দোঁহা

সুভাষচন্দ্র বসু, এখানে খেতে আসেননি

 


দেশিক হাজরা

ঘুমাছিলাম, ঘুমটা বেশ গাঢ় হয়ে উঠে ছিলো, বাসন্তী রংয়ের চাদরে অসার দেহ টা পড়ে রয়েছে। হঠাৎ মা চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। প্রথমদিকে হয়তো তার কোন শব্দ কানে ঢোকেনি, ধীরে ধীরে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে বেশ শোরগোল ফেলেছে, তার চেতনা ঢুকেছে মগজে। আমাকে টেনে হিঁচড়ে তুলে উৎফুল্লতার সাথে চিৎকার করে বলে, 'সুভাষচন্দ্র বসু এসেছেন। তাঁকে আমি চা ডিম টোস্ট করে দিয়ে এলাম, এখন পাশের ঘরে বসে তিনি ডিম টোস্ট খাচ্ছেন।' আমার ঘুম ছুটে গেল। আয়েস করে দেশি মুরগির ঝোল দিয়ে মোটা চালের ভাত খেয়ে ঘুমোতে গিয়েছিলাম কিন্তু ঘুম তো হল না, উপরন্তু যে কটা নিউরণ ছিল একসাথে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে মাথার মধ্যে। চুল খাড়া করা কথাবার্তা আগে কোনদিন বলতে শুনিনি মা কে। কিছুটা ক্যাবলার মত তাকিয়ে থাকলাম মায়ের দিকে, ভালো মানসিক হাসপাতালের দোকানের কথা একবার মাথায় এলো অবশ্য নিজের জন্যেই, আমি কি পাগল হতে বসলাম। এসব ভাবতে যাব এমন সময় মা আমার টিকি চুলটা একবার টেনে দিয়ে বললে 'আমার কথা কানে যাচ্ছে না বুঝি যা চোখ মুখে জল দিয়ে নে। এই অবস্থায় সুভাষচন্দ্র বসু তোকে দেখলে তোর প্রতি বিষন্নতা প্রকাশ করবে। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাস, দেখে আয় ওই ঘরে বাবার সাথে কথা বলছেন।' আমি কিছু বুঝতে পারছি না এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিত। আমি চোখ কচলাতে কচলাতে পাশের ঘরে গেলাম‌ দেখলাম বাবা চেয়ারে বসে তার সামনে মুখোমুখি ভাবে আর একজন বসে খাঁকি রঙের একটা পোশাক পরা মানুষ আমি বাবার পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকাতে, ঠিকমতো দেখতে পারছিলাম না শুধু বুঝতে পারছি কেউ একটা বসে আছে এবং কিছু একটা বারবার মুখে পুড়ে দিচ্ছে গরমের চটে বারবার  হুসহুস শব্দ বার করছে মুখ থেকে। আমার বাবা সেটা খুব ভালো করে উপভোগ করছে। এই শব্দটি উপভোগ করার মধ্যে কি আছে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবা খুব আনন্দের সাথে বলল, 'সুভাষচন্দ্র বসু এসেছেন আমাদের বাড়িতে আয় প্রণাম করে নে'...আমি অবাক হবো নাকি সেটাও বুঝতে পারছি না!

একটু সামনে গেলাম। ঠিক দেখছি ভালো করে চোখটা আর একবার কচলে নিলাম পাশের ঘরে চশমাটা রাখা ছিল, আমি দৌড়ে পাশের ঘর থেকে চশমা নিয়ে এলাম। আমি সত্যিই দেখছি, সামনে সুভাষচন্দ্র বসু আমার দাদুর পুরনো আরাম কেদারায় বসে আয়েশের সাথে, মায়ের বানানো ডিম টোস্ট খাচ্ছেন আর পাশে রাখা একটা সাদা চকচকে কাপে এক কাপ চা। এই কাপ সচরাচর মা তরং থেকে থেকে বার করেন না, আত্মীয়-স্বজনের জন্যও না। ডিমটোস্টে একটা কামড় দিয়ে উনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন। আমি তাকে করজোরে প্রণাম করলাম। প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়াতেই উনি আমার দিকে ফিরে একটু মুচকি হাসলেন হাসিটার মধ্যে একটু রহস্য লুকিয়ে আছে মনে হলো।

-'কেমন আছেন স্যার?' তিনি আমার দিকে না তাকিয়ে ডিম টোস্ট এর প্লেট থেকে টমেটো সস আঙুলে লাগিয়ে নিতে থাকলেন...এবং বলেন
-'তোরা যেমন রেখেছিস, আজ কাল সব তোদের হাতে।'

আমার বড্ড খারাপ লাগলো। আপনাকে আমি আবার কেমন ভাবে রাখতে যাবো সেটা মনে মনে ভাবলাম। কিন্তু আর কথা বাড়ালাম না, গুণী মানুষ কথার পরিপেক্ষিতে অনেক কথা লুকিয়ে থাকে তাই আমিও বাবার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। ডিম টোস্ট খাওয়া সুভাষচন্দ্র বসুকে দেখছি। একবার মনে হলো আমার বাবারও হয়তো ডিম টোস্ট খেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু তিনি চাইতে পারছেন না। একবার মনে হল একটা সেলফি তুলে রাখি বন্ধু-বান্ধবদের দেখাবো। উনি কি পছন্দ করবেন এসব, হয়তো না এটা ভেবে পিছিয়ে গেলাম। আর তাঁকে বললাম না আমার মনোবাঞ্ছার কথা। ইতিমধ্যে উনি আবার একটা প্রশ্ন করে বসলেন।

-কি করা হয়?

আমি একটু হেঁয়ালি করে বললাম, 'নিজের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ।'

তিনি প্রচণ্ড জোড়ে হাসলেন।
হাসিটা ঘরের আনাচে-কানাছে ছড়িয়ে গেল। মা রান্নাঘর থেকেও হুড়মুড় করে বেরুতে গিয়ে শাড়ির আঁচলটা একটা ভাঙা আলনার খোঁছে লাগিয়ে ছিঁড়ে বসলো। শাড়িটা বাবার খুব পছন্দের যদিও। এবং খুব শান্তভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো চোখের ইশারায় বোঝাতে চাইলেও উনি এত জোরে হাসছেন কেন! আমি আর কিছু বললাম না।

খুব গম্ভীর গলায় সুভাষচন্দ্র বসু বললেন

-আমি স্কুলের পেছনে বারবার বিড়ি ফুঁকতে যাওয়াটাকে কিংবা গাঁটের পয়সা খরচ করে কোন ফাইভ স্টার হোটেলের বার-এ কোমর দুলিয়ে ভাইরাল ভিডিও করাটাকে স্বাধীনতা মনে করিনা।

আমি একবার বিকৃত মুখে বলতে গেলাম যে, আমার দ্বারা এইসব সম্ভব না। মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে। এ বাড়িতে হাত খরচাও প্রয়োজনের থেকেও কম দেওয়া হয় এবং স্কুলের সময় বিড়ি ফুঁকতে যাওয়ার দুঃসাহস আমার কলিজাতে কোনদিনও ছিল না। তারপর মনে হলো এসব বলে কোনো কাজ হবে না। যেচে জুতো খাওয়ার কোন মানে হয় না। আবার ওনার মতো বড়মাপের মানুষের কাছে তো একদমই না। তাই আমিও একটা মিষ্টি মুচকি হাসি হাসলাম। বাবা কিছু একটা বলতে যাবে মনে হলো কিন্তু না বলে কথাটা গিলে নিলো। এতক্ষণে সুভাষচন্দ্র বসু সাদা কাপটা হাতে তুলে নিয়েছে, একটা চুমুক দিলেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কিন্তু এই দীর্ঘশ্বাসটা একটু স্বস্তির মনে হল। আমরা আবার ফ্যাল ফ্যাল করে তিনজনে তার চা খাওয়া দেখলাম।

 ইতিমধ্যে রেডিওটা আবার আওয়াজ শুরু করেছে। বারবার বাবা একটা স্টেশন ঠিক করছে, ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ শব্দ কানে আসছে। সেই শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো, তখন সকাল সাড়ে নটা। আমি কিছুক্ষণ থম মেরে বিছানায় বসলাম। উপরের স্বপ্নটা খুব ভাবিয়ে তুললো এবং নিজের বড্ড অসুবিধা হতে শুরু হলো। কপালে ঘাম দেখে মা একটু থতমত খেলো। ঘরের পরিবেশটা কেমন ক্যাবলা টাইপের রেডিও স্টেশনের ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ শব্দে ভরে গেছে, যা খুব বিরক্তিকর।

রেডিওর খবরে শুনতে পেলাম বাস ধর্মঘট ডেকেছে। মুখ হাত ধুয়ে চাকরির ফ্রম তোলার লাইনে দাঁড়াতে হবে এটা ভাবতে ভাবতে ফ্যানে ভাত আর আলু সেদ্ধ নুন সপাটে মুখে পুরতে লাগলাম। বাবা পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো 'আজকে বাস বন্ধ আছে, যেতে পারবিনা। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।' তখন প্রায় সকাল সোয়া দশটা। ওদিকে আকাশবাণীর একজন চিৎকার শুরু করেছে। রেডিওর আওয়াজটা বাবা একটু বাড়িয়ে দিলো। ভেসে এল নেতাজীর কণ্ঠ -

"Never loss your faith in the destiny of India there is no power on earth which can keep India in bondage India will be free and that too soon"

আমাকে আবার পরের বারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। চাকরিটা হবে নাকি বুঝে উঠতে পারছি না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন