। বিখ্যাত লেটে হনুমান মন্দির দর্শন এ গিয়ে সুবিশাল লাইন দেখে যখন চিন্তিত তখন ৪.১৫ বাজে বিকাল, মন্দির দর্শন করতে পারে যায় ৪.৩০ থেকে। অবশেষে মন্দির দর্শন করে বেরিয়ে আসি, ওখানে সব ভালো কিন্তু মন্দির এর চত্বরে জুতো রাখবার কোনো ব্যবস্থা নেই, জুতো ভগবান ভরসায় রাস্তায় রেখেই যেতে হয়।মন্দির দর্শন করে যখন বেরোচ্ছি জুতোর মায়া ত্যাগ করেছি, কিন্তু ভগবান এর কৃপায় বহু খুঁজে জুতো পাই। শঙ্করাচার্য মন্দির, রাম মন্দির দর্শন করে আমি সঙ্গম ঘাট এর পথ ধরি। এখানে এক সাংবাদিক ও আমায় মহারাজ ভেবে ভুল করে ও সাক্ষাৎকার নিতে এগিয়ে আসে, তার ও ভুল শুধরে হাসতে হাসতে এগিয়ে যাই সঙ্গম এর পথে। এত বড় মেলা তে কোথায় সন্ধ্যা আরতি হচ্ছে অথবা হয় খুঁজে পাওয়া কঠিন, ভাগ্যের সাহায্যে আমি যাওয়ার পথে সন্ধ্যা আরতি ও দেখতে পাই। সন্ধ্যা আরতি দেখে আবার সঙ্গম ঘাট যাওয়ার পথ খুঁজতে খুঁজতে সঙ্গম ঘাট পৌঁছাই। পরিকল্পনা ছিল বুধবার ১২.০২.২০২৫ ভোরে স্নান করব মাঘী পূর্ণিমা শাহী স্নান এ। মঙ্গলবার স্নান করার পরিকল্পনা ছিল না আমার। কিন্তু আমাদের শিবির থেকে সঙ্গম ঘাট এর দূরত্ব আর সকালের ভিড় এর কথা ভেবে মোবাইল এ চেক করি মাঘী পূর্ণিমা তিথি কখন লাগছে, দেখলাম ১১.০২.২০২৫ সন্ধ্যা ৬.৫৫ তে লাগছে আর আমার ঘড়িতে ৭ টা বেজে গেছে তখন। সেই মুহূর্তেই স্নান সেরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, এক ভদ্র লোক কে বলে তার কাছে ধুতি, পাঞ্জাবি রেখে মোবাইল,টাকা সব সমেত ই স্নান করি। আমাদের মনের নোংরা , আর কৃত কর্মের ফল বাইরের শত ডুব দিয়ে ধুয়ে ফেলা যায় না বলেই আমার ধারণা, কিন্তু সেই সন্ধ্যা বেলা সঙ্গম এ ডুব দিয়ে যে অনুভূতি হয়েছে ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন আমার কাছে। অনেক গ্লানি,না পাওয়ার বেদনা,হতাশা ,দুঃখ , পরিজনের দূরত্ব, প্রিয়জন কে হারানো সব কিছু দূরে রেখে কিছুক্ষন এর জন্য নিজেকে অনেক হালকা মনে হলো, ওই সময় টা শুধু আমি নিজে কে অনুভব করতে পারছিলাম, এত ভিড় এও নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম, এক অনাবিল তৃপ্তি। স্নান সেরে সেই ভদ্রলোক এর সাথে দেখা, ভদ্র লোক স্নান এ যাচ্ছিলেন আর ওনার সাথে যারা আছেন তারা অপেক্ষা করছেন, ওনাদের নিউ টাউন এ বাড়ী কলকাতার। আমি ওনাদের ধন্যবাদ আর যাত্রা পথের শুভেচ্ছা জানিয়ে এগোতে গিয়ে মনে হলো, সঙ্গম এর প্রধান ঘাট যতো দূরে পরের দিন ওই ভিড়ে শিবির থেকে এত দূর এসে জল ভরা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। এক মহিলা দেখি জল এর ড্রাম বিক্রি করছে , ওনার থেকে ড্রাম কিনে জল ভরতে গেলাম আবার সেই জুতো টা রাখবার অনুরোধ করে। জল নিয়ে আবার শিবির এর পথে রওনা দিলাম, ফেরার পথে অসুবিধা হয়নি।যখন শিবির এ এসে পৌছালাম ৮.৩০ টা বাজে। এসে শুনি অনেকেই স্নান করে নিয়েছে, যারা করেনি তাদের অনুরোধ করে স্নানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। রাতে প্রসাদ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । পুল এর কাছে যখন আসলাম রাত ১১ টা, আমাদের যাত্রা শুরু হল, পার্কিং এরিয়া থেকে আরো এগিয়ে গাড়ি রাখতে হয়েছে, সেটা ওই পুল থেকে প্রায় ১৭ কিমি দূরে। কাতারে কাতারে লোক, শুধু মানুষ এসে যাচ্ছে নো ভেহিকল জোন করা সব খানে। হেঁটে আমরা প্রধান রোড এ এসে পৌছালাম। গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না, বাইক পাওয়া যাচ্ছিল,কিন্তু এত জিনিস পত্র নিয়ে বাইক এ যাওয়া সম্ভব ছিল না। হঠাৎ এক দেবদূতের মতো মানুষের আগমন হয়, সে দুটো ম্যাটাডোর ঠিক করে দেয়, ওতে করে আমরা শেষের ১৩ কিমি পথ পৌঁছাই যখন ভোর ৩.৩০ টে, ১২.০২.২০২৫. আমরা রওনা দিলাম অযোধ্যার উদ্যেশ্যে। পথেই ফ্রেশ হয়ে প্রাতঃরাশ, দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা এগোতে লাগলাম । রাস্তা চওড়া আর মসৃন ভালই যাওয়া হচ্ছিল, রাস্তার বোর্ড এ দৃশ্য মান অযোধ্যা আর মাত্র ৬০ কিমি, সামনে পুলিশ ব্যারিকেড করা। আমাদের সোজা না গিয়ে ডান দিক দিয়ে যেতে হোলো গ্রামের মাঝের রাস্তা দিয়ে। দুই পাশে সরষে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে বীরজারা, দিলওয়ালে দুলানিয়া লেয়েযায়েঙ্গে সিনেমার শ্যুটিং স্পটে চলে এসেছি মনে হচ্ছিল। অযোধ্যা পৌছালাম যখন, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।টো টো করে আমরা হোটেল এ এসে উঠলাম, হোটেলের মাঝে এত সুন্দর মন্দির রাম, লক্ষণ আর সীতা মায়ের সাথে ভজন এর যায়গা। বাইরে থেকে হোটেল না ভেবে লোকে মন্দির ই ভাববে। আমরা হোটেল এ ঢুকে ফ্রেশ হয়ে স্নান করে চা খেলাম। আহা চা টা এত ভালো ছিল সারাদিনের ক্লান্তি কাটিয়ে দিলো। ওখানের সব খানেই একটা জিনিস কমন, চা তে অস্বাভাবিক মিষ্টি দিয়ে থাকে। ঘড়িতে দেখলাম সন্ধ্যা ৭.৩০ টা বাজে, ঘুরতে গিয়ে এমনি সময় কম আর বিশ্রাম নেওয়ার পক্ষপাতী আমি নই। আবার একা বেরিয়ে পড়লাম, সেই সহযাত্রী দাদা আবার বলল, "অচেনা যায়গা চিনে আসতে পারবে তো? বুঝে শুনে তারপর যাও"। আমি লোকেশন সেভ করে বেরিয়ে পড়লাম অযোধ্যার পরিদর্শন করব বলে, রাম লালার দর্শন পরের দিন করবো, কিন্তু এরা অন্য কিছু দেখবে কিনা সন্দেহ ছিলো, একা ই ভরসা, ফোন এ চার্জ টা ফুল করে নিলাম ফোটো তোলার জন্য। অযোধ্যার পরিদর্শন এত পুরনো মন্দির পর পর , কেউ সাজিয়ে দিয়েছে মনে হবে। অন্যতম প্রাচীন নগরীর ছাপ প্রতি পদে পদে। মন্দির এর মুগ্ধ দর্শনে আমি অকাতরে ফোটো নিয়ে চলেছি। প্রথমে গেলাম অযোধ্যা ঘাট যা তুলসীদাস ঘাট নামে পরিচিত, সারি সারি নৌকা সাজানো মানুষ পুজো দিচ্ছে, প্রদীপ ভাসিয়ে দিচ্ছে জলে। পথে রামকথা পার্ক আর মেমোরিয়াল পার্ক দেখে লতা মঙ্গেশকর চক দেখলাম। রাতের খাবার খুব ভালো একটা রেস্টুরেন্ট পেলাম, ডিনার সেরে পরবর্তী গন্তব্যে এগোতে লাগলাম। প্রথমে পড়ল তুলসী দাস পার্ক, সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম হনুমান গড়ি, হনুমানজির দর্শন করে গেলাম কনক ভবন, দশরথ মহল সব দর্শন করে যখন প্রধান সড়ক এ এসে পড়লাম রাত এগোচ্ছে ঝড়ের গতিতে। কলকাতার দুর্গা পূজার লাইন এ দাঁড়িয়ে ঠাকুর দেখার অনুভূতি, সেই লাইন দিয়ে দড়ি ফেলে লোক যাচ্ছে, একবার যাওয়ার রাস্তায় ঢুকে গেল বেরোনো দুষ্কর। আমার শুধু মন বলছিল এত টা এসেছি লাইন দিয়ে, রামলালার দর্শন করব না, মন কে সায় দিয়ে প্রণাম ঠুকে রাম মন্দিরের লাইনে ঢুকে পড়লাম। দুর্গা পূজায় মাঝ রাতে অষ্টমীর অনুভূতি, শুধু স্থান ভিন্ন।
লাইনে দাঁড়িয়ে সামনে দড়ি দেওয়া, ইউ পি পুলিশ আধিকারিকরা দাঁড়িয়ে, বার বার ঘোষণা করে চলছেন আপনারা দৌড়াবেন না, এই ভাবেই এগোবেন ১০ মিনিট করে বিশ্রাম নিন, বসুন। লাইনে এর প্রথম সারিতে আমি দাঁড়িয়ে এক মাঝ বয়সী আই পি এস অফিসার এই ঘোষণা করছেন খুব হাসি মুখে, সামনের অংশের সবাইকে কে কোথা থেকে এসেছে জানতে চাইছিলেন। সবার বক্তব্য শুনে উনি নিজেই ওনার ফোন বার করে অনুমতি চেয়ে নিলেন ভিডিও করবার, ওনার বক্তব্য ছিল গোটা ভারত এই টুকু পরিসরে ওনার জীবনে আর আসবে কি না জানা নেই, তাই এই মুহূর্ত উনি বন্দী করে স্মৃতি হিসাবে রেখে দিতে চান। ক্যামেরা অন হতেই, রাজস্থান,পাটনা,ঝাঁসি,থানে, দিল্লী,কেরালা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, মনিপুর, ভুবনেশ্বর , কলকাতা একে একে পরিচয় দিতে লাগলো আমিও সেই দলে ছিলাম । লাইনে বসে কিছু রাজস্থানি মহিলা ভজন করছিল, দড়ি উঠলো এগিয়ে গেলাম মন্দিরের আরো কাছে।
মন্দির এর কাজ এখনও অনেক বাকি, যতটুকু গঠিত হয়েছে সেটাই মুগ্ধ হয়ে থাকতে হবে। পাথরে খোদাই ভাস্কর্য যা আগামীতে এক নিদর্শন হিসেবে থেকে যাবে। ঢোকার মুহূর্ত থেকে বেরোনোর মুহূর্ত জয় শ্রী রাম ধ্বনি তে মন্দির চত্বর আলাদা রূপ ধারণ করেছিল। মানুষেরা উৎসাহ উদ্দীপনায় ক্লান্তির রেশ মাত্র নেই, সবাই আনন্দিত দর্শন করতে পেরে।
রাম লালার দর্শন করে যখন মন্দির থেকে বার হচ্ছি লোকেশন প্রায় দুই কিমি হোটেলের। প্রধান রাস্তা ফেলে যখন গলি তে ঢুকলাম পুরো রাস্তায় আমি একা, কিছু দূরে দূরে যাও দু একজন চোখে পড়ছিল, কিন্তু যত এগোতে লাগলাম আমি একা ই , পথে অজস্র হনুমান ভয়ে লাগছিল, কিন্তু ভয়ে কেটে গেলো যখন দেখলাম ওরা ওদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে । দ্রুত পায়ে হেঁটে হোটেল পৌঁছে যখন রুম এ ঢুকলাম রাত ১.৩০ টা বেজে গেছে। পরের দিন ভোরে সবাই একসাথে রাম মন্দির দর্শন করতে গেলাম। হ্যাঁ, দু বার দর্শন করেছি তাও কিছু ঘণ্টার পার্থক্যে। মন ভরে দর্শন করেছি, পরের দিন সকালে ভিড় তুলনায় কম ছিল। কোনো দড়ি ছিল না, মানুষ এক বারে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মন্দির দর্শন করে বেরিয়ে আমরা মালোই খেলাম, অদ্ভুত সুন্দর খেতে। মুখে দিলে হারিয়ে যাচ্ছে, দুধ ফুটিয়ে যে ফেনা হয় সেটা জমিয়ে জমিয়ে এটা বানানো হয়। বেনারসে এটা আরো ভালো পাওয়া যায়, ওখানে গিয়ে স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছা রইলো। হোটেল ফেরার পথে এক মন্দির প্রাঙ্গণে প্রসাদ বিতরণ হচ্ছিল, আমরা প্রসাদ নিয়ে হোটেল ঢুকলাম, মার্কেট এ কিছু জিনিস কিনে ফেরার পথ ধরলাম, ঘড়িতে ১.১৬ দুপুর , তারিখ ১৩.০২.২০২৫. বৃহস্পতি বার সারাদিন গাড়িতে কাটলো। ফিরবার পথে বারাণসী যাওয়ার রাস্তা বন্ধ আর ততোধিক যানজট। আমরা অন্য পথ ধরলাম কোডার্মা হয়ে ফিরলাম। কোডার্মা হয়ে ফেরার রাস্তাটি বড় চমৎকার, সুন্দর। পুরো রাস্তা টি ছোটো ছোটো পাহাড় আর টিলায় ঘেরা, সাথে গভীর জঙ্গলে। আসার পথে এক বড় লেক এর দেখা পেলাম গভীর নীল জল, লেকের সামনে সবাই দাঁড়িয়ে ফোটো তুলে আবার ফেরার পথ ধরলাম। যাত্রার ক্লান্তি ওই নীল লেকের জল কত টা কাটাতে পেরেছি জানি না, দেখে তৃপ্তি সবাই পেয়েছে। ফেরার পথে শক্তিগর নামলাম, সেই বিখ্যাত ল্যাংচা কিনলাম বাড়ির জন্য। অনেকে সীতা ভোগ, মিহিদানা নিলো। ওখানের রসগোল্লা টা বেশ ছিল, গরম আর একদম তুলতুলে নরম। বাড়ির পথ খুব বেশি দূর নয় আর। দিল্লী রোড এর যানজট এ পড়লাম আবার, এতটা রাস্তায় একটুও বিরোক্ত হয়নি কেউ, যতটা বাড়ির কাছে এসে হলো। যানজট কাটিয়ে ৩ ঘণ্টার রাস্তা ৫ ঘণ্টার বেশি লেগে গেলো।গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি যখন ঢুকছি ১৪.০২.২০২৫ , শুক্র বার শেষ হয়ে শনি বার পরে গেছে রাত্রি ২.৩০-৩.০০ টা হবে।
এখন মানুষ অনেক যান্ত্রিক, মানবিকতা বোধ ভুলতে বসেছে, কিন্তু প্রচুর মানুষ এখন তাদের মনুষত্ব, মানবিকতা, সততা ভুলে যায়নি তার প্রমাণ এর সাক্ষী হয়েছি এই সমাবেশে। যে মানুষ টা আমার পোশাক রাখলো, যে মহিলা আমার জুতো টা রাখলো,যে পুলিশ টা আমার জুতো রেখেছে, যে মানুষ টা এসে আমাদের গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলো নৈনি যাওয়ার, অসংখ্য স্বেচ্ছা সেবক যারা বয়স্ক মানুষ দের সাহায্য করছে, কিছু বাইক আরোহী বিনা মূল্যে বয়স্ক মানুষ দের পরিষেবা দিচ্ছে, কত শিবিরে ভাণ্ডারা চলছে লাখো মানুষ প্রতিদিন প্রসাদ পাচ্ছে, প্রবল রোদে ক্লান্ত শরীর অচেনা মানুষকে জল দিয়ে সাহায্য করছে এই সব নিজের চোখে দেখা। কিছু ভালো মানুষ আছে বলে সমাজ এখন ও সঠিক পথে চলছে। কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে, কিছু মানুষ তার পরিবার প্রিয়জন হারিয়েছে, তাদের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা রইলো, এই অপূরণীয় ক্ষতি কিছুর বিনিময়ে মেটানো সম্ভব নয়। সব কিছুই হয়তো জীবনের অঙ্গ । ফিরবার পথে এসব ভাবনা সঙ্গী করে ফিরেছি, ছোট থেকে শুনে এসেছি পাপ, কাউকে ছাড়ে না। অন্যায় যদি কেউ করে, তার শাস্তি তাকে পেতেই হবে। শরীর এর ভিতরের মন অন্যায় করে, সেটা বাইরের জল দিয়ে ধোয়া যায় না কখনও। পাপ ঢাকতে বা পুণ্য অর্জনের জন্য আমি স্নান করতে আসিনি সঙ্গম এ। আমি এসেছি এই পৃথিবীর সব থেকে শান্তি পূর্ণ জমায়েত এ শরীক হতে, ১৪৪ বছর এর বিরল যোগে যোগদান করতে, সারা ভারত তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মানুষ এর আগমন দেখতে, আধ্যাত্মিকতার সাথে ভ্রমণ এর মেলবন্ধন ঘটাতে, এক ইতিহাসের সাক্ষী হতে, আমার পরিবারের প্রথম কোনো সদস্য হিসাবে কুম্ভো ভ্রমণ এর অঙ্গ হতে,। প্রতিটি মানুষের ভাষা, পোশাক পরিচ্ছদ, সামাজিক রীতি,পুজো অর্চনা আলাদা হতে পারে , কিন্তু আজ এদের সবার পরিকল্পনা ও উদ্যেশ্যে একটাই কুম্ভ স্নান। হয়তো অনেক যায়গা গিয়েছি আবার অনেক জায়গাই যেতে পারব, কিন্তু এই মহা কুম্ভ স্নান এই জীবনে একবার তার প্রত্যক্ষ করা এই জীবনে আর আসবে না, এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। একটা সঙ্গম স্থল, নদীর ধার সম্পুর্ণ ফাঁকা জায়গা একমাসের কিছু বেশি সময় এর জন্য কি করে একটা গোটা শহর এ পরিণত হয়ে যায়, এখানে এসে তার সাক্ষী হতে পেরেছি। বহু বিদেশী পুরুষ, মহিলা কে দেখেছি তারা মাঠের খালি মেঝেতে বালির উপর বসে নাগা সাধু দের পা ছুঁয়ে সামাজিক জ্ঞান নিচ্ছে, আধ্যাত্মিকতার পাঠ নিচ্ছে, আর্থিক সচ্ছল,সামাজিক বিত্তশালী পরিবারের সদস্যরা ভান্ডারা তে লম্বা লাইন দিয়ে প্রসাদ নিচ্ছে সাধারণ মানুষ দের সাথে।
কিছু অসৎ মানুষ ও এই দলে ভিড়ে আছে যারা সাধু সেজে মানুষ প্রতারণা করছে, তাদের এই জেনে করা অন্যায় বা পাপ জানি না সঙ্গম স্নান এ যাবে কি না। এই পাপ খন্ডন, পুণ্য অর্জন দূরে সরিয়ে যে আধ্যাত্মিকতার আর ভ্রমন ও একা যাত্রা পথে নিজে কে চিনবার অনাবিল অভিজ্ঞতা লাভ করেছি এই জীবনের সঞ্চয় হিসেবে থেকে হবে।
যাদের কথা না বললেই নয়, যাত্রা হয়তো একা শুরু করেছিলাম কিন্তু ফেরার পথে সেই যাত্রা আর একা হয়নি এক পরিবারের হয়ে গিয়েছিল। একা গিয়েছি ফিরেছি কিছু দাদা,ভাই এক দিদি ও দুই ভাগনা কে সঙ্গী করে। দিদির মুড়ি মাখা মনে থাকবে, এই কদিন ধরে যা মুড়ি খাওয়া হয়েছে এক বছরে এত মুড়ি খাইনি কোনো দিন। কিন্তু ওই মুড়ি মাখা সবার এত পছন্দ হয়েছে দিদি কে প্রতিদিন মাখতে হয়েছে। একসাথে খাওয়ার ভাগ করে খাওয়া, মজা করা মনে হচ্ছিল কত দিন আগে থেকে পরিচিত সবার সাথে।
যারা ঘুরতে ভালবাসে, নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চার করতে চায়, নিজেকে ফিরে পেতে চায় তাদের কাছে এই মেলা এক সংগ্রহশালা যা গোটা ভারত এর ক্ষুদ্র সংস্করণ । পুজো পদ্ধতি, ধর্মীয় আচার সব এর সারাংশ পেয়ে গেছিলাম এই কুম্ভ মেলা তে। পুন্য না হয় নাই বা হলো , সারাজীবনের যে অভিজ্ঞতার আর স্মৃতি সংগ্রহ করলাম, সেটাই বা কম কি।
