দোঁহা

পোড়া সূর্য



 

আ নি জ  হা মা দা নি


অনুবাদ: সাগরিকা শূর


একটু দূর থেকে সাইরেনের আওয়াজ ভেসে এল। অন্য কেউ শুনতে পেয়েছিল কিনা জানিনা, আমি স্পষ্ট শুনেছিলাম - শুধু শুনিইনি, আওয়াজটা চিনতেও পেরেছিলাম। আওয়াজটা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের আর সেটা আমার জন্যই বাজছিল। বেরিয়ে এলাম আমি। জানি, কোনো অজুহাত বা তর্কই এখানে ধোপে টিকবে না। এসবই পূর্বনির্ধারিত : আমি অসুস্থ এবং আমার চিকিৎসার প্রয়োজন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই খুব সন্তর্পণে সে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি যেজন্য অপেক্ষা করছিলাম তা কিন্তু হল না, বরং দু'জন লোক বেরিয়ে এল। তারা কিছুই বলল না, কিন্তু তাদের মুখ দেখেই আমি মনের কথা বুঝতে পারছিলাম, সেজন্যই দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সটার দিকে এগিয়ে গিয়ে উঠে পড়লাম। লোক দু'টো আমাকে অনুসরণ করে ভেতরে এল। শব্দ পেয়ে চালক তার কালো দাঁতের ফাঁকে সাদা সিগারেটটা ঝুলিয়ে আমার দিকে একবার তাকাল। মনে হল আমার গলায় যেন কিছু বিঁধে আছে আর আমি ঢোক গিলতে পারছি না।

হিমশীতল রাস্তার উপর দিয়ে গাড়ির চাকা ঘুরতে শুরু করল। আমি জানিনা অন্য কেউ শুনতে পাচ্ছিল কিনা, কিন্তু আমি চাকার ঘরঘর আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কী হচ্ছে, ওরাও কিছু বলছিল না। জিজ্ঞেস করার সাহসও হচ্ছিল না। যখন হঠাৎ করে আমার নজর ওদের ওপর পড়ল, মনে হল যেন বহু যুগ ধরে ওদের লক্ষ করে আসছি আমি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল ওরা যেন গভীর কোনো চিন্তায় মগ্ন।

হয়তো চালকটি জানত আমায় কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং সেজন্যই বাসটা এক জায়গায় এসে থামল। আমি ওঠার আগেই ওরা এসে আমার হাত ধরে ওদের অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে চলল। মনে হল আমাকে কোনো অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। সেই ঘরে ছিল শুধুমাত্র একটা বিছানা আর বিছানার ওপর যে কী ছিল তা ঈশ্বরই জানেন। তারওপর একটা কম্বল বিছানো, লাল, যেন কেউ রক্ত মাখিয়ে রেখেছে। সেজন্যই বিছানার ওপরের জিনিসগুলোকে আলাদা করে বোঝা যাচ্ছিল না। তারপরই সেই উঁচু, উজ্জ্বল চুনকাম করা সাদা দেওয়াল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন দেওয়ালগুলো সাদা রং করা হয়েছে -  যাতে সামান্য আলো আসে, আমি ভাবলাম। কিন্তু আলো কোথায়? আমি ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করব একবার, কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করব? কেউ তো নেই। আর থাকলেই বা আমি জিজ্ঞেস করতাম কীভাবে? তারপরই একটা টিকটিক শব্দ শুনতে পেলাম - অনেকটা জল পড়ার মতো - টপ-টপ-টপ। আমার যেন কিছু একটা হয়ে গেল। এই তীক্ষ্ণ শব্দের ধাক্কায় আমার সন্ত্রস্ত মর্মস্থল যেন কেঁপে উঠল। কতক্ষণ চলবে এরকম? আমিই বা এভাবে, এখানে, কতক্ষণ? কোনো মানেই নেই। বাইরে কি রোদ উঠেছে? নাকি বৃষ্টি হচ্ছে? কিন্তু আকাশ পরিষ্কার থাকলে জল পড়ার আওয়াজই বা কোত্থেকে আসবে? আর বরফ পড়লে তো কোনো আওয়াজ হওয়ার কথা নয়। একসময় মনে হচ্ছিল এই দেওয়ালগুলো ভেঙেচুরে ফেলি, আর বাইরে গিয়ে নিজের চোখে দেখি কী হচ্ছে। কতক্ষণ হল আমি এখানে রয়েছি? কিচ্ছু জানিনা। প্রথমে ওই টিকটিক শব্দটা আমি শুনতে পাইনি, কিছুক্ষণ পর থেকে নজর করলাম। এটা কি আদৌ থামবে? আমি তো যথেষ্ট নিরীহ একটা জীবন বাঁচছিলাম, তাহলে ওরা হঠাৎ আমায় এই উর্দি পরিয়ে দিল কেন?

অনেক, অনেকদিন হয়ে গেল আমি এখানে রয়েছি। কখনও কখনও মনে হচ্ছে যেন আমি এইমাত্র এলাম, আবার কখনও সময়ের হিসেব রাখা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। কিন্তু অবশেষে যা ঘটল তা আমার দূরতম কল্পনারও বাইরে। আমি বোধহয় আসলে সবসময়ই এমন কিছুর জন্য অপেক্ষা করে এসেছি যা কোনোদিন হবেই না।

হঠাৎ দেওয়ালের ভেতর থেকে যেন ওই লোক দু'টো বেরিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল - সেই দেওয়াল যার আড়ালে একদিন জোর করে আমায় ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। ওরা কিচ্ছু বলল না। ওদের মধ্যে একজন শুধু লাল কম্বলটা টান মেরে সরিয়ে দিল। তার নিচে সাদা চাদর। আমি একবার সেই সাদা চাদরটার দিকে তাকালাম, আরেকবার তাকালাম সাদা দেওয়ালগুলোর দিকে, তারপর ওদের মুখের দিকে চোখ তুলে নজর করলাম। আবার আমার একই কথা মনে হল : দেওয়ালগুলো এতো সাদা কেন? আর সত্যি বলতে কী, ওদের জিজ্ঞাসা করার সাহস আমার হচ্ছিল না। কিন্তু হয়তো ওরা আমার চেয়ে বেশিই চালাক ছিল, তাই আমার মুখের দিকে তাকিয়েই আমার না বলা কথা বুঝে নিতে পারল, একজন বলে উঠল, "মানুষের উচিত মৃত্যু আসার আগেই মৃত্যুর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া, সেজন্যই দেওয়ালগুলো এতো সাদা করা হয়েছে।" ওরা তারপর আমাকে নিয়ে ওই সাদা চাদরের ওপর শুইয়ে দিল, মুখটা ওপরের দিকে করে। তারপর কিছু যন্ত্রপাতি এনে আমার মুখটা দু'ভাগে ভাগ করে ফেলল। একটা অংশ রইল আমার ধড়ের সঙ্গে, অন্যটাকে ওরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে লাগল। একজন একটা কাপড়ে সেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন টুকরোগুলোকে নিয়ে খুব নিরাপদ কোনো জায়গায় রেখে এল, আমার দৃষ্টির বাইরে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সবকিছু যেন মৃতবৎ। কিছুই বলল না ওরা, আমিও কিছু বলতে পারলাম না। তারপর আমায় খানিক তুলে গলার চারপাশে একটা লকেট ঝুলিয়ে দিল। সেই লকেটে একটা সংখ্যা খোদাই করা। আমি অনেক চেষ্টা করলাম সংখ্যাটা পড়তে, কিন্তু পারলাম না। আসলে আমার চোখগুলো তো আমার মুখের অপসৃত অংশের মধ্যেই চলে গেছে, কীভাবেই বা পড়ব? তারপর যেভাবে আমায় এখানে আনা হয়েছিল সেভাবেই ওরা আমায় ঘরের বাইরে নিয়ে এল, দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে। আমরা বাইরে আসতেই ওদের একজন বলে উঠল, "নে, এবার তোর ছুটি। তুই আর কোনোদিন কোনো অ্যাম্বুলেন্স দেখবি না, আর কোনোদিন তোকে এখানে আনার দরকারও পড়বে না।"


......................................


'পোড়া সূর্য' ('The Burnt-Out Sun') গল্পটি সাহিত্য আকাদেমি প্রকাশিত 'কন্টেম্পোরারি কাশ্মিরী শর্ট স্টোরিজ' বইটি থেকে সংগৃহীত। গল্পটির লেখক আনিজ হামাদানী। বইটি সংকলনের দায়িত্বে ছিলেন হৃদয় কৌল ভারতী। গল্পটি মূল কাশ্মিরী থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করেছেন নিরজা মাত্তু।

1 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন