দোঁহা

মেয়েদের আবার স্বাধীনতা দিবস হয় নাকি?


বেদশ্রুতি মুখার্জী

রঙ্গলাল কবেই বলে গেছিলেন-

"স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব শৃঙ্খল বলো কে পরিবে পায় হে কে পরিবে পায়?"

শুরুতে শ্রুতিমধুর যে কোনো কিছুরই পেছনে লুকিয়ে থেকে টুকিধাপ্পা খেলে রোদে জলে ঘাম ভেজা কাঠখোট্টা দাঁতালো বাস্তব। ছোঃ, স্বাধীনতা শব্দটি মেয়েদের জন্য ঠিক তাই, সোনার পাথরবাটি...স্ব+অধীনতা=স্বাধীনতা, স্ব বলতে আদতে নিজের নয়, স্ব বলতে স্বশাসিত চিরন্তন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, নাক কোঁচকানো সমাজের শেকল মশাই, ছোট থেকেই শিখে যেতে হয় এটা করতে নেই, ওটা বলতে নেই, ছেলেদের জন্য এমন বিধিনিষেধ কিন্তু দেখবেন না, রেগে গেলে গালি দিচ্ছে, হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ছে, সিগারেট ফুঁকছে প্রকাশ্যেই, এমনকি যেখানে সেখানে প্যান্টের চেন খুলে হিসিটাও...এতটুকুও লজ্জাশরম নেই, আমাদের ভাবতে হয়, এতটুকু বড় হবার পর থেকেই সব সময় সব বিষয়ে ভাবতে হয়, বাইরে একা টিউশনে যাওয়া যায় না, সন্ধ্যের পর খেলা যায় না, বন্ধুদের বাড়ি নৈব চ, জোরে হাসা যায় না, জোরে চেঁচানো যায় না, চিৎকার করে কাঁদতে নেই এসব শিখে যেতে হবে কৈশোরেই, আরো অনেক কিছু শিখতে হবে, কীভাবে প্রচন্ড পেটে ব্যথা লুকিয়ে সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখতে হবে যাতে দাগ না লাগে, কেননা আমাদের জীবনে কোনো অ্যাডের মত কেউ বলে না, "কুছ দাগ অচ্ছে হোতে হ্যায়" তাই লুকোতে হয় নইলে প্রাইভেটে ছেলে বন্ধুদের হাসির শিকার হতে হবে যে, শিখতে হবে কীভাবে পাড়ার মুদির দোকানে অন্তত আধঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে যেন সব লোক চলে গেলে তখন বলতে হয় কী কিনতে আসা, তারপর কাগজে মুড়িয়ে লুকিয়ে চুপ করে মাথা নীচু করে আনা। আর সেই থেকেই শুরু প্যাট্রিয়ার্কিকে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা, আজীবন চলবে। কর্মজীবী হোক নারী বা গৃহলক্ষ্মী, আদতে পরাধীন, অকারণ নিন্দে, বাঁকা কটূক্তি, মিথ্যে গুজব আকারের সঙ্গে সঙ্গে আয়তনে বাড়তে থাকে। পুরুষ প্রেমিক হোক, বা স্বামী বা পিতা নারীকে ডমিনেট করবেই, আপনি বিয়ে করেছেন-অভিনন্দন, চাকরি করে এসেও তাকে চা টা আপনাকেই এগিয়ে দিতে হবে, হোক না যতই আপনার শরীর অসুস্থ। বরেদের বন্ধু, আড্ডা, স্বাধীনতা সব অক্ষুন্ন, আপনার মনে পড়ে শেষ কবে বান্ধবীকে ফোন করেছিলেন? বাবার বাড়িতে ফোনে বেশিক্ষণ কথা বলায় পাশের ঘর থেকে শাশুড়ির উচ্চস্বরে কিচকিচটা আশা করি মনে আছে। গৃহলক্ষ্মীদের তো ২৪x৭ ডিউটি, কর্পোরেট অফিসও এক সময় শেষ হয়, আপনাদের টার্গেট এর খেলা শেষ হবে না চিতায় না উঠলে। স্ত্রী যেহেতু তাই সং সেজে সারা জীবন নিজের সেরাটুকু বিলোনোই সংসার। স্যাক্রিফাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট সংসারে ছেলেরাও করেন তবে মেনে ও মানিয়ে নেবার তুলাদণ্ডে মেয়েদের পাল্লা অনেক ভারি।

 করেননি বিয়ে, এ বাবা কেন? এইবার তো নীতিপুলিশেরা আপনাকে ছিঁড়ে খাবে, অভিনন্দন আপনি পড়াশোনা থেকে চাকরি সব নিজ দক্ষতায় সামলেও কিন্তু সমাজের মার্কশিটে গোল্লা পেয়েছেন। শাশুড়ি খোঁচা দিয়ে কথা বলেন, আপনার নিজের লোকেরাও তো কম বলেনি, আপনার অ্যাডজাস্টমেন্ট পাওয়ার একদম নেই, প্রেমিক ছেড়ে গেছে, তাহলে তো নির্ঘাৎ ক্যারেকটারলেস, ছেলেরা আবার চরিত্রহীন, নেশাখোর বা টর্চারিং বা অর্থলোভী হয় নাকি যে ব্রেকআপ হতে পারে। ছেলেরা একসাথে দশটা প্রেম করলেও সমস্যা নেই, তবুও তাকে তো কাছছাড়া উচিত নয় তাইনা। কী হত বড়জোর, সারা জীবন মেয়েটি টর্চারড হত, মারধর খেত বা খুন হত অ্যাবিউসিভ এক্সের হাতে, তাতে কী, এ সমাজে মেয়েদের খুনটা তো স্বীকৃত, দৈহিক বা মানসিক যাই হোক না কেন।

মা, দিদাদের প্রজন্মের থেকে আমাদের তফাৎ আমরা উপার্জন করি এটুকুই যা, খাবার পরার স্বাধীনতা টুকুই খালি রয়েছে। পরারটা তাও খুব একটা বেশি নেই, ব্লাউজের স্লিভ থেকে স্কার্টের লেনথে আমাদের ক্যারেকটার সার্টিফিকেট লিখতে বসে সমাজ। ব্যক্তিগত এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বলি, বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে শুনি আমার মাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেই মাঝরাতে আমাকে নিয়ে যাবার একটা মানুষ ছিলেন না, একা যেতেও কেউ দিলোনা, তাই আর শেষ দেখাই হলোনা, পুরুষ প্রজাতি ছাড়া একা কোনো মেয়ের রাস্তায় রাতে বেরোনোর নিরাপত্তা আছে কী আদৌ এই পঁচাত্তর বছরেও? আগামী পঁচাত্তরেও হবে না, পুরুষ কে যে সমাজে শেখানো হয় পৌরুষ পাঠ আর নারীকে শেখানো হয় সহনশীলতা, সেই পোড়া দেশে শুধু মোমবাতিই জ্বলবে ছাই হবার পর, নির্ভয়ারা পেট্রোলে ধর্ষক পুড়িয়ে দীপাবলি উৎযাপনের সুযোগ পাবেনা কখনো। মহালয়াতেও দেখা যায়, দুর্গাকে অস্ত্র দিচ্ছেন দেবতারা, দেবীরা নন, আর মেয়েরাও তো চিরকালই মেয়েদের মূল শত্রু, আপনি খুব ভালো ছেলে, কেয়ারিং হাসবেন্ড, আপনার মা মাসি পিসি বৌয়ের নামে কখনো নিন্দে করেনি তার আড়ালে আপনার কাছে, বুকে হাত রেখে বলুন তো! এ দেশে তো লাখ লাখ স্বাধীনতা সংগ্রামী রক্তে অর্জিত পতাকাটারই যেখানে সম্মান নেই, আজ বিকেলের পর থেকেই সেটাই যেখানে ধুলোয় গড়াগড়ি খাবে, সেখানে এই আমরা কীসের স্বাধীন? কাল আবার আমরা মেয়েরা ধুম জ্বরেও ঘরের সব কাজ করব, বাচ্চাদের সঙ্গে রাত জাগবো, অপেক্ষা আর উপেক্ষা আঁচলে গিঁট দিয়ে প্রহর গুণবো, আবার কারুর কথায় চোখ ফোলাবো কেঁদেকেটে, আবার দোকানে অপেক্ষা করব সবাই চলে যাবার পর কিছু একটা মাসকাবাড়ি দরকারি জিনিস চাইবার, আবার ঘরে বাইরে পুরুষের হাতে সমাজের হাতে আহত হবো, আবার অকারণে কলঙ্কিত হব কেননা আপনার স্বপ্ন একটু ব্যতিক্রমী বলে, আবার একা নারীর রোজনামচার লড়াই চলুক আরো আরো কঠিন হার্ডল গেমের মত, আপনারাও চেষ্টা করতে থাকুন কোথায় কতটা আঘাতে ভাঙা যায় টুকরো টুকরো করে, অসহায়ের চোখের জলে সমাজের মেল ইগো স্যাটিসফাই এর খেলা জমুক আরো, তার আগে হ্যাপ্পি ইনডিপেনডেন্স ডে আজ সবাইকে উইশ করে নিই বরং, ড্যাশের স্বাধীনতা কথাটা আমি মেয়ে তো তাই বলারও আমার স্বাধীনতা নেই নয়তো নিন্দাঝড়ে আমার বাবা মা বিষম খাবেন পরলোকেও, তাই ব্লাডি প্যাট্রিয়ার্কির এই অধীনতা আর আননেসেসারি ইন্টারফেয়ারেন্স মুবারক হো গার্লস...তবে মনে রাখবেন -

'নর যদি নারীরে বন্দী এরপর এই যুগে,
আপনারি রচা সেই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।'

আর আমরাও টলারেট করব না বস, বাসে ট্রামে আমাদের বুকের দিকে তাকানো, অহেতুক গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, ইনবক্সে কি করছেন, ভুলভাল টাইপ করে ইতরামো, অহেতুক মিথ্যা কথা চরিত্র তুলে, এরপর আগে ঠাস করে চড়াবো, তারপর দেখব দিল্লি কদ্দূর... চলো বন্ধুরা একসুরে গাই-
"লাজিম হ্যায় কে হম ভি দেখেঙ্গে, হয় দেখেঙ্গে"... চলো বান্ধবী বোনেরা দিদিরা এইবার শাউট করি আমরাও, "আজাদি আজাদি"...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন