দোঁহা

স্বাধীনতা ৭৫ এবং 'বেলা সিয়াও'!

 


অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

গানটা যেন আজ প্রতিবাদেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে। প্রত্যেক গণআন্দোলনেরই প্রতীক হয়ে উঠেছে। সেই কোন কালে লেখা ইতালিয় এক লোকসঙ্গীত। ফসল কাটার গান, মাঠের মজুরদের গান। আজ সেই গান পুঁজিবাদী ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে নতুন মোড়কে ফিরে এসেও, আবারও গিয়ে মিশেছে প্রতিবাদের অঙ্গনেই। শেষ অবধি পুঁজিবাদী বিপণন জিতল, নাকি মানুষ–এই উত্তর জানাবে ভাবীকাল। আমরা এখানে তাত্ত্বিক আলোচনা করতে বসিনি। সম্প্রতি দুটি গানের ভাষা ও সুর, শব্দ ও বক্তব্য তাড়া করে ফিরেছে খুব। পরের পর হেডফোনে চালিয়ে শুনেছি, বেলা সিয়াওয়ের গান, ইন্টারন্যাশনাল... শুনেছি একাধিক ভাষাতে, একাধিক দেশের মানুষের কন্ঠে, একাধিক পরিস্থিতিতে। মনের ভিতরে মুগ্ধ হয়েছি এই ভেবেই, এই গান মানুষের কথা বলে। মানুষের প্রতিরোধের কথা বলে। স্বাধীনতা যে প্রতিরোধ ভিন্ন অর্জন করা যায় না- তাই ৭৫এর এই পূর্তিতেও, সেই প্রতিরোধের সঙ্গীতকে নিয়েই দু’চার কথা বলতে ইচ্ছে হলো। এখানে গানের ইতিহাস থাকবে না। থাকবে কেবল কিছু উপলব্ধির প্রসঙ্গ।

'বেলা সিয়াও’ এর গান প্রথম শুনেছি রবীন্দ্র সদনে। ‘মেফিস্টো’ নাটক দেখতে গিয়ে। কারণ ‘মানি হেইস্ট’ দেখবার সুযোগ হয়নি কখনও। সেই ‘মেফিস্টো’তেই প্রথম শুনলাম ‘বেলা সিয়াও’এর সুর। নেট ঘেঁটে খুঁজে বের করলাম জেএনইউয়ের আন্দোলন। সেখানেও ‘বেলা সিয়াও’। কৃষক আন্দোলনেও সেই সুর। ‘জালিম’ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের অভ্যুত্থানের গান। শেষ এই গান শুনেছি, এই লেখা লিখতে বসেছি যখন–তারও মাত্র মিনিট কয়েক আগেই। ইউটিউবের নতুন ভিডিওতে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে উত্তাল জনতার মুখে গান। আবারও ‘বেলা সিয়াও’। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন গোটাবায়া রাজাপক্ষে ও তাঁর পরিবার। শ্রীলঙ্কায় এখন নতুন স্বাধীনতার লড়াই। সেখানেও ফিরে এসেছে ইতালিয়ার গান। ফাসিবিরোধিতার সেই অন্যতম পরিচিত সুর। মুষ্টিবদ্ধ হাত।

আরেক ভিডিওতে দেখলাম ২০২০ সালের মার্চ মাস। ইতালির মানুষ তখন ভয়াবহ কোভিড মহামারীর প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। শয়ে শয়ে মানুষের মৃত্যুর খবর। কবরখানাগুলিতে কবর দেওয়ারও জায়গা নেই। সামরিক কনভয়ে চাপিয়ে শয়ে শয়ে মৃতদেহকে স্থানান্তর করা হচ্ছে এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে। সহমর্মিতায় জার্মানির মানুষেরা এগিয়ে এলেন। ব্যামবার্গ শহরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কোনও একটি এলাকার প্রতিটি বাড়ির বারান্দায়, নির্দিষ্ট এক বিকেলে সমবেত হলেন সকলে। গেয়ে উঠলেন ‘বেলা সিয়াও’! মানুষের পাশে মানুষ হয়ে দাঁড়ানোর গান। শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই গান শুনলে পরে, এই আবহকে দেখলে পরে-নিশ্চিত করেই খুশি হতেন। হয়তো বা গুরুদেবের কথা ধার করেই স্বগতোক্তিতে উচ্চারণ করতেন, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ!”

 এখন এই ৭৫এর স্বাধীনতা পেরিয়ে, কেবল সেই শেষ উক্তিটুকুর উপরেই ভরসা রাখতে চাইব। কারণ পরিস্থিতি মোটেও ভালো ঠেকছে না। রাজনৈতিক প্রসঙ্গকে সরাসরি না আনলেও, ‘অচ্ছে দিন’ যে আসেনি–সে কথা এখন আম-ভারতীয়ের কাছেই মোটামুটি পরিষ্কার। আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির এই সময়ে ‘অমৃত মহোৎসব’কে মন থেকে পালন করা চলে না। সংসদ ভবনের উপর যতই কিছু ক্ষুধার্ত সিংহকে প্রবল উদ্দীপনার সঙ্গে বিজ্ঞাপিত/প্রচারিত করা হোক না কেন, মানুষ ক্রমশই পিছু হঠতে শুরু করেছে। কিন্তু তাহলেই কি দেশ, জাতি ও সংবিধান আবারও খুব শিগগিরিই নিরাপদ অবস্থায় ফিরে আসবে? মানুষের ভোটেই কি তাহলে বিদায় নেবে এই সাম্প্রতিক সরকার ও তার কূট-প্রশাসনব্যবস্থা? গণতান্ত্রিক পরিসরে দাঁড়িয়ে মোটেও তেমনটা মনে হচ্ছে না। বিরোধীরা ছত্রভঙ্গ বললেও কম বলা হবে। সকলেই নিজেদের আখের গোছাতে উন্মুখ। কাজেই দেশ চলেছে দেশের মতো করেই। ৭৫বছর বয়সী কোনও বৃদ্ধের ক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতা-লব্ধ শান্ত, সৌম্য-ভাব লক্ষ্য করা চলে, আমাদের দেশে এখন ঠিক তার বিপরীত অবস্থা। সমস্ত কিছুতেই একটা মোচ্ছব-মার্কা ভাবের প্রচলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর ভবিষ্যৎ ভালো ঠেকছে না মোটেও।

তবুও আত্মবিশ্বাসে রয়েছে ‘বেলা সিয়াও’। অথবা তেমনই কোনও গান। মাটির মানুষ, কলের মজদুরদের গান। তারুণ্যের উদ্দীপ্ত সুর। যে গান একতা’র কথা বলে, সকলকে সাথে নেওয়ার কথা বলে। ঐক্যভিন্ন ফাসিবিরোধী সংগ্রাম অসম্ভব, সেই কথা বলে। ৭৫এর মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সততার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে যদি আমরা সত্যি করেই-মন থেকে আমাদের দেশ, জাতি ও সংবিধানকে রক্ষা করতে চাই, তাহলে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। যে কোনও মূল্যে হোক, সেই ঐক্যের কথাই আমাদেরকে বলতে হবে। ৭৫এ দাঁড়িয়ে আমাদের দায়িত্ব অনেক। সেই দায়িত্বের কথাই ‘বেলা সিয়াও’এর গান আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়।

 ...অদ্ভুৎ মনে হয় আমার। একেকটি রাজ্য, একেকটি প্রদেশ থেকে খবর আসছে, স্কুল বা কলেজে কোনও কোনও বিশেষ ধর্মের প্রার্থনাগীত বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অভিভাবকেরা নাকি আপত্তি তুলছেন। একাধিক ধর্মের তরফে এমন একাধিক পারস্পরিক অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। গানেরও আজকাল ধর্ম-রোগ দেখা দিয়েছে। এই গান আমার, আর ওই গান তোমার, মাঝখানে কাঁটাতার থাকুক –নয়া ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে এমনও দিন দেখছি। ক্লান্ত হয়ে আসছে মন। কোনও বিশেষ অভিমুখেই লেখা এগুচ্ছে না। কেবল অগোছালো মুক্তগদ্যের আঙ্গিকেই শব্দ জড়ো করে চলেছি। একদিকে গণআন্দোলনের সাফল্যকে কল্পনা করেছি, উছ্বাসের প্রাবল্য সেথায়। অন্যদিকে অদ্ভুৎ এক অন্ধকার। বিপ্লবের কোনও রঙ হয় না। বিপ্লব আসে মানুষের ইচ্ছেতেই। সেই স্রোতের বিপরীতে সবসেরা একনায়কেরাও খড়কুটোরই মতো অসহায়তায় ভেসে যেতে থাকে। অপেক্ষা কেবল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের, যেখানে আবারও মানুষ একদিন না একদিনই হঠাৎ গেয়ে উঠবে মানবতার গান-একের পাশে আরেকের দাঁড়িয়ে পড়ার গান। সেই উপলব্ধিটুকুকে নিয়েই লিখতে চেয়েছিলাম।

 অনেকে এই লেখায় স্ব-বিরোধিতার হদিস খুঁজে পেতে পারেন। ‘বিপ্লবের রঙ নেই’– এই কথা আবার বলা চলে নাকি? কিন্তু আমি লিখতে চেয়েছিলাম এক বৃহত্তর মানবিক দর্শনকে মনে রেখেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ডানকার্ক উপকূলে আটকে পড়া ব্রিটিশ বাহিনীকে হিটলারের গ্রাস থেকে উদ্ধার করে আনতে যখন ‘অপারেশন ডায়নামো’র শরিক হয়ে সাধারণ ব্রিটিশ নাগরিকেরা তাঁদের নৌকো ভাসিয়েছিলেন, জার্মান ইউবোট অথবা বিমানবাহিনীর কড়া আক্রমণকে উপেক্ষা করেই–তাঁদের সেই উদ্দীপনাটুকুও, সততার শক্তিটুকুও আমার কাছে সমান ভাবে সত্যি। সমান ভাবে সত্যি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া একের পর এক কিশোর, তরুণ, যুবক মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ। সমান সত্যি কিউবা অথবা নিকারাগুয়ার বিপ্লব, এমনকি ক্ষমতার অলিন্দে থেকেও, স্বেচ্ছায় সরে গিয়ে বলিভিয়ার আন্দোলনে চে গ্যেভারা’র যোগদান ও মৃত্যু’র খবর। মানুষের ত্যাগ ও সংগ্রামের কোনও রঙ হয় না। রঙ দেখতে গেলেই আমরা একটা সংকীর্ণতার ভিতরে আটকিয়ে পড়ব। সঙ্গীতের মতোই আমাদেরকে বিশাল হয়ে উঠতে হবে। উদার হয়ে উঠতে হবে। তাই তো আমরা গান গাইতে ভালোবাসি। গানের সুরেই মিছিলে পা মেলাই।

প্রত্যেক গণআন্দোলন আমাকে তুমুল শক্তি দেয়, আমাকে বলে, “তুমি যা হতে পারোনি, আমি তাই!” ৭৫এর মুহূর্তে দাঁড়িয়ে লিখতে চেয়েছিলাম, অনেক-অজস্র সমস্যার সম্মুখে দাঁড়িয়েও আমরা যেন আমাদের ঐক্যকে হারিয়ে না ফেলি। পারস্পরিক বিশ্বাসকে হারিয়ে না ফেলি। বিরোধীদের খেয়োখেয়িতে আশাহত হয়ে না পড়ি। সিংহলী জনতা আমাদেরকে আবারও দেখিয়েছে, মানুষে মানুষেই একত্রিত হওয়া চলে। কোনও বিশেষ রঙ বা পতাকার দরকার পড়ে না সবসময়। কেবল ‘ভালো’র পক্ষে থাকাটাই জরুরী। তার গুরুত্ব এবং ঐক্যের বক্তব্যকে তুলে ধরতে গিয়েই ‘বেলা সিয়াও’এর উল্লেখ। দেশ, কাল, জাতি, ধর্ম, ভাষাকে ছাপিয়েও সঙ্গীতই মানুষকে প্রতিরোধে এক করতে পারে। এক করতে পারে গড়ে তোলার যে কোনও সংগ্রামেও। ৭৫এর স্বাধীনতায় মহাকাল যেন এতটুকুই উপহার হিসেবে পাঠালো। আমরা নতুন করে আবারও, হাতের উপরে হাত রাখতে শিখি আসুন...'জালিম’এর ফিরে যাওয়া তখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন