দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
একঘেয়েমির যাপনে প্রাত্যহিকীর কষ্টটা দুঃখী কাঠবেড়ালির মতো লেজ নেড়ে চলেছে ভিতর ঘরে নিশিদিন সুখহীন। বসন্ত এলেই পলাশ ডাকে আমায়। লাল কুসুম ইশারায় করে ইঙ্গিত। দোলে রঙের আঙ্গিনায় স্বাগত প্রাণ নেচে ওঠে ময়ূরের মতো। নাগরিক কোলাহলের বাইরে এই সময় ইচ্ছা করে প্রকৃতির রঙে রাঙিয়ে দিতে প্রাণের পরিধি। স্ত্রী মেয়ের অবিরত আর্জি, চলো পলাশের কাছে। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো কদিন পরপর ছুটি জুটে গেল। মন নেচে উঠল। মাঠাবুরু পাহাড়ের উল্টোদিকে একটা হোম ষ্টে পাওয়া গেল। অতএব ছোট মুক্তির ঠিকানায় পুরুলিয়া। পড়ে রইল আবাসনের রঙ-আবীরের অভিঘাত। সবুজ হোলি এবার প্রকৃতি সনে। দোলের কটা দিন এবার কেয়ার অফ পুরুলিয়া।
যথারীতি গরম উপেক্ষা করেই সাইট সিয়িং এ বেড়িয়েছি। পারডি ড্যামের উদ্দেশ্য সুইফ্ট ডিজায়ার ছুটছে দূরন্ত গতিতে। মন ভালো করা পরিবেশ। সবুজের বুক চিরে ছুটে চলেছে গাড়ি। চারপাশে আগুনে পলাশ দাঁড়িয়ে আছে মুচকি হেসে। কচি পাতার কুসুম যেন চেনা লাল হাসিতে নতুন বউয়ের ঘোমটা খোলা মুখ। মেয়ের দুচোখে বিস্ময় পলাশ কুসুমের রঙে। স্ত্রীর সারা মুখ জুড়ে সৌমনস্যতার প্রশান্তি। ভালোলাগার আবীরে সারা মুখ রাঙা। যেন অচেনা মানুষ! গুনগুন সুরে বসন্ত ছিটকে বেরিয়ে আসছে ওর ভেতর থেকে। জঙ্গল যেন মুক্তির ডানায় উড়িয়ে নিয়ে চলেছে আমাদের। ড্রাইভার বলে চলেছে জঙ্গলের চেনা গল্প। বনে হঠাৎ দেখা পাওয়া হাতি ময়ূরের গল্প।
বনসীতার জঙ্গল পেরোতেই রাস্তার দুপাশে সাঁওতাল গ্রামের মানুষ চোখে পরল। খালি গা বাচ্চাগুলোর বুকের খাঁচা যেন হারমোনিয়ামের রিড। জটলা করে বসে থাকা মানুষগুলোর চোখে মুখে খিদের জ্বালা। ড্রাইভার বললো, খুব কষ্টে আছে এরা। চাষবাস নেই। কাজও সেরকম নেই যে দুপয়সা আয় হবে। গ্রামের যুবকেরা সব বাইরে হোটেল বা রাজমিস্ত্রির কাজে গেছে। তারা বাড়িতে যা পাঠায় তাতে দুবেলা দুমুঠো ভাতের সংস্থান হয় না। বুঝলাম গ্রামটা পড়ে আছে 'দারিদ্রের দুষ্ট চক্রে'! প্রত্যন্ত এলাকা বলে সরকারের জীবন ও জীবিকার সব সুযোগ সুবিধাও এসে পৌঁছায় না এই গ্ৰামের মানুষের কাছে। অর্থনীতির পরিভাষায় একেই বলে 'চুঁইয়ে পড়া তত্ত্ব'!
বুকের ভেতরে কেমন ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ! চোখের সামনে ভেসে উঠল আমার খিদেগেলা ছেলেবেলা। বাবা মারা যাওয়ার পর দুবেলা ভাতের জোগাড় করতে থাকা মায়ের লড়াইমুখ। দেখতে থাকলাম আস্তে আস্তে বয়স্ক মহিলার মুখটা কখন যেন মায়ের মুখে বদলে গেল! ড্রাইভারকে গাড়ি দাঁড় করাতে বললাম। ড্রাইভার মানা করতে থাকল কারণ খিদের জ্বালায় এরা সঙ্গের সব খাবার কেড়ে নিতে পারে! মায়ের কথাটা মনে পড়ল। বাড়িতে ভিখারী এলে মা নিজে না খেয়ে ভাতের থালাটা ভিখারীর সামনে রেখে দিতো। আমরা রাগ করলে বলতো, মানুষের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে পারা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। হঠাৎ যেন বুকে ধাক্কা দিল কথাটা। নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। ছেঁড়া শাড়িতে লজ্জা ঢাকতে ব্যস্ত বৃদ্ধার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পায়ে আবীর দিয়ে বলে উঠলাম,"আজ তো দোল। রঙের দিন।" বৃদ্ধা মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে চোখের কোণটা ছেঁড়া আঁচলে মুছে বলে উঠলো," দুটো ভাত দিতে পারিস বাপ। দুদিন কিছু খাই নাই।" কান্না যেন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে বুকের ভেতর থেকে। হঠাৎ বৃদ্ধা আবার বলে উঠলো,"আমাদের দোল নাই বাপ। আমাদের জীবনে রঙও নাই।আমাদের শুধু জ্বালা ধরা প্যাট আছে।" চমকে উঠলাম। বুঝলাম, স্বাধীনতার এতো বছর পরেও এই প্রত্যন্ত মানুষগুলোর নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে খায় খিদের নেকড়ে! 'আছে' আর 'নেই' এর দ্বন্দ্বে ক্লান্ত মানুষগুলো সত্যিই কি স্বাধীন? নাকি একপেট আগুনে খিদের কাছে পরাধীন হয়ে দিন যাপনই হলো এদের সিতাভ জীবন পাঁচালি!