মোহিতবাবু কে তাঁর পাড়ার ছেলেরা ক্লাবে নিয়ে গেছে । ওখানে উনি স্বাধীনতার পতাকা তুলবেন। পাড়ার বর্ষীয়ান মানুষ । ওনাকে তাই আজ এই বিশেষ সম্মান। ছেলেরা পতাকায় ফুল বেঁধে তৈরী। সাতাশি বছরের বৃদ্ধ মোহিত বাবু পতাকার বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে। বুকের ভেতর ঝড় উঠেছে। স্বাধীনতার ঝড়। কখন দড়ি খুলে দিয়েছেন ঘোরের মধ্যে। বলে ওঠেন 'জয় হিন্দ'। আর কিছুই শুনতে পান না। পতাকা উড়ছে। চারদিকে ব্যান্ড বেজে ওঠে । এরপর শুরু হয় সমবেত জাতীয় সঙ্গীত। 'দাদু চলুন, চলুন' - বলে অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরা মোহিতবাবু কে হাত ধরে চেয়ারে বসায়। শুরু হয় ক্লাবের সেক্রেটারির ভাষণ। তিন মিনিটের সেই ভাষণ শোনার মতো ধৈর্য্য ওখানে উপস্থিত লোকজনের কারোর মধ্যেই ছিল না। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ভাবে সবাই দাঁড়িয়ে আছে।
এর মধ্যে মোহিত বাবুর জন্য চা বিস্কুট চলে এসেছে। বাচ্চা-রা ব্যান্ড ও বাঁশির সুরে " হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর" বাজাচ্ছে। মোটের উপর এক খুশির সকাল, উৎসবের আমেজ। রাজনৈতিক উৎসব আপামর দেশবাসীর। দেশ স্বাধীন হওয়ার উৎসব। বাঃ, চমৎকার। মোহিত বাবু পায়ের চটি একটু ঠিক ভাবে গলিয়ে নেন। মনে মনে চলে যান ১৯৪৭ সালের ওই দিনটি তে, যখন তার বয়স এগারো কিংবা বারো। ভৌগোলিক সীমানা ঘোষিত হবে। দেশমাতৃকার কোল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো দুই সন্তানকে। তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে সমস্ত ভারত। মোহিত বাবু রা আর কতো অত্যাচার সহ্য করবেন! রাতারাতি চলে এলেন বাস্তুহারা হয়ে। স্বাধীনতার সুখ , স্বপ্ন কিছু বুঝে ওঠার আগেই পায়ের তলার মাটি সরে গেল ।
এখন থেকে শুধু বেঁচে থাকার লড়াই। পায়ের তলার মাটি আর মাথার উপর ছাদ এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে বড়ো হওয়া, টিকে যাওয়া।
ছিটে বেড়ার ঘর,উদ্বাস্তু কলোনি। জ্যাঠা, কাকা , বাবা, মা, বড়ো সংসারে জায়গা অকুলান। উদয়াস্ত পরিশ্রম। এরপর মূল স্রোতে ফেরা। সুখ, স্বপ্ন, নিজের বাসা, নিজের দেশের নীলাকাশে ডানা মেলা। জীবনে, মননে একাত্ম হয়ে ওঠা।
স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যাওয়া। আমার দেশ ভারত । সময়ের সঙ্গে ফিকে হয়ে আসে ছিন্নমূল অতীত। ১৫ই অগাস্টের সকাল যেন এক পুণ্য তিথি। হৃদয়ের এই আনন্দের জোয়ারে ভেসে শুধু কাঁটাতার। মাইকে তখনও গান ভেসে আসে। মোহিতবাবু বাড়ি ফিরে আসেন। গানের কথা গুলো শুনতে পান, " কাণ্ডারী নাহি কো কমলা, দুখ লাঞ্ছিত ভারতবর্ষে "। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। আকাশে চোখ রাখেন। কাঁটাতার পেরিয়ে একঝাঁক সাদা বক স্বাধীন ডানা মেলেছে নীলাকাশে।