বর্ণালি মৈত্র
মহামানবের থাকায়
নববর্ষ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রথম যে গান দুটি রচনা করেন, সেই দুটিই ব্রহ্মসংগীত। ‘সখা, তুমি আছ কোথা’ আর ‘প্রভু এলেম কোথায়’। এর আগে অবশ্যই তিনি ব্রহ্মসংগীত রচনা করেছেন, একাধিকবার, কিন্তু নববর্ষ উপলক্ষে এই প্রথম। বছরের প্রথম সকালে মহর্ষিভবনে উপাসনার এই ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। কখনো সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে সিটি কলেজে বক্তৃতার আয়োজনে, কখনো গাজীপুরের ব্রাহ্মসমাজে হয়েছে ব্রহ্মোপাসনা, শান্তিনিকেতনেও থেকেছেন কোন কোন বছর নববর্ষের দিন, থেকেছেন সাজাদপুরে, শিলাইদহে। এই দিনগুলোর ছড়িয়ে পড়া আলোয় মিশে থাকতো ‘সুগন্ধ হিল্লোল’, বাতাসকে সংগোপনে ধারণ করে রইত ‘শান্তির বারি’-আকাশের সম্বল সেসব দিনে ‘তাহারি আশীর্বাদ’।
তারপর ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথম বছরের নববর্ষ এল মহাসমারোহে ১৩০৯ বঙ্গাব্দে। বিভিন্ন বন্ধুজনকে রবীন্দ্রনাথ নিমন্ত্রণ করে করেছিলেন সেদিন, যদিও সবার পক্ষে নিমন্ত্রণ রক্ষা সম্ভব ছিল না, তবু এসেছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, এসেছিলেন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখরা। সেবার প্রথম শান্তিনিকেতনে এলেন মোহিতচন্দ্র সেন। সবাইকে নিয়ে আশ্রমিকরা আর ছেলেপুলের দল আনন্দের সাজি উপুড় করে দিল। উপাসনায় কবিগুরু গাইলেন–’আমারে কর তোমার বীণা’।–গান শুনতে শুনতে, মনের মধ্যে নতুন বছরের শুভেচ্ছা রোপন করতে করতে সেবার শৈলেশচন্দ্র মজুমদার, প্রেমতোষ বসুরাও এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন সামনের মাঠে — কারণ আকাশ তখন এক অদ্ভুত সুন্দর রঙে কালবৈশাখীর বার্তা দিচ্ছিল।
কিন্তু ঝড় কী সেদিন শুধু আকাশে? কন্যার শরীর যে বড়ই খারাপ। মৃত্যুর কথা বলছে কে যেন বুকের ভেতর চুপি চুপি। তবু বলেছেন, ‘তবে সংসারে কোন বাহ্য ঘটনাকে আমার চেয়ে প্রবলতর মনে করিয়া অভিভূত হইব না–কারণ ঘটনাবলী তাহার সুখ-দুঃখ, বিরহ মিলন লাভ-ক্ষতি জন্ম-মৃত্যু লইয়া আমাদিগকে ক্ষণে ক্ষণে স্পর্শ করে ও অপসারিত হইয়া যায়। [“নববর্ষ”, ‘ধর্ম’, রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বাদশ খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার. পৃ. ৪৯]
বুকের ভেতরের সেই আশঙ্কা সত্যি হয়ে গেল আর একটি নববর্ষের সকাল আসার আগেই। চলে গেলেন মৃণালিনী। আঁকড়ে ধরলেন রেনুকাকে। হাজারীবাগে রেখে অসুস্থতা ক্রমাগতই বাড়ছিল। তা কমানোর চেষ্টা শুরু করলেন ওকে আলমোড়ায় নিয়ে গিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, এতটা পথ যাওয়া উচিত হবে না।
১৩১১-র নববর্ষের সকালে কবি নিজে অসুস্থ। কিন্তু শান্তিনিকেতনের সেই সকাল কোনো কাজেই বিরাম নিল না। ভোরে বৈতালিকের ঘন্টায় ঘুম ভাঙ্গা, সূর্য ওঠার আগে, আলো-আঁধারে শালবীথি জুড়ে আশ্রমিকদের সম্মেলক গান— ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারি ইউক জয়’-- সুদূর কোলকাতায় পৌঁছে যাচ্ছিল এই সুর অসুস্থ কবির কানে। মাস্টারমশাইরা হাঁটতেন এই পরিক্রমার একেবারে পুরোভাগে। কেবল কোলকাতায় কেন, আটলান্টিক মহাসাগরে অলিম্পিক জাহাজে বসেও পালিত হয়েছে নববর্ষ। সমমত না হওয়ার মুখে কুলুপ এঁটে বারে বারেই, তিনশো পঁষট্টিদিন পর পর নতুন হতে চাইতেন, সংশোধন করতে করতেই তো জীবন এগিয়ে চলে সামনের দিকে। পান্থের যাত্রাপথ এভাবেই ভরে ওঠে আনন্দগানে।
১৯২৩। শান্তিনিকেতন ক্রমে বেড়ে উঠেছে। বিদেশী অধ্যাপকরা আসছেন অনেকেই ক্লাস নিতে। গুরুদেব চাইছেন গ্রীষ্মবকাশের সময় তাদের শান্তিনিকেতনের উত্তপ্ত ও শুষ্ক আবহাওয়ার বাইরে কোন আরামদায়ক জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে নিতে। এই ব্যবস্থায় হয়তো ফরাসি অধ্যাপক বেনোয়া থাকছেন কোটগড় পাহাড়ে, এল্মহার্স্ট নৈনিতালে, লেভি দম্পতি নেপালে। শান্তিনিকেতনের এই প্রখর দাবদাহের কারণে নববর্ষের সকালে আরো এক আনন্দের উদযাপন যোগ হলো। গুরুদেবের জন্মদিনের অনুষ্ঠান পঁচিশে বৈশাখের পরিবর্তে পালন করা শুরু হলো নববর্ষের দিনেই। শুধু দাবদাহ নয়, সঙ্গে জলাভাব। ছাত্র-ছাত্রীদের সীমাহীন ভোগান্তি। তাই এই ব্যবস্থা। মে মাসের প্রথম দিন থেকে টানা দু আড়াই মাস গ্রীস্মাবকাশ। বলা বাহুল্য, এ ব্যবস্থা তাঁরই। ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক, কর্মী, আশ্রমবাসীর কাছে এ উপহার গৌরবের। শান্তিনিকেতনের সুপরিচিত উত্তরায়ণ চত্বরের মূল যে উদয়ন ঘর – সেই ঘরের বারান্দাকেই স্টেজ করে পালন করা হতো জন্মদিন।
অসুস্থতা ক্রমেই আরো জটিল হল। জটিল থেকে জটিলতম।
১৯৪১ এর পয়লা বৈশাখের সকাল। নিতান্ত অনাড়ম্বরে জন্মদিন তার উপস্থিতি জানালো। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফরমায়েসে লেখা একখানা গান আর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি ছিল সেদিনকার সকালের উপহার। কিন্তু এ প্রবন্ধ নিজে পড়ে শোনাতে পারেননি গুরুদেব। দেহে শক্তি নেই যে একফোটাও। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর গলায় সবাই শুনলেন সেই যুগান্তরকারী বক্তৃতা। সেই সন্ধ্যাবেলাতেই সকলের হাতে হাতে পৌঁছে যায় তা ছাপা হয়ে। সঙ্গে সেদিন গাওয়া হল,
‘ওই মহামানব আসে
দিকে দিকে রোমাঞ্চ যত লাগে
মর্ত্য ধূলির ঘাসে ঘাসে।…………’
মহামানবের চলে যাওয়ার পর
সেই যাওয়ার পথে ধরে তারপরেও সূর্য ওঠার আগে, আধ অন্ধকার পথ দিয়ে শালবীথি জুড়ে জুড়ে ছাত্র-ছাত্রী আর আশ্রমিকদের কোরাস গানে নববর্ষের দিন আলোয় আলো হয়ে উঠত আশ্রম। পুরনো বছরের সব মন খারাপ ধুয়ে নেবার দিন। আর অপেক্ষা করবার দিনে। বিশ্বের চির নবীনতাকে একটি বিশেষ দিনে, বিশেষ তাৎপর্যে উপলব্ধি করার দিন। এই দিনেই বার্ষিক পত্রিকা ‘আমাদের লেখা’ বিক্রির হইচই শুরু হয়ে আম্রকুঞ্জ জুড়ে। হইচই করেই চলতে থাকে সামাজিক কুশন বিনিময় আর জলযোগ। এরপর একটু বিশ্রাম অপেক্ষা সন্ধে হবার। যে শপথ নিজের কাছে নেওয়া হচ্ছে দিনের শুরুতে, তাকেই আর একবার গান দিয়ে বলে নেওয়া নিজেরই কানে কানে। কলকাতা থেকে তখন গাইতে আসতেন প্রাণের শিল্পীরা। দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, মালবিকা কাননেরা। শুধু গুরুদেবের গান নয় কিন্তু্, কখনো নাটক, কখনো শাস্ত্রীয় সংগীতের আসরও নববর্ষের রাতটুকুকে ধরে রাখত নানান শিল্পের আলোয়। এভাবে কোপাইয়ের জলে ছায়া পড়ে বিশ্বের, সোনাঝুরিতে দেখা হয়ে যায় ভারতবর্ষের তরুণের সঙ্গে এল্মহার্স্ট সাহেবের। হয়তো দুজনেই ফিরছেন নববর্ষের উদ্যাপন সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় আবার ফিরবেন উদয়ন চত্বরে। আশ্রমের সবাই তখন ভেজানো কলায় আর মুগডাল, নানা ফলের টুকরো আর মাটির গ্লাসে সরবত খেয়ে নিয়ে শেষবারের মত রিহার্সাল দিয়ে নিচ্ছেন সন্ধের প্রস্তুতির।
দূরে তখন কেউ গাইছেন মনে মনে,
‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।’